আমাকে কেউ যদি জবাই করে
প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০১৬, ১৪:২১
তসলিমা নাসরিনসেদিন শুক্রবার মৃত্যুর হুমকি পেলাম আবার। আনসার খিলাফা নামে কেরালার এক আইসিসপন্থী জঙ্গি দল এই হুমকি দিয়েছে। দলের নামের সঙ্গে আইসিস আছে, আর আইসিসের ছোঁয়া থাকলে, ভয় হয়, জবাই করায় ওরা নিশ্চয়ই বিষম পারদর্শী।
আমার গলায় প্রায়ই আমি হাত বুলোই, মাথার পেছনেও হাত রেখে বুঝতে চেষ্টা করি, ঠিক কেমন বোধ হবে যখন আমার মাথায় ওরা পেছন থেকে কোপ বসাবে, বা আমাকে জবাই করবে। তার চেয়ে হয়তো মাথা লক্ষ করে গুলি করাই ভালো। সারা জীবন কষ্ট করেছি, মৃত্যুর সময় আর কষ্ট চাই না। ঘটনাটা দ্রুত ঘটে যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমি চাইলেই কি আমার কথা শুনবে? আমি ওদের অনুরোধ করবো, হাতে পায়ে ধরবো— এই দৃশ্য আমি কল্পনা করতে পারি না। আমার বরং ভাবা উচিত যদি জবাই-ই করে, তাহলে যন্ত্রণাটা আমি চোখ বুজে প্রিয় কিছু রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করবো। জানি না ওভাবে কোনও যন্ত্রণা লাঘব হয় কি না, কিন্তু আর তো কোনও উপায় নেই।
আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম ঢাকা ক্যাফের ওই উনিশ কুড়ি বছরের ছেলেমেয়েগুলো কী করছিল যখন ওদের জবাই করা হচ্ছিল। ওরা কি বাঁচার চেষ্টা করছিল, চিৎকার করছিল, অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চাইছিল? আমি জানি না কেন এতগুলো লোক ক্যাফের ভেতরে থাকার পরও ৬/৭ টি ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি, পরাস্ত করতে পারেনি! হয়তো ভেবেছিল ওদের বাঁচাতে উদ্ধারকর্মী আসবে, পুলিশ আসবে, আর্মি আসবে। ওরা হয়তো অপেক্ষা করছিল। আমিও যদি অপেক্ষা করি কারোর জন্য, যে আমাকে খুনিদের থাবা থেকে উদ্ধার করবে, তাহলে কেমন বোধ করবো অপেক্ষার মিনিটগুলো, ঘন্টাগুলো? ছ'ঘন্টাগুলো, বারো ঘন্টাগুলো? আমার সামনে দিয়ে খুনিরা পিস্তল বন্দুক চাপাতি ছুরি হাতে হাঁটতে থাকবে আর আমি অপেক্ষা করতে থাকবো। যে কোনও সময় আমার মাথায় ওরা কোপ বসাতে পারে, গুলি করতে পারে, ওর মধ্যে বসে আমি অপেক্ষা করতে থাকবো! ভাবলেই হাতপা ঠাণ্ঠা হয়ে যায়।, গলা শুকোতে থাকে। ঢাকা ক্যাফে প্রায় বারো ঘণ্টা কেটে গেলো, কেউ উদ্ধার করতে আসেনি। যাদের উদ্ধার করার কথা, তারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, কেন খামোকা দাঁড়িয়েছিল জানি না। তিন ঘণ্টা পার হওয়ার পর দেশের এক টেলিভিশনে তারিসি জেইন -এর বাবা কথা বলছিলেন, উদ্বিগ্ন, বলছিলেন, তার কন্যা ওই ক্যাফের ভেতরে। তিনিও বুঝতে পারেন নি, কেন এখনও উদ্ধার কাজ শুরু হচ্ছে না। যাদের উদ্ধার করার কথা, তারা যদি সত্যিই জানতো কী করে উদ্ধারকাজ চালাতে হয়, এবং কখন চালাতে হয়, তাহলে অনেকগুলো প্রাণ বাঁচত।
ফারাজ হোসেনের কথা ভাবছিলাম, ওকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু ও বন্ধুদের না নিয়ে ক্যাফে থেকে বেরোতে চায়নি। বন্ধুদের মুক্তিও চেয়েছিল, কিন্তু বন্ধুরা মুক্তি পায়নি বলে নিজে সে একার জন্য মুক্তি নেয়নি। আমি যে এত দরদি, দিন-রাত মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবি, জীবন বলতে গেলে উৎসর্গই করেছি এ কাজে, সেই আমিও, আমি ঠিক বুঝি, যদি এক পাল খুনি আমাকে বলে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যেতে, তবে আমি ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে ঠিক ঠিক বেরিয়ে যাবো, পেছনে না তাকিয়ে যাবো, পালাবো আমি, কারও জন্য অপেক্ষা না করেই পালাবো। সবাই পালাবে। ফারাজই পালায়নি। ফারাজরা সহস্র বছরে বোধ হয় একবার জন্মায়।
জঙ্গিরা যা চেয়েছিল, তাই পেয়েছে। বিশ্ব কাঁপাতে চেয়েছিল, কাঁপিয়েছে। অমুসলমানদের খুন করে পুণ্যি কামাতে চেয়েছিল, সম্ভবত তাও কামিয়েছে। এতগুলো মানুষকে অল্প বয়সী ছেলেগুলো কী করে পারলো জবাই করতে! ওরা তো আগে কখনও জবাই করেনি। তাহলে কী করে একজন দু'জনকে নয়, কুড়ি জনকে পারলো জবাই করতে! সত্যি কথা কী, বিশ্বাস মানুষকে দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব কাজ করিয়ে নিতে পারে। জঙ্গিগুলোর মগজধোলাই কে বা কারা করেছে আমার জানা নেই, তবে যে তথ্যই তাদের মস্তিস্কে ঢোকানো হয়েছে, তারা তা কোনও প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করেছে। অনেকটা চেচনিয়ার দুই বোস্টন বোমারু ভাইয়ের মতো। দেখতে স্মার্ট, কিন্তু যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা নেই। অ বলতে আসলে অ বোঝানো হয়নি, ভ বোঝানো হয়েছে --- এই চালাকি করে প্রাচীনকে যুগোপযুগি করার চেষ্টা করেনি। অবিশ্বাসীদের মারো বললে অবিশ্বাসীদের মারো-ই বুঝেছে, অন্য কিছু বোঝেনি।
সন্ত্রাসীরা বেশ অনেক কাল হলো নাস্তিক, সেক্যুলার, যুক্তিবাদি লেখক ব্লগার, সমকামী, প্রগতিশীল ছাত্র শিক্ষক, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানকে কুপিয়ে মারছে, কোনও মৃত্যুতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেননি। কাউকে গ্রেফতার করেন নি। কাউকে শাস্তি দেননি। উল্টো শাস্তি দিয়েছেন নাস্তিক ব্লগারদের, ধরে ধরে ওদের জেলে পুরেছেন। কথা বলেছেন মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে। আইন বানিয়েছেন মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে। মুক্তচিন্তকদের হত্যার জন্য মুক্তচিন্তকদেরই দায়ী করেছেন। আজ ঢাকা ক্যাফের মৃতদের জন্য হঠাৎ তার শোক প্রকাশের সাধ কেন হলো? নিশ্চয় বড় কোনও রাজনীতি আছে এর পেছনে। ঢাকা ক্যাফেয় সেদিন যাদের কুপিয়ে মারা হয়েছে, তারা ধনী এবং প্রভাবশালী লোকের সন্তান- এ কারণে? অথবা শহরে সন্ত্রাসী হামলার পর হাসিনা এখন কী করছেন না করছেন দুনিয়া দেখছে বলে!
রাজনীতিকরাই হিপোক্রেট, ধর্মের যেটুকু মানলে সুবিধে হয় শুধু সেটুকু মানবো, বাকিটুকু মানবো না –এই মানসিকতার মুসলামগুলোই হিপোক্রেট। বরং ওই জঙ্গিগুলোই হিপোক্রেট ছিল না। তাদের মাথায় যা ঢোকানো হয়েছে, তাই তারা কলের পুতুলের মতো আওড়েছে। নিজের জীবনের মায়াটুকু করেনি, মরবে জেনেই এসেছিলো সেরাতে, বেহেস্তে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেছে। কেউ তাদের বুঝিয়েছে, বলেছে, শিখিয়েছে, যে অমুসলিমদের খুন করলে জিহাদের সওয়াব পাওয়া যায়, সর্বোচ্চ বেহেস্তে জায়গা হয়। বিদেশিদের কুপিয়ে মেরে, বর্বরতার চূড়ান্ত করে, সকাল হলে দেশি মুসলমানদের বলেছে -- ‘আমরা এখানে শুধু অমুসলিমদের মারতে এসেছি। তোমাদের মারবো না। তোমরা সবাই চলে যেতে পারো। আমরা তো বেহেস্তে যাচ্ছি’।
সন্ত্রাসীদের মেরে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায় না। সন্ত্রাসের উৎসকে নির্মূল করলেই সন্ত্রাস নির্মূল হয়।
লেখক: নারীবাদী লেখক
প্রথম প্রকাশ: বাংলাট্রিবিউন