আইএস ইস্যু

মূর্খরা সব শোনো-মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!

প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৬, ০০:২৯

আমি যখন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেছি তখনই জানলাম ফ্রান্সে একটি হামলার ঘটনা ঘটেছে যাতে প্রায় আশিজন মানুষ মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক। এবারের উপায়টি ভিন্ন। ট্রাকে করে অস্ত্র নিয়ে সেটি সাধারণ মানুষের ওপর চালিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে গুলি করে মানুষ হত্যা। আমি যখন আইএস ইস্যু নিয়ে কিছু লিখবো বলে একটি লেখা শুরু করতে যাচ্ছি তখনই এরকম একটি হামলা আমার হাতের ওপর চেপে বসে, আমাকে আরও প্রতিজ্ঞ করে তোলে প্রতিবাদ করতে, সোচ্চার হতে।
   
এদেশের তরুণদের পক্ষ থেকে তরুণদের নিয়ে যখন আমাকে কিছু বলতে বলা হয় তখন ভীষণ আনন্দ বোধ করি। কিন্তু এই প্রথম ভীষণ সংকোচ নিয়ে আমাকে লিখতে বসতে হয়েছে। কারণ- ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যে অবিশ্বাস্য জঘন্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গেছে সেটি ঘটিয়েছে কিছু এদেশি তরুণ। শুধু এদেশি নয়, তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বলে পরিচিত কিছু প্রতিষ্ঠানে পড়া তরুণ। যখন দেশ নিয়ে সমাজের জন্য স্বপ্ন দেখার বয়স, নতুন কিছু করার বয়স, প্রেম নিয়ে ভাবার বয়স তখন তারা বিদেশী এবং এদেশি মানুষদের গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা করে সারাবিশ্বে ‘আইএস’ নামে পরিচিত একটি জঙ্গিবাদী সংস্থার সদস্য হিসেবে জানান দিয়েছে। 

সারাবিশ্বের মিডিয়া এবং সাইট ইন্টেলিঞ্জেস নামের একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জঙ্গি এসব তরুণদের ছবি যখন প্রকাশিত হয়েছে তখন আমি বিস্ময় নিয়ে দেখেছি সেই ছবিগুলিতে এরা প্রত্যেকেই অস্ত্র হাতে হাসিমুখে ছবি তুলেছে! একজন তরুণ কতটা অমানুষ হয়ে উঠলে এরকম হাসিমুখে অস্ত্র নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারে ভেবে শিউরে উঠেছি! 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ আমার লেখা পড়ে। মানবাধিকার, জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা নিয়ে লেখার কারণে গুলশান হামলার পরদিনও আমাকে হত্যার হুমকি পেতে হয়েছে। কেননা- গুলশান হামলার নারকীয় হত্যাযজ্ঞটি যখন ঘটছে তখন আমি সাধ্যমতো সেই সম্পর্কিত তথ্যগুলো বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানিয়েছি, এর বিরুদ্ধে তরুণদের সোচ্চার হবার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কৌতূহলী মানুষ। যখন সারাদেশের মানুষ গুলশানের হামলাটি নিয়ে প্রবল বিস্ময় ও আতঙ্কে স্তম্ভিত তখন আমি এই জঙ্গি তরুণদের বেশ কয়েকজনের ফেসবুক প্রোফাইল খুঁজে বের করেছিলাম। আমি দেখেছিলাম ছয়মাস আগেও তারা এদেশি আর দশটি তরুণ থেকে আলাদা ছিলোনা। তারাও প্রিয় অভিনেত্রীর হাত ছুঁয়ে আনন্দিত হতো, মানুষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতো! 

এদেশে আইএসের অস্তিত্ব বারবারই অস্বীকার করে আসা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ মুখে বলেছেন- এদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। বারবার অস্বীকার করা বিষয়টি কীভাবে প্রকাশিত হয়ে গেলো তা কিছুতেই আমার মাথায় আসেনা!
 
ধর্মবিশ্বাস প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু যখন সেই ধর্মের বরাত দিয়ে মানুষ হত্যার মতন জঘন্যতম কাজটি হাসিমুখে সুসম্পন্ন করা যায় তখন বিষয়টি আর ব্যক্তিগত থাকে না। খুব অবাক হয়ে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়, অভিজিৎ রায় নামের মানুষগুলিকে যখন ধর্মের ট্যাগ দিয়ে শুধুমাত্র ভিন্নমতের দোহাই দিয়ে হত্যা করা হল তখন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এটি নিয়ে প্রশাসন বা সরকারের তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিলো না, একটি নীরবতা ছিল। প্রথমে ব্লগার হত্যা, নাস্তিক হত্যার পরে ভিন্নধর্মের মানুষ হত্যা, হিন্দু পুরোহিত হত্যা, বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যা হতে শুরু করল ইসলামিক জঙ্গিবাদের বেশে। যার ফলাফল গুলশানের এই বিদেশী মানুষদের হত্যা করা। এরপর প্রশাসন এর ব্যাপারে দেরীতে হলেও কঠোর হতে শুরু করেছে দেখে মনে আশা জাগছে।

মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মাঝে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম। ‘পিস টিভি’ নামের জঙ্গিবাদের ইন্ধন দেওয়া চ্যানেলটি বন্ধ হয়েছে দেখে একটি প্রাথমিক স্বস্তি পেয়েছি। কারণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মিথ্যে বলার স্বাধীনতা এক নয়। মাইক্রোসফট নামের প্রতিষ্ঠানটির তরুণ ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হওয়ার সুবাদে আমার এদেশের মেধাবী তরুণদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কেউ প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে আরও অসংখ্য তরুণের কর্মসংস্থান তৈরি করছে, দেশের উন্নতিতে ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় কাজ করে চলেছে। একদিকে আলো ছড়িয়ে দেওয়া তরুণ আর শান্তিকামী মানুষ, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত কিছু তরুণ অমানুষ! 

আজ ফ্রান্সের হামলা ও এক তারিখে সারাবিশ্বকে নাড়া দেওয়া গুলশান হামলা আইএস নামের একটি অশুভ শক্তির উত্থানের জানান দিচ্ছে। যেটি নাড়া দিচ্ছে পুরো পৃথিবীর সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষকেও। শুধু বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলেই হবে না, খতিয়ে দেখতে হবে ঠিক কীভাবে মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করে জঙ্গিরা। ঠিক কীভাবে তরুণরা এই বিকৃত মতবাদে দীক্ষিত হয়। 

পাশাপাশি এটিও তদন্ত হওয়া দরকার ঠিক কারা সেই অদৃশ্য শক্তি, যারা তরুণদের হাতে অস্ত্র, চাপাতি তুলে দেয়, মগজে ঢুকায় জিহাদের মন্ত্র। এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে কারণে অকারণে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গ্রন্থে জিহাদ শব্দটি এসেছে ১৬৪ বার! এটিও অস্বীকার করা যাবেনা যে অসংখ্য সূরায় ও আয়াতে বিধর্মীদের, অমুসলিমদের হত্যার কথা, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের কথা আছে। যারা বারবার ইসলাম শান্তির ধর্ম, জঙ্গিরা ব্রেন ওয়াশড বলে খালাস পেতে চান, তাদের এটিও মনে রাখা দরকার যে ব্রেন ওয়াশের পেছনে কোনো না কোনো ভূমিকা থাকেই ধর্মীয় গ্রন্থগুলির। ভূমিকাটি তৈরি করে অন্ধবিশ্বাস নামের বিষয়টি। স্বীকার করে নিয়ে বদলে ফেলা হোক মানবতার বিপক্ষের সব কিছু। কোনো ধর্মে রিফরমেশান হয়নি তা তো নয়। সতীদাহের মতন জঘন্য প্রথাগুলোর বিলোপ হয়েছে বদলে ফেলার বদৌলতে। 

সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেকদিন আগে লিখেছেন:
“ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে, 
যাহারা আনিলো গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”

ফারাজ আইয়াজ হোসেন নামের এক তরুণের কথা নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে সারা পৃথিবীর ও দেশীয় গণমাধ্যমে এসেছে। যে তরুণটি বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য স্বেচ্ছায় থেকে গিয়েছিল সেই রেস্তোঁরাতেই। মুসলিম হওয়াতে যে ছেলেটিকে জঙ্গিরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ছেলেটি আসেনি। এটিই মানবধর্ম। যে পৃথিবীটিতে ফারাজ আইয়াজ আর মানবাধিকারের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, উন্নয়নে কাজ করা এমন অসংখ্য তরুণ আছে, অসংখ্য তরুণ গবেষক, বিজ্ঞানী, রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে সমাজের উন্নতির জন্য, জীবনমান উন্নয়নের জন্য- সেদেশ, সেই পৃথিবী নিয়ে আমি হতাশ নই কিছুতেই! 

লেখক: তরুণ লেখক ও সাহিত্যিক