ধর্মীয় সহিংসতা: একটি সামাজিক ক্যান্সারের নাম
প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ২২:০২
ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মিথ্যে অভিযোগে সম্প্রতি বাংলাদেশের ফরিদপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়িঘর-দোকান ভাঙচুরের সংবাদ দেখে মনে হলো, আমার দেশের সেই কোন আমল থেকে দেখে আসা বিশ্রী সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না ঘটে দিন দিন উল্টো অবনতি হচ্ছে কেন? কেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের 'অনুভূতি’র তীব্রতা এত বেশি যে সেই 'অনুভূতির' ঝাঁজটা বহন করতে হচ্ছে অন্যান্য ধর্মের মানুষ এবং নাস্তিকদের?
বাংলাদেশের এক অতি সাধারণ সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারে আমার জন্ম, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে যার পরিচয় 'সংখ্যালঘু' বলে। একটি সংখ্যালঘু পরিবারে জন্ম নেওয়া এবং সেখানে জীবনের ২৬ বছর অতিবাহিত করার সুবাদে তাদের দুঃখ, বেদনা, হতাশার প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার খুব কাছ থেকে দেখা। ১৯৯২ সালের দাঙ্গার স্মৃতি এখনও আমার দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে ফিরে আসে। ছোটো একটা এলাকা, যার তিন দিকের প্রবেশপথে হিংস্র জানোয়ারের মতো চিৎকার করে এগিয়ে আসছে কিছু দানব, আর আমার মা, জেঠিমারা আমাদের সাথে নিয়ে, কোলের শিশুদের নিয়ে ওই ক্ষুদ্র এলাকার মধ্যেই ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো ছুটোছুটি করছেন। ভারতের মুসলিমরাও কি ভুলতে পারেন গুজরাট দাঙ্গার ইতিহাস? অথবা গরুর মাংস খাওয়ার 'অপরাধে' পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যা এবং ধর্ষণ? বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কি জীবনে কখনো ভুলতে পারবেন ১৯৯০, ১৯৯২ এর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা? বা সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া রামু, নাসিরনগরের ঘটনা? ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার ধুয়ো তুলে হত্যা এবং লুটতরাজ?
ধর্মীয় সহিংসতার অন্যতম বলির পাঁঠা হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যে দেশে যে ধর্মীয় শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ, দেখা যায়, তারাই তাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধর্মীয় সহিংসতা চালাচ্ছে। তাই বলে কি সব দেশেই সবকালে সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটে? উত্তরটা হলো, না। ধর্মীয় সহিংসতার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করা হয় যেসব দেশে, মূলত সেসব দেশেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।
পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক Brian J. Grim এবং Roger Finke তাদের গবেষণাপত্র "Religious Persecution in Cross-National Context: Clashing Civilizations or Regulated Religious Economies?" এ উল্লেখ করেছেন যে, যেসকল দেশে একটি মাত্র ধর্ম নিজেদের ধর্ম পালনের একচেটিয়া অধিকার পায়, এবং যেসকল ধর্মের রীতিনীতি পালনের ব্যাপারে রাষ্ট্র নাক গলায়, সেসকল দেশের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের ওপর ততো বেশি অত্যাচার চালাতে উৎসাহ পায়। আমাদের দেশের কথাই যদি ভাবি, আমাদের দেশে বছরে একবার বা দুইবার পূজা বা রথযাত্রার সময় ঢোল বা মাইক বাজানোতে মানুষের যতো চুলকানি দেখা যায়, দিনে পাঁচবার মসজিদের মাইক বাজানোতে কারো ততো আপত্তি দেখা যায় না। জুম্মার নামাজের সময় সম্পূর্ণ রাস্তা আটকে নামাজ পড়া হয় রীতিমতো যানবাহন চলাচল বন্ধ করে। ফেসবুকে কোনো হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী অথবা নাস্তিক যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম নিয়ে হাসি তামাশা করে, তবে রাষ্ট্রের শুধু টনক কেন, সম্পূর্ণ কাঠামো নড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিয়ে বলেন, তিনি মুসলিম, ইসলাম ধর্ম নিয়ে কথা বললে তার কষ্ট হয়। অথচ ইসলাম ধর্মের আলেম, হুজুররা যখন ওয়াজ করেন, তখন তারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম নিয়ে নানারকম কুকথা বলে থাকেন, নারীদের বাইরে কাজ করা নিয়ে অশ্লীল কথা বলেন, এবং নাস্তিকদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেন। আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি যে সনাতন বা খ্রিস্ট ধর্ম নিয়ে কুকথা বলার জন্য, বা নাস্তিকদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়ার জন্য এসব হুজুর বা আলেমদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এভাবে বাংলাদেশে একটি ধর্মকে সকল ধর্মের ওপরে মনোপলি দেওয়ার মাধ্যমে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে বহুদিন ধরেই। আজ আমরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে নৃশংস রূপ দেখতে পাচ্ছি, সেটা বহুদিন ধরে চলে আসা এসব একচোখো নীতিরই বাই-প্রোডাক্ট। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সেই একই গবেষকবৃন্দ কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশিত তাদের "The price of Freedom Denied-Religious Persecution and Conflict in the 21st Century" নামক একটি বইতে উল্লেখ করেছেন যে, যেসব সমাজ এবং রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা যতো বেশি, সেখানে ধর্মীয় সহিংসতা ততোই কম। ধর্মীয় স্বাধীনতা বলতে কিন্তু শুধু ধর্ম পালনের স্বাধীনতাই বোঝায় না। যার ইচ্ছে হবে না, সে ধর্ম পালনও করবে না, এটাও ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। কিন্তু এ স্বাধীনতা কি বাংলাদেশ আছে? মনে হয় নেই। এদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে শুধু সংখ্যাগুরুরা। যারা ধর্ম পালন করে না, তাদের চলতে হয় কল্লা বাঁচিয়ে। আর ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালন করতে হয় নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে। প্রতি বছর মূর্তি ভাঙা, মন্দির পোড়ানো এসব তো কমন ব্যাপার। তাছাড়া সংখ্যালঘুর ধর্মীয় আচরণ পালনের ক্ষেত্রে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় আচার পালনের সাথে সংঘাত হয়, সেক্ষেত্রে স্যাক্রিফাইস করতে হয় সংখ্যালঘুকেই। পূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ঢোল বাজানো হলেও সে সময় যদি আযানের সময় হয়, তবে পূজার ঢোল বাজানোটাই সেসময় বন্ধ রাখতে হয়। নাহলে সাম্প্রদায়িক হামলার হুমকিধামকি ফ্রি তে পাওয়া যায়। এরকম একটি দেশে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আশাই বা করি কিভাবে?
একটি দেশ শুধুমাত্র তখনই ধর্মীয় সহিংসতার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে পারে যদি তার রাষ্ট্র এবং সরকারের আচরণ হয় সকল ধর্মের প্রতি সমান এবং নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র এবং সরকার যদি কোনো একটি ধর্মের পক্ষ নিয়ে সেই ধর্মের পিঠ বাঁচানোর জন্য সকল প্রকার রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে সেই রাষ্ট্রে ধর্মীয় সহিংসতা এবং সংখ্যাগুরু কর্তৃক সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। এই কথারই প্রতিধ্বনি দেখা যায় Edward Luttwak রচিত "Kofi’s Rule- Humanitarian Intervention and Neocolonilism" নামক গবেষণাপত্রে। যেখানে তিনি সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান সহ অন্যান্য আরও বেশ কিছু দেশের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। বাংলাদেশও সরকারের ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের দিক দিয়ে বর্তমানে একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ৫৭ ধারার প্রয়োগের কথা, যা শুধুমাত্র ইসলাম অবমাননার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। যেহেতু সরকার প্রধানের পক্ষপাতিত্ব শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি, তাই ইসলাম অবমাননা হলেই তার টনক নড়ে। অবমাননাকারী গ্রেফতার হয়। কিন্তু অন্য ধর্মের অবমাননার ব্যাপারটা যদি বিবেচনা করা হতো, বা সরকারপ্রধান যদি পক্ষপাতিত্বহীন হতেন, তবে হয়তো এতদিনে বাংলাদেশের জেলখানাগুলো হুজুর, আলেম এবং খতিবে ভরে যেতো। কারণ জুম্মার নামাজের খুতবা এবং ওয়াজের সময় যেভাবে সনাতন, খ্রিস্ট এবং ইহুদী ধর্মের অবমাননা করা হয়, এরকম তীব্রভাবে ধর্মের অবমাননা সম্ভবত ৫৭ ধারায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিবর্গও কখনও করেন নি।
সরকারের ধর্ম সম্পর্কে পক্ষপাতিত্বের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে সাম্প্রতিককালে সৌদি অনুদানে বিপুল সংখ্যক মসজিদ স্থাপন এবং খতিবদের প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের সমপরিমাণ বেতন প্রদানের বিষয়টি। যে দেশে গবেষণায় অনুদান দেওয়ার মতো ফান্ড নেই, ল্যাব প্রতিষ্ঠা করার মতো অর্থও নেই, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য গৌরি সেন আছে, সেই দেশ উন্নয়নের পথে তো এগিয়ে যাবেই, তবে সামনের দিকে নয়, পেছনের দিকে, এই যা।
ধর্মীয় সহিংসতার জন্য উপরোক্তভাবে উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, তাতে সার এবং পানি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার মহীরুহ তৈরি করে মুখে মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বুলি তোতাপাখির মতো বলে যাওয়াটা গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আমরা যেহেতু দলান্ধ, দলকানা ভেড়ার পাল, কাজেই আসুন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার “সরকারী প্রচেষ্টার” গুণগান করি। “বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলে কিছু নেই” একথা যারা বলে তাদের 'দেশদ্রোহী' বলে ধিক্কার দেই।
এতে করেও যদি নিজেদের সাম্প্রদায়িকতার দগদগে ঘা-টা বিশ্বের কাছে লুকিয়ে রাখা যায়, তবে মন্দ কী?
লেখক: গবেষক