এক পুরুষবিদ্বেষীর জবানবন্দী (প্রথম পর্ব)
প্রকাশ | ০১ নভেম্বর ২০১৭, ২২:২৭ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৭, ০৯:৪২
প্রথমেই ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখা ভালো, যা দিনকাল চলছে। কে কখন কোথা থেকে কোন তকমা লাগিয়ে দেবে, জানা তো নেই !! পাকিস্থান যাওয়ার হুমকি অনেকবার পেয়ে গেছি, দেশদ্রোহী তো বাই ডিফল্ট হয়েই আছি, 'খ' বর্গীয়, 'ম' বর্গীয় তকমাগুলোও পেয়ে গেছি, ইদানিং শুনছি পুরুষবিদ্বেষী, তাই ডিসক্লেমার দিয়ে রাখা ভালো।
ডিসক্লেইমার :
ক) আমি একজন মানুষ। আপনাদের ভাষায় 'মেয়েমানুষ'। জন্মেছিও প্রত্যেকটা মানুষ যে প্রসেসের মধ্যে দিয়ে জন্মায়, সেভাবে। মেয়ে হয়েই জন্মাবো, করিমগঞ্জেই জন্মাবো, মুসলিম ঘরেই জন্মাবো, এরকম কোনো প্ল্যান করে আসিনি। বিষয়টা আমার হাতেও ছিলো না। তাই নারী, পুরুষ, ধর্ম, এগুলোকে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবেই বয়ে চলি, এরজন্যে আলাদা করে কোনো গর্ব বা বিদ্বেষ অনুভব হয় না।
খ) প্রত্যেকটা পুরুষের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবো না, কারন এই পুরুষেরই কেউ আমার বাবা, কেউ প্রেমিক, কেউ বন্ধু। কিন্তু তা বলে তাদেরকে মাথায় তুলে নাচার, বা পূজো করার মানসিকতা আমার নেই। বাবা'কে ভালোবাসি, আমার আমি হয়ে উঠার মধ্যে তার অবদান অনেক। তা বলে, আমার বাবাও যে সম্পূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান ধারনা মুক্ত একজন মানুষ, একথা একশ ভাগ জোর দিয়ে বলতে পারবো না। পরিবারের প্রধান কর্তা শুধু বাবা একথা মানতেও আমার আপত্তি আছে। কারন আমি আমার মা'কেও সমানভাবে পরিবারের কর্ত্রী ভাবি।
গ) অর্থনৈতিকভাবে আমি বাবা, প্রেমিক বা ভাই কারো উপর নির্ভরশীল নই। কখনোই ছিলাম না। তাদের টাকায় নিজের নেট রিচার্জটাও করছি না, কোনোদিন করেছি বলেও মনে পড়ছে না। আজন্ম মা'কেই চাকরী করে সংসার চালাতে দেখেছি এবং বাবাকে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণ কর্মী। এবং পড়াশুনা শেষ করে আমরা চার বোনই রোজগার করে সংসার চালাচ্ছি। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত বলতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মুক্তিই যে স্বাধীনতা এনে দেয়, একথাও একশ ভাগ মানতে আমার আপত্তি আছে।
ঘ) প্রেমিক একজন আছে (লিখতে গিয়ে গাল লাল হয়ে গেল!)। কিন্তু সেই প্রেমিকের টাকায় কোনোদিন ফুর্তি করিনি। কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও বিলের বোঝা প্রেমিকের ঘাড়ে চাপাইনি। নিজেই মিটিয়েছি। বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গেলেও বিল নিজেই মেটাই। প্রেমিক, ছেলে, সেজন্য তারই রিচার্জ করে ফোন করতে হবে, অথবা আমাকে রিচার্জ করিয়ে দিতে হবে, একথা মানতেও আত্মসম্মানে লেগেছে। বরং প্রেমিক ফোন করলে কেটে নিজের ফোন থেকে ফোন করি।
ঙ) বাসে/গাড়িতে সিট সংরক্ষণের ব্যাপারটিও মেনে নিতে পারি না। কারন নিজেকে কানা, খোঁড়া, বিকলাঙ্গ, বয়স্ক কিছুই মনে হয় না। গাড়ীতে অন্যান্য সহযাত্রীরা যেভাবে যান, সেভাবেই যাই। কখনো অটোর সামনে বসে, কখনো গাড়ীর পেছনের সিটে বসে, মানে বলতে চাইছি যখন যেভাবে সিট পাই, যাই। চাকরীও নিজ যোগ্যতায় পেয়েছি। আজ অব্দি মেয়ে হওয়ার সুবাদে জীবনের কোনো ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো সুবিধা নিয়েছি বলে মনে করতে পারছি না।
চ) ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, গালাগালির মধ্যে কারা যেন আমাকে নারীবাদী বলছিলেন। তাদের বলে রাখি, আমাকে কেউ নারীবাদী বললে সেটাকে আমি গালি হিসেবে নেই না। বরং বিনয়ে অবনত হয়ে যাই, কারণ এ আমার কাছে বিরাট সম্মানের ব্যাপার, আর যদ্দূর জানি, সে সম্মানের যোগ্য এখনো পুরোপুরি হয়ে ওঠতে পারিনি। আমি নারীবাদকে এখনো পুরোপুরি পড়ে ওঠতে পারিনি, তাই এ বিষয়ে বেশী কিছু বলতেও পারবো না। তবে এটুকু জানি, পৃথিবীকে অনেক ভালো জায়গা বানাবার ক্ষমতা রাখে নারীবাদের আদর্শ।
এবারে আসি আসল কথায়। "সব পুরুষ সমান নয়" এই ফ্রেজটা সত্যি নয়, একথা আমি এই অর্থে বলিনি যে সব পুরুষ ই 'ধর্ষক', 'যৌনহেনস্থাকারী', 'খারাপ', 'নিপীড়ক'। সব পুরুষ ধর্ষক নয়, এটা আমিও জানি, আপনিও জানেন। আমার বাবা, প্রেমিক, বন্ধু এদেরকেও কখনো ধর্ষণ, যৌনহেনস্তা করতে দেখিনি। আসলে এই কথা বলে আমি বোঝাতে চেয়েছি প্রত্যেকজন পুরুষের মধ্যেই একটা প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা, পুরুষতান্ত্রিক অহংবোধ বাস করে। কেউ সেটা দমিয়ে রাখতে পারে না, কেউ চেষ্টা করে দমিয়ে রাখার, কিন্তু সবসময় পারে না। এইদিক থেকে দেখলে, প্রত্যেকজন পুরুষই সমান। পুরুষতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা আর পুরুষ-বিদ্বেষের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। কিন্তু আপনারা অনেকেই দ্বিতীয়টির সাথে আমার কথা গুলিয়ে ফেলছেন! আপনি পুরুষ বলে আপনার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমার বিরোধ আপনার মধ্যে থাকা সেই পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বাটির সাথে।
এখন হয়তো বলবেন 'পুরুষতান্ত্রিক সত্ত্বা'টি কি? কিভাবে বুঝা যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে আসতে গেলে প্রথমে দেখতে হবে, পুরুষতন্ত্র কি? পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র যাই বলা হোক না কেন, সেটার মূল তন্ত্র হলো, পিতা বা পরিবার প্রধান কোন পুরুষের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা প্রদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ। আরো সহজ করে বললে, পুরুষতন্ত্র হচ্ছে সেই ভাবনাটি, যা বলে পুরুষরা নারীর চাইতে উত্তম। সেটি বুদ্ধিতে হতে পারে, শক্তিতে হতে পারে, অর্থনীতি বা রাজনীতি, বা যে কোন কিছুতেই। আপনারা হয়তো হুট করে বলবেন, কই আমরা তো তা ভাবি না!! কিন্তু একটি সমাজ যদি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি ভাবনার সাথে বড় হয়, অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন অবচেতন মনেই আমরা নিজেরাই অনেক কিছু ভেবে ফেলি, বা অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমরা বুঝিও না হয়তো, সেটি একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়ার কারণে আমরা এভাবে ভাবছি, বা এই কাজটি করছি।
একটা কথা ভেবে দেখুন, "শুধু মাত্র পুরুষেরা লেখাপড়া শিখবে কেন? ভোট দেবে কেন? মেয়েরা দেবে না কেন? এই সমান সুযোগটা নেই কেন?" এই ভাবনাটা বেশীরভাগ মানুষের মনে এসেছিলো বলেই কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, বিপ্লব হয়েছে, এবং তাই নারী-পুরুষ সবার লেখাপড়ার সুযোগ, ভোটাধিকার, এগুলো হয়েছে। এখন আমরা যদি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে চাই, তাহলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই খুঁজে দেখতে হবে আমরা কি কি ধ্যান ধারনা অসচেতনভাবে হলেও বহন করে চলেছি! সেগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে। একটা তন্ত্র বা সিস্টেম তো নিজে থেকে চলতে পারে না, তাকে মানুষই চালায়, তাই শুদ্ধিকরণও এই মানুষদেরই করতে হবে।
(চলবে...)
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট