বাজাই আমার ভাঙা রেকর্ড
প্রকাশ | ০৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৪৫
আবার ভাঙা রেকর্ডটা বাজাই। এই ভাঙা রেকর্ড বাজানো ছাড়া আর কীই বা করতে পারি? (ভাঙা রেকর্ড বাজানোর অর্থ এক কথা বার বার বলা। কথাটা কোথা থেকে এসেছে, এই যুগের ছেলেমেয়েদের জানার কথা নয়। গ্রামোফোনের যুগে যে রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনা হতো, সেখানে খুব সূক্ষ্ণ খাঁজ কাটা থাকত। ঘুরতে থাকা রেকর্ডের বাইরের প্রান্তে গ্রামোফোনের পিন লাগানো মাথাটা বসিয়ে দিলে সূক্ষ্ণ খাঁজটা অনুসরণ করে গান বাজাতে বাজাতে সেটি রেকর্ডের ভেতরের প্রান্তে এসে শেষ হতো। রেকর্ড ভাঙা হলে বা সেখানে ফাটল থাকলে পিনটা একটা খাঁজে আটকে গিয়ে সেই খাঁজের অংশটুকুই বার বার বাজিয়ে যেত। তাই এক কথা বার বার বলা হলে আমরা বলি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া!)
আমি কোন ভাঙা রেকর্ড বাজানোর কথা বলছি, সেটা অনুমান করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন নয়, সেটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা। দেশে এখন ৪২টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব বিশ্ববিদ্যালয় যদি ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি করে উইকেন্ড নিতে চায়, তাহলে ৪২টি উইকেন্ড দরকার। এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার মাঝখানে ৪২টি উইকেন্ড নেই!
তারচেয়ে বড় কথা দেশের প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক উইকেন্ডে পরীক্ষা শেষ করে না, তাদের বেশ কয়েকটি উইকেন্ড দরকার হয়। তারা তাদের পছন্দের উইকেন্ডগুলো বেছে নেওয়ার পর উচ্ছ্বিষ্ট উইকেন্ডগুলো অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাগাভাগি করে নেয়। শুধু তাই নয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে প্রত্যেকটা বিভাগ আলাদা করে নিজের বিভাগের পরীক্ষা নেয়! সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হলে ছেলেমেয়েদের গাট্টি-বোচকা নিয়ে দিনের পর দিন থাকতে হয়। তারা কোথায় থাকবে, কিভাবে থাকবে, তা নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা দেখার সময়। এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া ছেলেমেয়েদের কষ্ট পাওয়ার সময়। আর এই সময়টা আমার সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হওয়ার সময়।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-পরীক্ষার এই সময়টাতে প্রতি বছরই নানা ধরনের অঘটন ঘটে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেগুলো লুকিয়ে ছাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একটা দু’টি খবর বের হয়ে যায়। সেটা নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়। তারপর সবাই সবকিছু ভুলে যায়। এবারে সর্বশেষ ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের দুটি প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজন নেই, একেবারে খুবই সাধারণ মানুষের চোখে পড়লেও তারা বলে দিতে পারত যে, এরকম প্রশ্ন ঠিক নয়। এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন, এক ধর্মকে বড় করে দেখিয়ে অন্য ধর্মকে খাটো করে দেখানোর প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্ন দুটো কারও চোখে পড়েনি। যেকোনও পরীক্ষার প্রশ্ন কখনও একজনে করেন না, বেশ কয়েকজনের একটা কমিটি প্রশ্নগুলো প্রস্তুত করেন। কাজেই সেই কমিটির সব উগ্র সাম্প্রদায়িক হবে তার সম্ভাবনা কম। কমিটির কারও না কারও চোখে পড়ার কথা। কমিটির সদস্যদের কারোই চোখে পড়েনি দেখে অনুমান করা যায় সদস্যদের কেউই সম্ভবত প্রশ্নগুলো পড়ে দেখেননি। তাই কেউই হয়ত জানতেন না সদস্যদের কোনও একজন এ রকম একটা প্রশ্ন ঢুকিয়ে রেখেছেন। ভর্তিপরীক্ষা মানেই হেলাফেলা, যেনতেনভাবে কিছু গাইড বই থেকে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে ফেলা। সেইসব প্রশ্ন এত নিম্নমানের হয় যে, মাঝে মাঝে মনে হয় পরীক্ষা না নিয়ে লটারি করে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্য বেছে নিলেও হয়ত তাদের প্রতি বেশি সুবিচার করা হয়। হাইকোর্ট থেকে একবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রক্রিয়া করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলাম সেই পরীক্ষার প্রত্যেকটা প্রশ্ন গাইড বই থেকে নেওয়া। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এ রকম ঘটনা ঘটে তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই ব্যাপার কেন ঘটবে না?
কাজেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভর্তি পরীক্ষায় আমরা চরমভাবে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন দেখতে পেয়েছি। অনেকেই হয়ত অবাক হয়েছেন, আমি মোটেও অবাক হইনি। ভর্তি পরীক্ষায় এই ধরনের ব্যাপার সব সময়েই ঘটে যাচ্ছে, আগে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি, এইবারে যে কোনও কারণেই হোক এটা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামাচ্ছে।
এবারে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে তা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। আমি ডেইলি স্টারে পড়েছি তারা ভোর রাতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়েছে। পরের দিন সেই প্রশ্নগুলো ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে সব মিলে গেছে। এটা সংবাদপত্রের খবরের মাঝে ভুল বা মিথ্যা হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্ন ফাঁসের এর থেকে অকাট্য প্রমাণ আর কী হতে পারে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যি পুরোটা অস্বীকার করে রেকর্ড সময়ের ভেতর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ফেলেছে। এ রকম অবস্থায় এটি হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। একবার ফল প্রকাশ করে ফেললে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। ফলে যাদের নাম চলে আসবে এখন তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অন্য সবার সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও আমরা সবাই জানি, আসলে সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস করার সঙ্গে জতিড় থাকার ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম উঠে এসেছে, কাউকে কাউকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা চরম ঘোলাটে অবস্থা!
ভর্তি পরীক্ষার ফলে ভালো ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্ন যারা পেয়ে গেছে তারাও চলে এসেছে। আমি যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কাজকর্মগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন দেখেছি কেউ যদি এক নম্বর বেশি পেত সে ত্রিশজনকে ডিঙ্গিয়ে সামনে চলে আসত। কাজেই যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে তারা অন্য সব ছেলেমেয়েকে ডিঙ্গিয়ে অনেক সামনে এসে গেছে। তারাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হবে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের প্রশ্নগুলো দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষায় একটি অনেক বড় অমানবিক ঘটনা ঘটেছে। জেনেও তারা দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করেনি, তারা দুর্বৃত্তদের অন্যায় করতে দিয়েছে। এর চাইতে হতাশার ব্যাপার আর কী হতে পারে?
মাত্র অল্প কিছুদিন আগে আমি ভর্তি পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক এরকম একটি মেয়ের কাল্পনিক একটা গল্প লিখেছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাওয়ার সময় রাতের বাস পথে দেরি করার জন্য মেয়েটি সময়মতো পৌঁছতে পারেনি বলে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারেনি। আমরা সবাই দেখেছি এরকম ঘটনা এখন মোটেও কাল্পনিক ঘটনা নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছে। শত শত ছেলেমেয়ে পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে সময়মতো পরীক্ষার হলে হাজির হতে পারেনি বলে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারেনি। একজন ছাত্র বা ছাত্রী সমস্ত জীবন দিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যখন পরীক্ষাটি দিতে পারে না তখন তাদের কাছে কী পুরো জীবনটিই একটা অর্থহীন বিষয় মনে হয় না?
যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতো, তাহলে এর কোনোটিই কিন্তু ঘটত না। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যদি একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করতো, তাহলে সেটি হতো একটি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নপত্র, মোটেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার প্রশ্ন নয়। সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি সেই প্রশ্নপত্র ছাপাতো, সংরক্ষণ করতো, বিতরণ করতো তাহলে সেটি কখনই ফাঁস হয়ে যেতো না। যদি সবাই মিলে একসঙ্গে ভর্তিপরীক্ষা নিতো তাহলে সবাই নিজের এলাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতো, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হতো না। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে দেরি করে পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়ে পরীক্ষা দিতে না পারার ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যটি মেনে নিতে হতো না।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই কেন আমি বুঝতে পারি না। আমি সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে যিনি সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন করেছেন তাকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে না সেটি হাইকোর্ট জানতে চেয়েছেন। চারুকলা বিভাগের এই সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি পরীক্ষা নেওয়া। আমি বহুদিন থেকে অপেক্ষা করে আছি কখন হাইকোর্ট সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানতে চাইবেন, কেন সবাই মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এই দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর চরম অমানবিক নির্যাতন বন্ধ করছে না?
ছয় সাত বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একবার একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তখন আমাকে অনুরোধ করেছিল দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কিভাবে নেওয়া যায়, তার ওপর একটা বক্তব্য দিতে। আমি গাধা টাইপের মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে বক্তব্য রেখেছিলাম। সব ভাইস চ্যান্সেলরের সেই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়াটির কথা আমি কোনও দিন ভুলব না এবং সোজা ভাষায় বলে দেওয়া যায়, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, এই দেশের অসহায় ছেলেমেয়েদের জন্য কারও মনে বিন্দুমাত্র মায়া নেই। তাদের পীড়ন করে কোনোভাবে কিছু বাড়তি টাকা আয় করা ছাড়া আর কারও মনে অন্য কোনও ইচ্ছা নেই!
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি অবশ্যি এর থেকেও জটিল। যেহেতু কেউই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হতে চাইছে না, তাই তখন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের আগ্রহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পাটি ও গণতন্ত্রী পার্টি এরকম বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মিলে সেই পরীক্ষাটি বন্ধ করার আয়োজন করেছিল। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এক শ’ বছরপূর্তি উপলক্ষে যখন বামপন্থী দলগুলো সারাদেশে সভা-সমিতি করছে তখন তাদের আমার খুবই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় একেবারে নিজের ঘরে ছেলেমেয়েদের সাহায্য করার এই বিপ্লবটিকে তারা কেন গলাটিপে হত্যা করেছিলেন?
একবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। সেই আলোচনায় সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। সেই বক্তব্য শুনে আমি খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু দেখা গেল যে তারপর আর কিছুই হয়নি!
আমি একেবারে সত্যিকারভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম যখন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং চ্যান্সেলর সব ভাইস চ্যান্সেলরকে একটি সভায় সম্মিলিতভাবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে দেশের ছেলেমেয়েদের কষ্ট লাঘব করার অনুরোধ করেছিলেন। আমি যেটুকু জানি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধ দেশের আইনের মতো, সবাইকে এটি মানতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে! তারা রাষ্ট্রপতির অনুরোধ রক্ষা করেননি! আমার খুবই আশাভঙ্গ হয়েছে যখন এই বছর দেখতে পেয়েছি আবার প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিতে শুরু করেছে!
কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সভায় বক্তব্য রাখার সময় আমি ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অনুরোধ করে এসেছি যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধটি রক্ষা করে তারা যেন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটি উদ্যোগ নেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান তার বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদের জানালেন প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে এবং খবরের কাগজে সে সম্পর্কে খবর ছাপা হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি যে এটি ক্রমান্বয়ে কার্যকর করা হবে।
আমি ন্যাড়া এবং আমি বহুবার বেলতলা গিয়েছি, কাজেই আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ‘ক্রমান্বয়ে’ কার্যকর করার বিষয় নয়, এটি ‘একেবারে’ সবাইকে নিয়ে কার্যকর করতে হবে। যদি সেটি না করা হয় এবং কিছু প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থেকে যায় তাহলে তাদের উদাহরণ দেখিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে। আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য শুধু বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন, কাজেই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক নির্লোভ সাধুসন্ত হয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সেটা মনে করার কোনও কারণ নেই। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজি করাতে হবে জোর করে। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই!
আরও একটি বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়, যেটি দেখে আমি বুঝতে পারি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি অনেকেই এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। সেই কথাটি হচ্ছে, ‘গুচ্ছ পদ্ধতি’! অর্থাৎ এক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ তৈরি করা হবে এবং তারা মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নেবে।
যে বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পারেন না, সেটি হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ছাত্রছাত্রীদের কৃষি বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না! ছাত্রছাত্রীরা এখনও ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ হয়নি, তারা মাত্র এইচএসসি পাস করা ছাত্র—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান এসব বিষয় পড়ে আসা ছাত্র। কাজেই তাদের যাচাই করার জন্য আসলে তারা যে সব বিষয় পড়ে এসেছে—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান—এসব বিষয়েই পরীক্ষা নিতে হবে! কাজেই গুচ্ছ তৈরি করে সেই গুচ্ছের জন্য আলাদা পরীক্ষা নিতে হবে সেটা কে বলেছে? সবাই মিলে একই পরীক্ষায় একই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে। কোনও বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশেষ কোনও বিষয়ে বেশি জোর দিতে চায় সেটি তারা করতেই পারে, তার জন্য আলাদাভাবে পরীক্ষা নিতে হবে না।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটা অনেক বড় ইতিবাচক দিক আছে, যেটা অনেকেই জানে না। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নেয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর ‘বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং’ নামে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের নির্যাতন হয় সেটিও চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ছাত্রছাত্রীরাও প্রথমবার খানিকটা সময় পাবে নিজের জীবনকে উপভোগ করার জন্য, মা-বাবার অনেক টাকা বেঁচে যাবে তাদের ছেলেমেয়েদের আর ভর্তি কোচিং করাতে হবে না বলে।
আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি দেখার জন্য কী হয়। ভর্তি পরীক্ষার চলমান এই নির্যাতন শেষ হওয়ার পর সত্যিই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়, আমি তাহলে আশায় বুক বাঁধার জন্য প্রস্তুত হব।
যদি কিছুই না হয়, তাহলে আবার শুরু করব ভাঙা রেকর্ডটি বাজিয়ে যাওয়ার জন্য।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, শাবিপ্রবি