ঐশী আমার কন্যার মতোই একটি অসহায় কন্যা
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৬, ০০:১৩
ঐশীর ফাঁসির রায় নাকি কার্যকর করা হয়ে যাবে বলে শুনছি। কিন্তু কেন যেন মনে হয় সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং এসে যদি এ আদেশ প্রতিহত করতেন তাহলে মেয়েটি হয়তো বেঁচে যেতো। যেখানে এ দেশে অসম্ভব নৃশংসতার মধ্য দিয়ে কত মেয়ে ধর্ষিত এবং নিহত হচ্ছে সেখানে ঐশীর মত নিষ্ঠুরতম একজন খুনির ফাঁসির আদেশের মাধ্যমে মৃত্যুতে আসলে কি এমন আসে যায়? কিছুই না।
কিন্ত মনে বড় ব্যথা বাজে। যতবারই ওকে একটি খুনী হিসেবে কল্পনা করেছি ততবারই আমার সামনে আমার কন্যার মুখ ভেসে উঠেছে। আমার কন্যা কতক্ষণ পর পর এসে আমাকে আদর করে চুমু খেয়ে যায়। আমিও কিছুক্ষণ পরপর ওকে বলি এসো কোলে এসো। কোলে নিয়ে বসে থাকি। এতে আমার কন্যার যে একটি অবুঝ ভালবাসার আকাঙ্ক্ষা সেটা একটু হলেও প্রশমিত থাকে। অল্প বয়সের একটা অবুঝ চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে। যার জন্য মানুষ এক ধরনের হাহাকারে ভোগে। বয়সন্ধিকালে এসব দেখা দেয়। ঐশীও তো বাবা মায়ের ঐ রকম একটি আদরের মেয়ে। আমার মেয়ে তার উপার্জিত অর্থ থেকে আজ আমার জন্য পোশাক আশাক কিনে এনেছে। আমি ঋদ্ধ মনে সেই পোশাক পরে বসে আছি। আর ভাবছি কত সৌভাগ্য আমার! ঐশীর মাও তো আমার মত কন্যার ভালবাসায় ঋদ্ধ এবং গর্বিত হতে পারতেন।
কিন্তু তারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ঐশীর হাতে নিহত হয়েছেন বলে জেনেছি। কিন্তু একটা না একটা সমস্যা তো আছেই এখানে। নিজের সাথে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করি। আমি কন্যার দিকে সার্বক্ষণিক তাকিয়ে বসে থাকি। ছেলের দিকেও। এতটুকু অস্থিরতা দেখলে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে বাবা? ছেলেমেয়ের সাথে ঐশীকে মেলাতে গিয়ে মনে হয়েছে, না, মেয়েটির তো দোষ নেই, দোষ হলে মাদকের, দোষ হল অসৎ সঙ্গের, দোষ হল বাবা মায়ের অমনোযোগিতার, দোষ আসলে মাদক বিক্রেতা এবং উৎপাদনকারীসহ অন্য আরো এক স্বার্থলোভি হায়েনার। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীকে ধরার সাহস এবং ইচ্ছা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে নেই; তাই অপরাধ জগতে চুনোপুঁটিদের এই রকম বিচারের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার সক্রিয়তা রক্ষা করা। তবুও ভালো, এটা আশার আলো যে এখনো আমাদের আইন আদালত সুষ্ঠুভাবে বিচার করতে পারছে।
আসল অপরাধীরা বা রাঘব বোয়ালেরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদেরকে ধরা যায় না। ধরলেও ছেড়ে দিতে হয়। তাই দেশে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দিয়ে একরকম না এক রকমভাবে পার পেয়ে যায় প্রকৃত অপরাধী। এক্ষত্রে আমরা অনেক ঘটনাকেই সামনে নিয়ে আসতে পারি যে ঘটনাগুলোতে দেখা যায় প্রকৃত অপরাধীকে ধরা যায় না। কিন্তু ঐশী পালাতে চেয়েছিল। পরে সে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এতে খুনী হলেও তার একটি পরিচ্ছন্ন সমর্পণ আছে। সে কোথায় যাবে এই আশ্বাস এবং আশ্রয়টুকু তার নেই। তাই সে আত্মসমর্পণ করেছে। (একটি কথা তো সত্য নারী বলে সে কোথাও পালাতে বা নিখোঁজ হয়ে থাকতে পারেনি।) এর পরে সে আর মুক্তি পায়নি। এরপরে সে জেলে আছে। সে যে অপরাধ করেছে কি করে নাই মুক্ত পরিবেশে বের হয়ে সে সাহসের সাথে সে কথা বলতে পারেনি। কারণ সে জামিনে বের হবার সুযোগ পায়নি। জামিন করাবে কে? তার যদি বাবা মা থাকতেন অথবা তার যদি একটি বড় ভাই বা বোন থাকতো তাহলে জামিনে রেখে ধীরে সুস্থে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলে জিজ্ঞেস করতে পারতো কোন কারণে সে বাবা মা দুজনকে খুন করেছে। কিন্তু মেয়েটির জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে কেউ এ দায়িত্বটি পালন করার সুযোগ পায়নি। তার রয়েছে একটি ছোটভাই ঐহী, যাকে জেলখানায় সে দেখতে চেয়েছে কিন্তু ভাইটির লেখাপড়ার অজুহাতে তাকে এখনো দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এটি তো আইনসঙ্গত বিষয় না।
মেয়েটি কৈশোর অতিক্রম করেছে কী না এ নিয়ে একটি পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে যে সে আঠারো অতিক্রম করেছে। এতে তাকে মাফ করার আর সুযোগ নেই। কিন্তু আঠারো বছর বড় সাংঘাতিক একটি বয়স। বড় সংবেদনশীল এবং সংকল্পের কঠিন সময় এই আঠারো বছর বয়স। যেকোনো ভুল যেকোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে জীবনকে ধ্বংস করা ঐ বয়সী মানুষের জন্য একটি পুতুল খেলার মত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই না বুঝে শুনেই এক একটি কাজ করে ফেলা এদের কাছে অসম্ভব নয়। এর উপর নেশা একটি বিরাট অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আর স্বার্থলোভী বন্ধু নামক শত্রুরা তো ফাঁদ পেতেই রাখে।
তা না হলে আগেই ঐশীর বন্ধুদের দ্বারা প্রকাশিত একটি নাচের ছবি ইউটিউবে দেখছিলাম। বিজ্ঞাপনটা হল এরকম, "ঐশীর হট ভিডিও ফাঁস"। এখন কথা হল ঐশীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সময় কোন সে সুবন্ধু কী কারণে ঐশীর হট হোক কুল হোক ভিডিও প্রকাশ করে? কেন কী উদ্দেশ্যে করে? বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগ এবং আইন বিভাগ তো বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখতে পারেন। এটা প্রকাশ করার কারণ হল ঐশীর প্রতি জনগণের সংবেদনা সৃষ্টি হতে না দেওয়া। ভিডিওটি আমি কয়েকবার দেখেছি, কোথাও কোনো হট বা গরম বাতাস লাগেনি। মেয়েটি সালোয়ার কামিজ ওড়না পড়ে কোমড়ে ওড়নাটি ভাল করে পেঁচিয়ে নিয়ে একটি ছেলে বন্ধুর সাথে নেচেছে। পরিবেশটা হল ঘরের পরিবেশ। হয়তো ঐ নৃত্যরত বন্ধু বা অন্য কোনো ছেলে বন্ধুই এই ভিডিওটি করেছে। ভিডিও করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। তবে সেটা যদি এখন ঐশীকে নিয়ে দোষী প্রমাণের জন্য প্রচারিত হয় তাহলে অবশ্যই এটা অপরাধ। ভিডিওটিতে আপত্তিকর কিছুও নেই কিন্তু কারা একে হট ভিডিও হিসেবে চালু করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিল তার তো একটি না একটি কারণ রয়েছে। এইসব খুঁজে বের করাটা আইন আদালত পুলিশ বিভাগ বা সিআইডির একটা পবিত্র দায়িত্ব। মেয়েটি নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে পারে এটি খারাপ কিছু না। এখন প্রশ্ন হল জঙ্গীরা যে কারণে জঙ্গীত্বে রূপান্তরিত হয়েছে শুনতে পাই শুধুমাত্র ধর্মই নয় একটি মাদক যার নাম কেপ্টাগন তার সাহায্যেই কি মেয়েটির মধ্যে এই ভয়ানক বিকৃতি সম্পাদনে কেউ সহযোগিতা করেছিল? না হলে বাবা মাকে একসাথে এইভাবে কুপিয়ে মারাটা স্বাভাবিক নয়। যদি ঔষধের প্রভাবে এ রকম ভয়াবহ কাজ করে থাকে তাহলে দোষটি ঐশীর একার নয়। এ দোষ আমাদের যে কারো হয়ে যেতে পারে। এই দোষ হল ঐ ঔষধ কোম্পানির এবং যারা গ্রাহকের রক্তে এবং হাতে পৌছে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে তাদের।
আমার বোন সাবিনা শারমিন ঐশীর অলৌকিক মা রূপে ঐশীর প্রতি সংবেদনশীলতায় আকুল হয়ে দুটি লেখা প্রকাশ করেছে যা অসংখ্য মানুষের মধ্যে ভাইরাল রূপে ছড়িয়ে পড়ে একটা সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। আমি নিজেও ঐশীর বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছি যা জাগরনীয়া নামে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশ করেছে। ঐশীর ফাঁসির আদেশ থেকে ঐশীকে রেহাই দিয়ে মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ওকে মুক্ত করলে ঐশীও হতে পারে মানুষের মত মানুষ। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে মানুষের কল্যাণে সে হয়তো পৃথিবীর সব বৃদ্ধ বাবা মাকে ভালবাসবে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে। তাকে তো এই সুযোগ জেলখানায়ও দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
যাই হোক সাক্ষ্য প্রমাণ এবং স্বীকারোক্তির মাধ্যমে পিতামাতাকে কুপিয়ে হত্যা করার অপরাধে তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির দয়া ভিক্ষা করার অধিকার সবারই আছে। খুনীর যত বড় খুনের দায়ই হোক না কেন বিচারে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু ঐশীকে যে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দান করেছেন সম্মানিত আদালত সেই বিষয়টি রাষ্ট্রপতির দরবারে উত্থাপন করা দরকার। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি যিনি সবার প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন, নির্মলেন্দু গুণ, রাষ্ট্রপতির কাছে ঐশীর প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছেন। এই রকম আবেদনে সবার একটা ভূমিকা রাখা দরকার। আমিও রাষ্ট্রপতির কাছে ঐশী নামের এই অবুঝ শিশুকন্যাটির জন্য প্রাণভিক্ষা চাইছি। মনে হচ্ছে সে তো আমারই কন্যার মত একটি অসহায় কন্যা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা