চিন্তার পরিবর্তন হোক

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:৪৭

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ছেলেরা বংশের প্রদীপ, কতজনের আহাজারি শুনেছি আহা আমার একটা ছেলে নাই। আমার বংশ কে রক্ষা করবে। এখনও কতজন মেয়ে মা হওয়ার সময় ছেলে হবে কিনা সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে। কারন ছেলে না হলে শ্বশুর বাড়ির লোকের নানা কথা শুনতে হবে। শ্বশুর বলে ‘বউমা’ আমার যেন একটা নাতি হয়, বংশ রক্ষা করার দায়িত্ব কিন্তু তোমার ওপর, তা না হলে আমার বংশের বাতি জ্বালাবে কে? বাবার মত তার স্বামীরও কথা তার যেন একটা ছেলে হয়। আর এতে সমস্যায় পড়ে মেয়েটি, অসুস্থ মানুষ আরো অসুস্থ হয়ে যায়, তার ছেলে হবে কিনা এই চিন্তায়। কেউ চিন্তা করে না ছেলে হোক মেয়ে হোক চাই সুস্থ বাচ্চা। তার চার পাশটা অতি উৎসাহ নিয়ে শোনার অপেক্ষায় থাকে আলট্রার রির্পোট কি? ছেলে হলে তো আগে থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হয়। ছেলে হোক মেয়ে হোক সবার সুস্থ বাচ্চা আশা করা উচিত, এই সমাজে দুজনের ভুমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের সমাজে ছেলের মা বাবার অনেক দাম। এই সমাজে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের দাম নেই আর মেয়ের বাবা মার দাম তো দূরের কথা। একজন ছেলের মায়েরও শ্বশুর বাড়িতে অনেক দাম। ছেলে হয়েছে শুনে সাথে সাথে কত শ্বশুর মশাই গরু কুরবানী দেয়। আবার মেয়ে হওয়ার কথা শুনে অনেকে আছে, হসপিটালে নাতনিকে দেখতে যায় না কারন দুঃখে শোকে কাতর, তার বুঝি বংশের বাতি আর জ্বলবে না। এরকম ধ্যান ধারনাগুলো এখনও মানুষের মধ্যে আছে।

আবার ছেলের বাবা মা হিসেবে তাদের দামটা সমাজে একটু বেশী থাকে। অনেক ছেলের মা, বাবা গর্ব করে বলে আমার তো দুই ছেলে তাই আর কোন চিন্তা নেই। কোন কিছু দিতে হবে না বরং উল্টা নিয়ে আসবো। আর মেয়েদের বাবা মাকে মেয়ে জন্ম দেওয়ার পর থেকে চিন্তিত থাকতে হয়। মেয়ে জন্ম হওয়ার পর থেকে মায়েদের চিন্তা থাকে একটু একটু গয়না বানানো, টাকা জমানো কারণ মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় তো অনেক টাকা প্রয়োজন। কিছু না দিলে শ্বশুর বাড়িতে মেয়েকে অনেক কথা শুনতে হবে। যৌতুকটাই এখন ভিন্ন নামে পরিচিত মানে খুশি হয়ে মেয়ের বাবা মায়ের উপহার প্রদান। এটা এখন একটা সামাজিক ফ্যাশন। এই যৌতুকের বলি হয়ে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করে।

আমাদের চেয়ে ভারত আরও অনেক পিছিয়ে আছে তারা আল্ট্রাতে মেয়ে হবে বুঝতে পারলে, আগে থেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে দেখি ভারতের কিছু কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়ে হওয়ার পর কাছের আত্মীয় স্বজন মিলে শিশুটিকে হত্যা করে। মেয়ে হওয়া মানে তাদের কাছে যেন একটা বড় অপরাধ। এর দুটো কারন হতে পারে কুসংষ্কার ও অর্থনৈতিক র্দুবলতা।

অনেক আত্মীয় স্বজনও আছে পারলে খোঁচা মারে কি ভাই আপনার দুইটা মেয়ে কোন ছেলে নাই, এত সম্পত্তি কি করবেন? মেয়েরা তো পরের বাড়ি যাবে। এসব মানুষেরা নিজেদের চেয়ে অন্য জনের ছেলে হয় না কেন, সম্পত্তি কে রক্ষা করবে, মেয়ের জামাই মানে পরের বাড়ির ছেলে এসে ভোগ করবে, তা কি করে হয় এসব নিয়ে পড়ে থাকে।

অনেকে আছে ছেলে সন্তান হচ্ছে না বলে ছেলেকে আবার বিয়ে দিতে চায়। এরকম অনেক শুনেছি বার বার যখন মেয়ে হচ্ছে তখন সেই বংশকে রক্ষা করার জন্য ছেলেকে আবার বিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু তাদেরকে বুঝানো খুব কঠিন যে তাদের ছেলের কারণে ছেলে সন্তান হচ্ছে না। এতে মেয়েদের কোন কারন থাকে না। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে কম হলেও গ্রামে বার বার মেয়ে সন্তান হলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়।

আমি যখন মা হয়েছিলাম তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল আমার মেয়ে হবে, কারন মেয়েরা মায়ের দুঃখ বুঝে। আমি মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলাম কিন্তু আলট্রাতে যখন জানতে পারি আমার ছেলে হবে সেটা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসে, যারা ওখানে ছিল তারা তো একটুখানি অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমিও হয়ত প্রথমটা মেয়ে হলে দ্বিতীয়টা ছেলে সন্তান আশা করতাম। কারন অন্য মেয়েদের মত আমিও ব্যতিক্রম না।

আমরা দুই ভাই। আমার বড় ভাইয়ের দুই মেয়ে, আমার ছোট ভাইয়ের যখন মেয়ে হয়, আমার মা খুশি হয়েছে কিন্তু ১০০% খুশি হতে পারেনি। কারন তার মনের মধ্যে একটু আশা ছিল ছেলে হওয়ার তা না হলে আমার বাবার সম্পত্তি কে রক্ষা করবে। আমার মা তো অনেক আগের মানুষ তার কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু আমরা বর্তমান সময়ের মেয়েরা এখনও ছেলে সন্তান আশা করি।

মেয়েরা ছোট থেকে জেনে আসে মেয়েরা পরের বাড়ির জন্য জন্ম হয়েছে। সে বড় হলে শ্বশুর বাড়ি যাবে এটাই সামাজিক নিয়ম। মেয়েদের বাপের বাড়িতে বিয়ের পর কোন অধিকার থাকতে নাই। মেয়েরা বাবার সম্পত্তি তেমন পায় না। পেলেও নিতে হয় না ভাইদের ছেড়ে দিতে হয়। ছোট থেকে মেয়েদের শুনে আসতে হয় এইটা তোমার ভাইয়ের, ওই জিনিসটা তোমার ভাইয়ের। এসব শুনে মেয়েরা আর তখন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। কারন সে নিজের পরিবারে ছোট থেকে জেনে আসছে মেয়েরা শুধু বঞ্চিত আর বঞ্চিত।

কেন ভাবি না আমার মেয়েটাই একদিন আমার বংশের মান সম্মান রক্ষা করবে। ছেলে নাই বলে সারা জীবন মনোকষ্ট নিয়ে থাকার কি দরকার। মেয়েদেরকে আসলে আমাদের সেই সুযোগ ও সম্মানটা দিতে হবে। ছোট থেকে মেয়েদের সম্মান ও অধিকারের পাশাপাশি কোন কাজে উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিলে সেও পারবে একদিন আপনার বংশের প্রদীপ জ্বালাতে।

লেখক: তরুণ লেখক