আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?
প্রকাশ | ১৪ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:৪৭
সব খারাপেরই একটা ভালো দিক থাকে। একটি নষ্ট ঘড়িও দিনে দুইবার সঠিক সময় দেয়। সম্প্রতি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া হায়াত মাহমুদ’র ভিডিও কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে ভাবালো। ভিডিওটির উপস্থাপনা, বিষয়বস্তু, অযৌক্তিক সংলাপ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। তবে এই ভিডিওর সুবাদে কিছু ইতিবাচক ভাবনার খোরাক আমি পেয়েছি। সে কথাই বলবো এখন।
১। ধূমপায়ী, তিনি নারী/পুরুষ যা-ই হোন, তাদের মধ্যে প্রায়ই এক ধরনের মনোভাব দেখা যায়। ‘নিজের পয়সায় ধূমপান করি, কার কী’/ ‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার’ কিংবা ‘এটা কোন অপরাধ নয়’—এ ধরনের কিছু। এবং বেশির ভাগ সময় তারা ধূমপান করার সময় তোয়াক্কাই করেন না, কার/কাদের সামনে ধূমপান করছেন। শিশু/গর্ভবতী নারী/অসুস্থ ব্যক্তি্র সামনেই দেদারসে ধূমপান করছেন। ধূমপান যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এতো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যে রকমই হোক না কেন! নিজের পয়সায় ধূমপান করলেও এ বিষয়টা খেয়াল রাখলে ক্ষতি কী? ধূমপান করা যদি ব্যক্তিগত ব্যাপারই হয়ে থাকে, তবে তা আরেকজনের নাকের ডগার সামনে না করলেই কি নয়?
আর যারা মনে করেন, ধূমপান কোন অপরাধ নয়-- তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, যখন নিজের ঘরে বা কোন স্মোকিং জোনে বসে আপনি ধূমপান করেন তখন তা অবশ্যই অপরাধ নয়। তবে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে ধূমপান দণ্ডণীয় অপরাধ। বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি জারি হয়েছে। তবে দুঃখের কথা, এই আইনটির কোন বাস্তবায়ন/প্রয়োগ দেখা যায় না। প্রকাশ্যে সিগারেট বিক্রি ও ধূমপান চলছে তো চলছেই। যে কোন সচেতন নাগরিকই চাইবেন, এই আইনটি যেন কার্যকর হয়। আইনটি দ্রুত কার্যকর হোক, আমি চাই আর আপনি?
২। কোন ব্যক্তির বিনা অনুমতিতে/গোপনে ছবি তোলা/ভিডিও করা এবং তা হেয় করার উদ্দেশ্যে/বিদ্বেষ-ঘৃণা তৈরির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মধ্যে পড়ে। হায়াত মাহমুদের ভিডিওটির ভালো দিক এটিই যে, আমাদেরকে এই আইনটি মনে করিয়ে সচেতন করে দিলো। সুতরাং আপনি চাইলেই এ কাজটি করতে পারেন না।
৩। হায়াত মাহমুদের ভিডিওটি একই সাথে নারী বিদ্বেষী ও উস্কানিমূলক। শুধুমাত্র নারীদের হেনস্তা করার জন্য ভিডিও করে তা ভাইরাল করার জন্য এখানে ডাক দেওয়া হয়েছে। এটিও একটি অপরাধ। সাইবার ক্রাইম তো বটেই, সেই সাথে এটি নারী নির্যাতন-ও। এবং ভিডিও নির্মাতাকে নারী নির্যাতন আইনের কথা স্মরণ করিয়ে সাবধান করে দেওয়ার সুন্দর একটি সুযোগ আমরা পেলাম। যারা ঐ ভিডিও দেখে নারীদের এভাবে হেনস্তা করার কথা ভাবছিলেন, তারাও সচেতন হয়ে যেতে পারেন একই সুযোগে।
৪। ভিডিওতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে গোঁজামিলের মত আরেকটি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। গণপরিবহনে সংরক্ষিত আসনে বসা পুরুষদের 'মূর্খ' বলায় তারা অত্যন্ত মাইন্ড করেছেন। আর এই সুযোগে এখন আমরা গণপরিবহনে নারীদের প্রতিদিনের ভোগান্তি নিয়ে সবাইকে সচেতন হবার কথা আবারও বলতে পারছি। এখন আর আগের যুগ নেই। এখন প্রচুর নারী প্রতিদিন তাদের চাকরি/ব্যবসা/শিক্ষা ও অন্যান্য কাজে ঘর থেকে বাইরে চলাফেরা করেন, গণপরিবহন ব্যবহার করেন। দেশে নারীর সংখ্যাও পুরুষের চেয়ে বেশি। অথচ গণপরিবহনে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকে মাত্র ৯ টি। সেটিও প্রতিবন্ধী ও শিশুদের সাথে ভাগাভাগি করতে হয়। সংরক্ষিত আসন পূরণ হয়ে গেলে নারীদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। সংরক্ষিত আসন ছাড়া বাকি আসনগুলোকে অদ্ভুত কারণে মনে করা হয় ‘পুরুষ আসন’। খুবই হাস্যকর। অথচ বাসে সংরক্ষিত আসন ছাড়া অন্য সব আসন সর্বসাধারণের জন্য, সহজ ভাষায় সকলের জন্য। ঐ আসনগুলোতে যে কেউ বসতে পারবে। অথচ ঐ আসনগুলোতে নারীদের বসতে দেওয়া হয় না বা নিরুৎসাহিত করা হয়। নারীদের বসতে হয় ইঞ্জিনের উপর, একদম গ্লাসের সামনে (দুর্ঘটনাতে প্রথম আক্রান্ত হবার ঝুঁকি এখানেই), মালপত্রের সাথে ৩ জনের জায়গায় গাদাগাদি করে ৫ জন। এই ব্যাপারগুলোও কি ঐ ভিডিওতে উঠে আসা উচিত ছিল না? এছাড়া বাসের ভেতরে ইভ টিজিং এর ঘটনার কথা না হয় না-ই বললাম। তাই নারীর সংখ্যা ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাসে নারীদের জন্য আসন বাড়ানোর দাবি আমরা তুলতে পারি।
৫। এই ভিডিওটি আমরা নাকচ করে দিতে পারি। কিন্তু এখানেই আমাদের কাজ শেষ নয়। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সুস্থ, সুন্দর, গভীর গল্পের ছোট ছোট অসংখ্য ভিডিও তৈরির সম্ভাবনাও এখন সৃষ্টি হলো। প্রকাশ্যে ধূমপানের বিরুদ্ধে, যানবাহনের ধোঁয়া/হর্নের বিরুদ্ধে, ট্রাফিক আইন সচেতনতা, গণপরিবহনের আদবকেতা, নারী ও শিশু অধিকার ইত্যাদি নানা রকম বিষয় নিয়ে ঘরে বাইরে তৈরি হোক সুন্দর সুন্দর সব ভিডিও। খুব শীঘ্রই হয়ত এইসব সুন্দর ভিডিওর আলোতে হায়াত মাহমুদের অন্ধকার ভিডিও চিরতরে দূর হয়ে যাবে। আমি তো সামনের সেই সুন্দর দিনগুলি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর আপনি?
লেখক: লেখক ও শিক্ষক