আমি কেন বলি
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:১০ | আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৫৯
অনেকেই আমাকে বলেন আমার লেখাগুলো তাদের ভালো লাগে কিন্তু 'লাইক' দিতে দ্বিধা বোধ করেন কারণ লেখাগুলো একটু বেশি খোলামেলা। বিশ্বাস করুন, যতটুকু খোলামেলা হওয়া প্রয়োজন আমার লেখাগুলো আসলে ততটা খোলামেলা নয়।
আমি জানি আপনারা কোন লেখাগুলোর কথা বলেন। যৌন নির্যাতন বিষয়ে লেখা পোস্টগুলোতে কিছু বর্ণনা, কিছু শব্দ আপনাদেরকে বিব্রত করে। এসব ঘটনা যে এই পৃথিবীতে ঘটে, যে পৃথিবীকে আপনারা একটা ফুলেল বিছানা ভাবতে ভালোবাসেন, সেটাই কি আপনাদের বিব্রত বোধ করার আসল কারণ?
আমি কেন এসব লিখি? না, অসুস্থ মনের মানুষদেরকে যৌন সুড়সুড়ি দিতে নয়, স্টান্টবাজি দেখাতে নয়, নিজের কষ্ট হালকা করতেও নয়। আমার মনে কোনো ভার নেই যা আমাকে হালকা করতে হবে। নির্যাতিত হয়েছি নানানভাবে কিন্তু নির্যাতকে পরিণত হইনি। যে পৃথিবী আমার দিকে বস্তা বস্তা কয়লা ছুঁড়ে দিয়েছে, তার বুকে ফুলের বাগান সাজিয়েছি আমি, আমাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছি, সেই হিসাবে আমি যথার্থই একজন সফল মানুষ।
কিন্তু পথে হেঁটে যেতে যেতে যত শিশুদের দেখি, তারা সবাই কি একটা সুন্দর শৈশব বাঁচতে পারছে? যারা পারছে না, তারা কি আমার মত অক্ষত অবস্থায় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌঁছুতে পারবে? আমি জানি না। পৃথিবীর প্রতিটি অরক্ষিত শিশুর জন্য ভাবি আমি, আমার রাতের ঘুম হারাম হয়, আমার সুখের জীবন বারবার থমকে যায়।
আমার জীবনে যৌন নির্যাতনের মাত্রা বা সময় খুব বেশি তীব্র বা দীর্ঘ ছিল না। একটু বড় হতে না হতেই আমি নিজেকে বাঁচানোর বিভিন্ন কৌশল শিখে গিয়েছিলাম। আরেকটু বড় হবার পর থেকে আমার চলাফেরা, কথাবার্তা, নিজেকে ধারণ করার কায়দার মধ্যে একটা লালবাতি ইফেক্ট ছিল যা থেকে নির্যাতক মাত্রেই বুঝে নিত, এখানে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা, তারা আমাকে ঘাঁটাতো না। হতে পারে তখন জীবনে নতুন ধরনের নির্যাতনের সূত্রপাত হয়েছে, কিন্তু যৌন নির্যাতনের সমাপ্তি ঘটেছে ঠিকই।
স্কুলের শেষের বছরগুলোতে এবং কলেজ জীবনের শুরুতে আমার ভূমিকা ছিল রক্ষকের। সহপাঠীদের সাথে কেউ অশোভন আচরণ করলে তারা আমার মুখাপেক্ষী হতো, আমি সাহসের সাথে যে কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে লড়তাম। কলেজে একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন যিনি ক্লাসে সুন্দরী মেয়েদের দাঁড় করিয়ে খোলামেলা ভাবেই মৌখিক নির্যাতন করতেন। অন্য মেয়েরা যখন ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে যেতো, আমি তখন সরবে প্রতিবাদ করতাম। আশির দশকের শেষের দিকে বা নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে সিলেট মহিলা কলেজে যারা পড়েছেন তারা জানেন আমি কার কথা বলছি।
এই সময়ে বিয়ে হয়ে আমি বিলেতে চলে আসি। তখনো যৌন নির্যাতন নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলার সাহস গড়ে ওঠেনি কিন্তু এসব বিষয়ে ভাবনা ছিল অনেক। ছেলেরাও যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তখনো জানতাম না। দেশে ফেলে আসা ছোট ছোট ভাইঝি-বোনঝিদের কথা ভাবতাম সবসময়। তাদের জীবনে কি আমার মত তিক্ত সব অভিজ্ঞতা ঘটে যাচ্ছে? তারাও কি আমার মত কাউকে বলতে পারছে না? তাদের মায়েরা কি জানেন এসব হয়? তারা কি নিজেদের মেয়েদেরকে রক্ষা করতে পারছেন? অনুত্তরিত এসব প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে রাখত।
নিজে মা হবার পর এই বিষয়ে আমি সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করেছি। নিজের বাচ্চাদেরকে খুব ছোট বয়স থেকে এসব বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করেছি ফলে আমার বাচ্চাদেরকে এধরনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। কিন্তু যেসব বাচ্চাদের বেড়ে ওঠায় আমার কোনো হাত নেই তাদের জীবনে কী ঘটছে, একথা সবসময় ভেবেছি। ট্রেনে, বাসে, পার্কে, রাস্তায় কোনো পুরুষের কোলে একটা বাচ্চাকে দেখলেই আমি অনধিকার চর্চা করেছি। তাকিয়ে থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে কি না। এ দিক থেকে আমি একটা অস্বাভাবিক জীবন বেঁচেছি এবং বাঁচছি বলতে পারেন।
এক সময় আমার মনে হয়েছে যেসব মানুষদের নিজেদের জীবনে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি তারা হয়তো এই বিষয়টা জানেই না, তারা হয়তো তাদের সন্তানদের রক্ষা করার কথা ভাববেই না। আমি একটা 'পেরেন্ট'স হ্যান্ডবুক' লেখার কথা ভেবেছি। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছে নয় বছর ধরে লেখা আমার প্রথম ইংরেজি উপন্যাস 'মিনারা'জ মিরর' যা এখনো প্রকাশিত হয়নি।
যৌন নির্যাতন যে মাত্রারই হোক না কেন, একজন মানুষের মনে, ব্যক্তিত্বে তা একটা ভয়াবহ প্রভাব রেখে যেতে পারে। একটা ছোট, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ইররেলেভেন্ট, উদাহরণ দেই। ধরুন, কেউ ঠিক করলো আপনাকে একটা কিছু খাওয়াবে- চকলেট, বিস্কিট, অথবা মিষ্টি। আপনি খেতে চান না, আপনি বারবার না করছেন, আপনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। কিন্তু আপনার আপত্তি বা অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে সে জোর করে আপনার গালটা চেপে ধরে খাবারটা আপনার মুখে ঠেসে দিল। কেমন লাগবে আপনার? কতটুকু অপমানিত বোধ করবেন, ভেবে দেখুন। যৌন নির্যাতন এর চেয়ে সহস্র গুণে বেশি অপমানকর।
আমি এবং আমার মত আরো অনেকে এসব অনেক দূরে, অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। অনেকে এসব নিয়ে তোলপাড় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু আমার মত অনেকে আবার নীরব না থাকতে বদ্ধ পরিকর, কারণ এই অপমানের যন্ত্রণা যে কত ভয়াবহ তা জানি বলেই আমরা চাই পৃথিবীতে যেন এসব ঘটনা আর না ঘটে।
ফেসবুকে, বা অনলাইন পত্রিকায় সাহস করে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের ঘোষণার প্রয়োজনটা কী? এতে কার লাভ হচ্ছে? কেন একের পর এক লিখে যাচ্ছি? এজন্যই যে, আমার মনে ক্ষীণ আশা এসব পড়ে মা-বাবারা তাদের বাচ্চাদের ব্যাপারে সচেতন হবেন। যারা এখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা আশেপাশের কাউকে বলার সাহস সঞ্চয় করবেন। হয়তো বা কোথাও কেউ একজন উপকৃত হবে।
নারী হিসেবে লজ্জাকে নিজের ভূষণ হিসেবে অনেক আগেই পরিত্যাগ করেছি আমি। লজ্জা নামক অনুভূতিটিকে ভিন্ন একটা বিভাগে ট্রান্সফার করে দিয়েছি। আমি লিখে যাব এবং চেষ্টা থাকবে আরো খোলামেলাভাবে লেখবার।
লেখক: শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক