এক পুরুষবিদ্বেষীর জবানবন্দী (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রকাশ | ০২ নভেম্বর ২০১৭, ০০:২২
এবারে আসি কিভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারনাগুলো প্রত্যেক পুরুষের মাঝে বিদ্যমান থাকে, সে বিষয়ে। নারীর মধ্যেও থাকে, কিন্তু অনেক সংখ্যক নারীরা কিন্তু এই ধ্যানধারনাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েক দশক ধরে। কিন্তু কোনো পুরুষকেই নিজের ভেতরের এই পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বার বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখিনি, তা থেকে বেরিয়ে আসতেও দেখিনি। অশিক্ষিত পুরুষদের ছেড়েই দিলাম। শিক্ষিত, মুক্তমনা, উদার, প্রগতিশীল, সেক্যুলার পুরুষটির মধ্যেও দেখিনি। সমস্যাটা সে জায়গায়।
চলুন দেখা যাক কিভাবে -
ক) আপনি বিয়ে করলেন। মেয়েটিও আপনাকে বিয়ে করলো। বিয়ের পর মেয়েটি তার টাইটেল বদলালো। আপনি উৎসাহ দিলেন অথবা দিলেন না। কিন্তু আটকালেন না। কেন? কারন আপনার ঐ সত্ত্বাটি বলছে, স্বামীর নামেই মেয়েদের পরিচয়। আপনি হিন্দু হলে, আপনার বউ সিঁদুর দিলো, ইদানিং কেউ কেউ সিঁদুর না দিলেও শাখা পলাটি ঠিকই পরছেন। এবারেও আপনি বাধা দিলেন না। বেশী ভালো হলে, বললেন, "তোমার যা খুশী পরো" কিন্তু বাধা দিলেন না। কেন? আপনার ঐ সত্ত্বাটি মনে মনে ঠিকই বলছে, স্বামী অমূল্য ধন, তার আয়ু রক্ষার্থে তোমাকে এসব পরতে হবে বৈকি। ওদিকে স্ত্রীর আয়ু রক্ষার দায় স্বামীর নেই। কারন পুরুষতন্ত্র এটা শেখায়নি। দ্বিতীয়ত, তুমি যে একজনের অধীনে আছ, সেটা তোমাকে পুরো পৃথিবীর সামনে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেখাতে হবে।
খ) আপনি বাবা হয়েছেন, আপনার একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে আছে। প্রথমত ধরুন খেলনার কথা। আপনার ছেলেটিকে আপনি বন্দুক, ব্যাটবল কিনে দিচ্ছেন, মেয়েটিকে বার্বি ডল, রান্নাবাটি ইত্যাদি। কেন মেয়েটিকে পুতুল, বন্দুক বা ব্যাটবল কেন নয়? কারন অসচেতন ভাবে হলেও আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা আপনাকে বলছে, মেয়েদের খেলনা পুতুল, রান্নাবাটি। বড় হয়ে মেয়েটি সংসার করবে, বাচ্চা লালন পালন করবে। এখন থেকেই তাই প্রস্তুতি।
গ) বন্দুক বা ব্যাটবল বা ফুটবল পেয়ে আপনার ছেলেটি বাইরে খেলতে যেতে চাইলে আপনি আটকাবেন না। ঠিক সেভাবে আপনার মেয়েটি যদি, বাইরে মাঠে খেলতে যায়, আপনি কিন্তু তাকে যেতে দেবেন না। কেন যেতে দেবেন না?? এখানেও অসচেতনভাবে হলেও আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা আপনাকে বলছে, মেয়েদের মাঠে খেলতে নেই, মাঠে ছেলেরা খেলে। মেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে নেই, ঘরের বাইরে ছেলেরা যায়।
ঘ) এবারে আসি পোশাকে। আপনার ছেলেটিকে আপনি প্যান্ট-শার্ট, টি শার্ট কিনে দিচ্ছেন, মেয়েটিকে জামা, চুড়িদার, স্কার্ট ইত্যাদি। এখানে কিন্তু বাচ্চারা নিজে ঠিক করতে পারে তার পোশাক, তাই আপনিই ওর পছন্দটা ঠিক করে দিচ্ছেন। এখন যদি প্রশ্ন করি মেয়েটিকে জামা না দিয়ে প্যান্ট-শার্ট, টিশার্ট, কেন নয়?? এগুলোও তো পোশাক। এখানেও কিন্তু আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা কাজ করছে। আপনি ভেবেই নিচ্ছেন আপনার মেয়ে যেহেতু মেয়ে, তাই ওর পোশাক জামা। প্যান্টশার্ট ছেলেদের পোশাক। এই পছন্দ কিন্তু আপনার শিশুটি করছে না বরং আপনি তার উপর আপনার পছন্দ চাপিয়ে দিচ্ছেন। আপনার ছোটোবেলায় আপনার উপরও এভাবে চাপানো হয়েছিলো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এভাবেই যুগ যুগ ধরে ঠিক করে আসছে, একটা ছেলে কি পরবে, একটা মেয়ে কি পরবে, কি আচরণ করবে! এবং আপনি, আমার আপনার বাবা, ভাই কেউই এই বোধের ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি।
ঙ) সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার পরে যদি আপনার ছেলে বাড়ি ফিরে, অথবা স্যারের বাড়ী থেকে সন্ধ্যের পর একা ফিরে, আপনার ততোটা টেনশন হয় না, যতটা আপনার মেয়ে সন্ধ্যের পর বাড়ী ফিরলে হয়। ছেলেটিকে সন্ধ্যের পর স্যারের বাড়ী থেকে আনতে না গেলেও, মেয়েটিকে আনতে আপনি, বা আপনার বড় ছেলে, নিদেনপক্ষে মেয়েটির ছোটো ভাইটাকেই পাঠাবেন আনতে। কেন? তার কারন, আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বাটি জানে, মেয়েদের একা বাড়ীর বাইরে চলাফেরা করতে নেই, কারন মেয়েরা দুর্বল, শক্তি কম। দ্বিতীয়ত, আপনি ভাবেন আপনার মেয়ে বাইরে গেলে তাকে শকুনের মতো ছিঁড়ে খাবে আপনারই স্বজাতিরা, তাই তার নিরাপত্তার জন্য আপনি একজন পুরুষমানুষকে পাঠাচ্ছেন, যে মেয়েটিকে নিরাপদে বাড়ী নিয়ে আসবে। কারন আপনি ভাবেন পুরুষ শক্তিমান। তাই আরেক পুরুষের সাথে লড়াই করে সেই মেয়েটিকে নিরাপদে আনতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি বলছেন সবাই সমান নয়, কিন্তু বাইরের এই খারাপ পুরুষেরাই অন্য আরেকটি ঘরের 'ভালো' পুরুষ, বাবা, দাদা, ভাই নয় কি?
চ) যৌবনের শুরুতে আপনার ছেলে সিগারেট খাওয়া শুরু করলে, সেটা আপনার কাছে তেমন ম্যাটার করে না, ছেলেরা তো ওমন একটু আধটু খাবেই, কিন্তু আপনার মেয়েটি যদি সিগারেট ধরে, তবে তো আপনার পৃথিবী শেষ। মেয়েটিকে বকবেন, মারবেন, বাইরে যাওয়া বন্ধ করবেন। রাস্তায় আপনার বন্ধু আপনার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে সেটাও আপনি ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না, কিন্তু কোনো মেয়ে আপনার সামনে সিগারেট খেলে, মেয়েটির চলাফেরা, চরিত্র, পারিবারিক শিক্ষা সম্পর্কে আপনি সন্দিহান হয়ে উঠবেন! কেন? কারন এখানেও আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা বলছে, মেয়েদের সিগারেট খেতে নেই, সিগারেট খাওয়া ছেলেদের জন্মগত অধিকার। ছেলেদের দিকে পুরুষতন্ত্র কখনো চোখ পিটপিট করে তাকায় না! আপনি জানেন সেটা। আচ্ছা, সিগারেট খাওয়া যদি খারাপ হয় , তবে তো সেটা ছেলে-মেয়ে দুজনের জন্য খারাপ। শাস্তি হলে দুজনেরই হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি সেটা করেন না। এটাও আপনি জানেন। ঠিক একই কথা মদ খাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ছ) আপনি, আপনার স্ত্রী দুজনেই চাকরী করেন। আপনার স্ত্রীকে সকালে উঠে রান্না, চা, জলখাবার সব বানিয়ে বেরোতে হয়। রাতে এসেও সেই একই। কিন্তু আপনি এগিয়ে এসে বলছেন না, "ঠিক আছে সকালে আমি রান্না করবো, রাতে তুমি। কেন বলছেন না?? কারন আবারো আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বাটি কানে কানে বলছে, রান্না করা মেয়েদের কাজ। ঘর সামলানো মেয়েদের কাজ। হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলবেন আপনি মাঝে মাঝেই রান্না করেন। কিন্তু রান্না করাটা আপনার শখ না হয়ে দায়িত্ব হচ্ছে না কেন?? আপনি হয়তো এটাও বলতে পারেন, আমার বউ ভালোবেসে এসব কাজ করে। খুশী মনে এসব করে। আচ্ছা ভালোবাসা কি একমুখী?
জ) আপনি ভালো পুরুষ। আধুনিক। নারীর এগিয়ে যাওয়াতে বিশ্বাসী। বন্ধুমহলে, পারিবারিক আড্ডায় আপনি বললেন, "আমি আমার বউকে বিয়ের পরও পড়তে দিয়েছি, অথবা চাকরী করতে দিয়েছি, অথবা অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি" ইত্যাদি প্রভৃতি। যদি বলি এসব আপনার বউয়ের জন্মগত অধিকার, আপনি দেওয়ার কে? আপনি রেগে নোংরা নারীবাদী বলে তেড়ে আসবেন। কেন জানেন?? কারন আবারো পুরুষতন্ত্র। আপনার মনের গভীরে গাঁথা হয়ে আছে, বিয়ের পর নারীর গার্জিয়ান তো স্বামীই। সেই ঠিক করবে বউ কি করবে না করবে!!
ঝ) সম্পত্তিতে বোনও সমান অংশীদার। কিন্তু সম্পত্তি ভাগের সময় বোনকে সমান অংশ দেওয়া হয় না। আপনি শিক্ষিত, আধুনিক, মুক্তমনা। কিন্তু আপনিও দিচ্ছেন না। কেন?? কারন আবার সেই পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা কাজ করছে। বোন তো পরের ঘরে যাবে। সেখানে পাবে আরো অর্ধেক। মেয়েরা তো সমান অংশের দাবীদার হতে পারে না। সেকথা মরিয়া হয়ে বোঝাতে আপনি ধর্মের আইন আনবেন, রাষ্ট্রের আইন আনবেন। কিন্তু একবারো এটা বুঝতে চাইবেন না, আইন, নিয়ম তো মানুষের সৃষ্টি। এগুলো বদলানো যায়, এমেন্ড করা যায়। সতীদাহ প্রথা বা বিধবা বিবাহ, এগুলোও কিন্তু বদলানো হয়েছিলো, সামাজিক সমতার প্রয়োজনে।
ঞ) আপনি মেয়ের বাবা। মেয়ের বিয়ে দেবেন। মেয়ে যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না কেন, খাট, আলমারি, গয়না, টাকা পয়সা ইত্যাদি দিয়ে মেয়েকে পরের ঘরে পাঠালেন। আবার ছেলের বিয়ের সময় কিন্তু এসব কিছুই বউয়ের ঘরে পাঠালেন না। কেন? এখানেও অসচেতনভাবে হলেও আপনার পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বাটি কাজ করছে। মেয়ে পিতার বোঝা। তাকে সোনা গয়না এসব দিয়ে পার করাতে হয়। মেয়েদের শিক্ষার কোনো দাম নেই। স্বামীর ঘরে তার দাম বাড়াতে তাই দামী খাট, আসবাব, সোনা। ছেলেরা হীরের আংটি। ছেলের বউ হয়ে আসা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই ছেলের বিয়েতে ছেলের বউয়ের বাড়ী এসব কিছুই পাঠাতে হয় না। অসচেতন ভাবে হলেও আপনি মানেন, ছেলেরা বিয়ে করে, আর মেয়েদের বিয়ে হয়!
ট) মেয়ের বাবা আপনি। মেয়ের বিয়ে কোনো অবস্থাতেই বেকার ছেলের সাথে দেবেন না। মেয়েটির প্রেমিক যদি বেকার হয়, এই সম্পর্কে আপনি কখনোই রাজি হবেন না। মেয়েটি যদি চাকরি করে, তাও না। কেন?? এখানেও ঐ পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা। শিক্ষিত, নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী আপনিও মনে মনে ভাবেন, মেয়েদের ভরনপোষণের দায়িত্ব ছেলেটির। ছেলেকে আবার মেয়ে চাকরি করে কেন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে!! ছি ছি এ আবার হয় নাকি!!
(চলবে...)
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট