আমি মা, আমি বোন, আমি পতিতা!
প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৬, ১৩:৪০
আমি যেখানে থাকি সেখানে আমার মত প্রবাসী মানুষের আনাগোনা বেশি। আমার শহরে বোরখার দোকান থেকে শুরু করে হালাল খাবারের দোকানসহ কয়েকটি মসজিদও আছে। আবার একটি বিশাল গীর্জাও আছে এই শহরে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ঘুরেছি কোনদিন কোন বৌদ্ধ বা হিন্দু মন্দির দেখিনি আমি। তাহলে কি তারা ধর্ম পালন করেন না? নিশ্চয়ই করেন। হিন্দুরা এখানে মন্দির ছাড়াই (ইংল্যান্ড ছাড়া) একটি বিশেষ স্থানে দূর্গাপূজার সময় উৎসব পালন করেন। আমি বাংলাদেশে থাকতে বড়দিনে গীর্জায় খ্রীষ্টানদের উৎসব দেখতে যেতাম। খুব বেশি মন্দিরে যেতাম দূর্গাপূজার সময়। বাড়ির পাশের বৌদ্ধমন্দিরেও গিয়েছি অনেকবার। যদিও জার্মানিতে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে থাকতে কোনদিন কোন মসজিদে প্রবেশ করার অনুমতি পাইনি। পরে যে সময়ে মেয়েদের জন্য মসজিদে আলাদা জায়গা হয়েছে তখন আর কোনদিন মসজিদের ভেতর যেতে ইচ্ছে করেনি।
কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত বড় ভাই বাংলাদেশের কোন একটা মসজিদের পুকুর ঘাটের পাশে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেন, যেখানে লেখা ঘাটে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ!! এক সময় শাহজালাল ও শাহপরাণ মাজারেও গিয়েছি কিন্তু মুল মাজারে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ, হ্যাঁ এর কারন হলো মেয়েদের দেহের “ঋতুস্রাব” প্রক্রিয়া। যদিও আমি তখন ছোট ছিলাম বয়স ছিল ৮-১০ এর মধ্যে। আমার তখনও “ঋতুস্রাব” হয়নি, তারপরও ভবিষ্যতে আমি শিশু থেকে নারী হয়ে উঠবো বলে, সেখানে প্রবেশাধিকার পেলাম না। “ঋতুস্রাব” হলে মেয়েরা নাকি অপবিত্র হয়ে যায়। যে প্রক্রিয়া নারীর শরীরে নিয়মিত না হলে সন্তান জন্মদানেই সমস্যা হয়ে যায়, তাই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থানুযায়ী অপবিত্র বা নাপাক। নাপাক শরীরে মেয়েরা নামাজ পড়তে পারে না, রোজা রাখতে পারে না, পূজা করতে পারে না, আরো অনেক কিছু থেকে অধিকার হারায়।
ইউরোপে আসার পর, যখন বন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়ছিলাম তখন আমার এক আফ্রিকান বন্ধু গেমেচু বেকেলে একটা টিভি প্রজেক্ট করছিল। আমার অনলাইন প্রজেক্টে গেমেচু সাহায্য করার আমারও দায়িত্ব হয়ে যায় ওকে সাহায্য করার। ওর টিভি প্রজেক্টটি ছিল, একটি ক্যাথলিক গীর্জার ওপর। আমি বাংলাদেশ থেকে আসা অতি সাধারণ নারী। বিভিন্ন জায়গায় আমার প্রবেশ নিষেধ, আর ধর্মীয় পীঠস্থানগুলো থেকে দূরেই থাকি। সেদিন আমার “ঋতুস্রাব” চলছিল। কিভাবে আমি গীর্জায় গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ফুটেজ নেই বুঝতে পারছিলাম না, তাই আগেরই গেমেচুকে জানাই আর অপারগতা প্রকাশ করি। গেমেচুকে জানাতেই ও বললো, আরে এটা কোন ব্যাপারই না। আমি বললাম, তুমি নিজের প্রজেক্টের কারনে বলছো। আমি আগে এই গীর্জার পাদ্রীর সঙ্গে কথা বলবো, তারপর আমি সেখানে প্রবেশ করবো তোমাকে ফুটেজ নিতে সাহায্য করতে। আমি পাদ্রীকে আমার শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটার কথা জানাতেই তিনি বললেন, মাই চাইল্ড তুমি সৃষ্টিকর্তা না মানলেও আমার বিশ্বাস সৃস্টিকর্তাই তোমাকে তোমার শরীরে এই প্রক্রিয়াটি দিয়েছেন। তুমি নির্দ্বিধায় গীর্জায় প্রবেশ করো আর নিজের কাজ করো, এসব ব্যাপারে কোন বাধা নেই এখানে। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়েছিলাম। কারো কারো মতে পশ্চিমাদের ডাবল স্টান্ডার্ডের কলঙ্কজনক ইতিহাস থাকার পরেও এই সভ্যতা তারা কোথা থেকে শিখলো? কিভাবে তারা নারীর দূর্বল মুহুর্তটিকেও সম্মান করে। না, আমি কোন বিশেষ ধর্মের বন্দনা করতে আজ লিখছিনা। কিশোরী বয়সে, বাসায় যখন হুজুর আসতো যেদিন “ঋতুস্রাব” থাকতো তখন মাটির দিকে তাকিয়ে বলতাম, হুজুর আগামী সাতদিন এসেন না। আমার শরীর খারাপ, আমি কোরান পড়তে পারবো না। হুজুর মুচকি মুচকি হাসতো আর বুঝিয়ে দিতো আমি জানি তোমার কি হয়েছে।
যে ধর্মে আমি এক সময় বিশ্বাস করতাম, যে ধর্মের নবীর জন্ম একজন নারীর গর্ভে, যেই নারীকে পূজা করা হয় বিভিন্ন সময় সেই নারীর “ঋতুস্রাব” হলে সে অপবিত্র হয়ে যাওয়ার থিওরী কোথা থেকে আসলো আমার জানা নেই। শুধু জানি, আমি নারী, আমার গায়ে আমার সম্মতির বাইরে হাত দিলেও আমাকে চুপ করে থাকতে হবে। আমি জানি, মেয়ে মানুষের জোরে কথা বলতে নেই। আমি শুধু জানি, আমি কোন কবরস্থানে প্রবেশ করতে পারবো না। আমার অধিকার শুধু চুপ করে থাকা। যখন যার গালি দেবার, আমাকে ব্যবহার করার করে যাবে আর আমি চুপ করে থেকে তার অন্যায়ের সঙ্গে সহমত দিয়ে যাবো। আমি জোরে কথা বলতে চাইলে, প্রাণ খুলে কথা বলতে চাইলে আমার সহযোদ্ধারা আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে, দল বেধে আমার উপর ভর্ৎসনা করে যাবে। এমনকি পরিচিত নারীরা বলবে, এত বড় সাহস কেন তোমার, তুমি প্রথাবিরোধী কথা বলো !! তুমি তো কাফের !!
আমাকে বুদ্ধি থাকলেও তা কম দেখাতে হয়, আমার বস বা আমার বয়ফ্রেন্ড তা পছন্দ করবে না। আমাকে সৃজনশীল হতে হয়, আমাকে পাশের পুরুষের পছন্দের পারফেক্ট ওম্যান হতে হয়। আমার রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা বা প্রতিবাদ করার কোন অধিকার নেই। স্বামী চাইলে বোরখা পরবো না চাইলে পরবো না, আমার ব্যাক্তিগত কোন ভাল লাগা নেই। আমি ধর্ষিত হলে আমায় শুনতে হয় আমার শরীরের পোশাকটিই আমাকে ধর্ষিত হতে সাহায্য করেছে। কখনো বা শুনি, তোমাকে ধর্ষণ করলো অথচ তোমার পেটে বাচ্চা আসেনি কেন এটাই বোধগম্য নয়। আমাকে কবিতা সিংহের মত করে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলতে হয়, আচ্ছা এখানে কোন বাসটা বাড্ডা যাবে বলতে পারেন? আমি নারী, আমি অবিশ্বাসী, আমি কাফের, আমি বস্তিবাসিনী, আমি অট্রালিকার রাজকন্যা, আমি আটকে পড়া ফাঁদের একটি নরকের কীট, আমি প্রথাবিরোধী, আমি অস্পৃহ, আমি পূজনীয়, আমি মা, আমি বোন, আমি স্ত্রী, আমি পতিতা, আমি রক্ষিতা, আমি ভোগের পণ্য, আমি তোমাদের সকল ঘৃণার উৎস। তবু তোমরা ভাল থাকো।
লেখক: প্রবাসী বাঙালি ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট