হে মোর দুর্ভাগা দেশ!
প্রকাশ | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, ০১:২২
“তুমি ম্যারিড?! তবুও তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে জাপান আসতে দিলো? ওরিয়েন্টেশনের দিন আমাদের প্রথম পরিচয়ে ওর করা তৃতীয় অথবা চতুর্থ প্রশ্ন ছিল এটা! আমি কোথাও গেলে খুব সহজে মিশে যাই এটা সত্যি, কিন্তু কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যেটা হয়ত বা প্রথম কনভার্সেশনে আশা করি না, এটাও সে ধরনের একটা প্রশ্ন ছিল!! অবাক যদিও হই নি কারন বলতে বাধা নেই, ও একটু স্ট্রেইটকাট মানুষ সেটা ওর গেটআপেই বুঝেছিলাম। তরুন কূটনীতিকদের বিদেশের মাটিতে ট্রেনিং; আজ যার প্রথম দিন, নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা আজকেই; সবাই ফর্মাল পোশাকে এসেছে, কিন্তু সে এসেছে খুবই ইনফর্মালি। আকর্ষক পশ্চিমা পোশাক, চোখে পড়া সাজ, আর ছেড়ে দেয়া চুলে যখন হলে এসে ঢুকেছে অনিন্দ্য রূপের ওই আলো নিয়ে, তখনি অবাক হয়েছি! চেহারা বলছে মধ্য এশিয়ান – অবশ্যই কোন ‘খানদানী মুসলিম’ দেশের কূটনীতিক, অথচ অভিব্যক্তি তেমন নয়ই! যার যার পরিচয় দেবার সময় জানলাম তার দেশের নাম ...আমার অনুমান নির্ভুল! বুদ্ধিমান পাঠক, আপনারাও অনুমানে বুঝে নিন!!
সে যাক, দেশের নাম শুনেই ইমোশনে রক্তগরম করে ফেলা– মুখের উপর উচিত জবাব দিয়ে দেয়া– অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, নিজের মতামতকেই প্রতিষ্ঠা করার নাম ‘ডিপ্লোম্যাসি’ না! তাই হেসেই আসল ফ্যাক্ট বললাম তাকে। কিভাবে হাজব্যান্ড নামক মানুষটিই আমাকে এই জবে ঠেলে পাঠিয়েছে, এই ট্রেনিং এ তো বটেই! এবং আজকাল পতিবরদেরই আগ্রহ থাকা উচিত বউদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তাদের চাকরিতে পাঠিয়ে দিতে– এটা নিয়ে মজা করে উত্তর দেয়ার পর সে কিছুটা স্বগোক্তির স্বরেই বলল, সবাই তো আসলে তেমন না! হাজব্যান্ডদের সহায়তা পাবার কোন গ্যারান্টি নাই বলেই তো এখনো বিয়েই করলাম না আমি! কখনো হয়ত করবোই না!
তবে মনের উপর তো আর ডিপ্লোম্যাসি খাটে না! সেখানে তো আমি স্বাধীন! মন বলে উঠে ... “সে গ্যারান্টি থাকবে কি করে, চান্দু! তোমার যে দেশ! ‘খানদানি মুসলিম’! তার যে পুরুষ সমাজ! নারীর প্রতি তাদের যে মনোভাব ... সারা বিশ্বে কে না জানে সেটা! সেটা বাঙালি চেয়েই বা বেশি কে জানে!!”
দিনে দিনে আলাপ বাড়ে, ওর সাথে বন্ধুত্ব না হবার কোন কারন আমার নেই। খুব সচেতন ভাবে সেও প্রথম দিকেই বলে নিয়েছে আমাদের দুইদেশের মধ্যকার ‘ঐতিহাসিক বোঝা’ গুলোর ব্যপারে তার মনোভাব, আর আমিও সহনশীল আমাদের বর্তমান নিয়ে। তাই চেহারায় মিল আছে ভেবে প্রায়ই আমাদের যখন কেউ গুলিয়ে ফেলতো, ও তাৎক্ষণিক বলে বসতো, আরে! মিল তো হবেই, আমরা তো এক ছিলাম একদিন! আমিও হেসে বলতাম, অনেক কিছুতে মিল ছিল না বলেই আজ আলাদা হয়েছি। তবে ওর মত সুন্দরী যদি আমাকেও দেখায় বলো, আমি আনন্দিত! ইতিহাসে যাই থাকুক, আমাদের সম্পর্কে কোন বিভেদ নেই। একসাথে ঘুরি ফিরি, আনন্দ করি, সেলফি তুলি। আর সুযোগ হলে দেশ’কে– দেশ’এর ভালোত্ব– দেশ এর উদারত্বকে প্রকাশ করি। মুক্ত হয়ে গত কয়েক দশক ধরে আমরা অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছি আপন শক্তিতে, সেটাই আলাপে গল্পে তাকে বুঝাই।.
গর্ব করার মত যা কিছু আছে আমার দেশের, অন্তত তার দেশের চেয়ে বেশি, তা হল সন্ত্রাসবাদ বিরোধী গণসচেতনতা আর নারী স্বাধীনতা! টেরোরিজম নিয়ে তো সবাইকেই বলি, কিন্তু তাকে বিশেষভাবে বলি নারী স্বাধীনতা নিয়ে। তার দেশে এখনো ‘সামরিক কর্মকর্তার সন্তান’ বা ‘নীল রক্তের অধিকারি’ না হলে এসব চাকরি করা যায় না, জানি। মেয়েদের জন্য তার দেশে বড় পদে আসাও কঠিন, সেও জানি।
তবে আমার দেশে এসব বাছবিচার বহু আগেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে, তাই জানাই। নিম্নবিত্ত ছেলে তো বটেই, গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করা তুখোড় মেধাবী মেয়েরাও সরকারের নানা পদে আছেন, সেটা ওকে বলি। সরকারও ভীষণ আন্তরিক মেয়েদের ইস্যুতে। উপবৃত্তি দিয়ে দিয়ে তো পারলে নারী শিক্ষার হার পুরুষের চাইতেও ছাড়িয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে, সেটা বলি। আমরা জাতিসংঘ থেকে বেঁধে দেয়া মাতৃমৃত্যুহার কমিয়েছি। এখন আগের মত মেয়ে হলে বাবা মা হতাশ হন না; পিতারা মেয়েদের পড়াশোনার জন্য বিনিয়োগ করেন। স্বামীরাও চাকরি নিয়ে অত প্রতিবন্ধকতা দেন না। মেয়েরা এখন চাকরি করে– হাজব্যান্ড মেইন্টেইন করেও নিজের ফ্যামিলিকে দেখে, পরিবারে সিদ্ধান্ত দেবার মত জোর আছে তাদের। আর আমাদের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি গার্মেন্টস সেক্টর, সেটা তো হাতে তুলে নিয়েছে মেয়েরাই। এক সময়ে ইভটিজিং ছিল, এসিড নিক্ষেপ ছিল, অপহরণ ছিল– এখন এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। আমাদের দেশে মেয়েদের পর্দা নিয়ে গোঁড়ামি নেই, অনার কিলিং এর মত বাজে ব্যাপার নেই, ধর্ষণ প্রমাণে চারজন সুস্থ সবল পুরুষ সাক্ষি লাগবে – এমন অদ্ভুত নিয়ম নীতিও নেই। বরং মেয়েদের আইন কানুন এত কড়াকড়ি হয়েছে, শ্বশুরপক্ষের নামে একটা যৌতুকের মামলা ঠুকে গেলেই, ব্যাস! আজন্মের মত সাইজ হয়ে যায় পুরো পরিবার!
এসব বলে খুব অহংকার হত আমার! কারন জানি, এসব দিকে আমার দেশ শুধু তার দেশ তো নয়, বিশ্বের অনেক দেশ থেকে অনেক প্রোগ্রেসিভ, মানবীয় আর বিবেচনা সম্পন্ন। পিতা হিসেবে– স্বামী হিসেবে যে পুরুষকে বাংলার মায়েরা বড় করেছেন, তারা নুন্যতম হলেও নারীর প্রতি সম্মান করতে পারেন। অন্তত বিশ্বের অনেক অনেক দেশের- অনেক অনেক জাতির চাইতেও বেশি, এ বিশ্বাস থেকেই কথাগুলো বলতাম আমি। শুধু ওকেই নয়, সবখানেই। যখনই সুযোগ পেয়েছি।
গত তিনমাস বাংলা পত্রিকা পড়ি নি। নিউজলিঙ্কে শুধু দরকারি বড়-বড় খবরই পেয়েছি। কিন্তু আমিও জানি আমার গর্বের দেশের পত্রিকাগুলোতে আজও ‘দেশের পাতা’য় চিপায় কোনায় ‘তরুণীকে ধর্ষণ’, ‘শিশুর প্রতি যৌনতা’, ‘যৌতুকের দায়ে স্ত্রীকে আগুনে পোড়ানো’ কিংবা ‘অপমান অভিমানে নারীর আত্মহত্যা’র শিরোনামে অপাংঙতেয় কিছু খবর রোজই ছাপছে!! এসব আমার ‘সোনার দেশে’ রোজই হচ্ছে! ‘জগতের অনেক অন্যায় শত চেষ্টার পরেও আমি পরিবর্তন করতে পারবো না– মেনে নেয়া ছাড়া!’ – এই বাক্যকে মেনে নিয়েই দেশে ফিরে ওসব খবরের সাথেই আমি অপু শাকিবের ভাঙ্গনের লেটেস্ট খবর পড়ছি! নতুন বছরের ফ্যাশন কি হবে, নববধূরা আজকাল কোন ফেসিয়াল নিচ্ছেন, এসব পড়ছি! দশদিনের ছুটিটা পৃথিবীর সব ‘কলুষতা’কে দূরে রেখে উপভোগ করছি!! আবার ফিরে যাবো জাপানে, সে বান্ধবীকে আর অন্য বন্ধুদের আমার জামদানির গল্প বলবো! বৃহত্তর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট এর অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের গল্প বলবো! টানা ২৭ বছর ধরে নারী নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের গল্প বলবো!
বলবো না, আমার দেশে সেদিনও একটা গ্রাম্য সালিশ বসেছে! সেখানে পরকীয়ার অভিযুক্ত হিসেবে শুধু তরুণী মেয়েটিকে বিচার করা হয়েছে! এরপর সুষ্ঠু প্রমাণ ছাড়াই, ‘ইসলামি শরিয়া’ কায়েমের নামে তাকে ১০১ দোররা মারা হয়েছে। ব্যাথায় অপমানে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে জাগিয়ে তুলে আবারো মেরে ১০১টা আঘাত পূর্ণ করা হয়েছে। বাচ্চা বয়সি মেয়ে তো, একদিন পর হাসপাতালে মরে গেছে! আমার শান্তির ধর্ম ইসলাম, সেখানে মানুষ খুন করার কথা বলা না থাকলেও যখন কেউ শরিয়া কায়েমের নামে টেরোরিজম করে, ওকে আমরা সোয়াট দিয়ে ধরে ভর্তা করে দেই। কিন্তু এসব গ্রাম্য সালিশের নির্মম রায়ের কিছুই করতে পারি না!
আমার বান্ধবি ঠিকই তো বলে! আমরা এক দেশ ছিলাম! আমাদের মধ্যে মিল তো থাকবেই! বিজয়ের মাসের শেষ দিকে এই আমার উপলব্ধি হলে, সেটা কি ‘দেশপ্রেম’ এর পরিপন্থী হবে, আমার বাংলাদেশ? এখন থেকে তোমাকে নিয়ে গর্বের গল্প ফাঁদার আগে, চোখ আগের মত তেজদ্বিপ্ত হবে না! বরং অপরাধীর মত মিনমিন করেই বলবো... আমার দেশ আগাচ্ছে!! আমার দেশ অবিশ্বাস্য ভাবে আগাচ্ছে!!
লেখক: চিকিৎসক