একজন পুরুষতান্ত্রিক নারী এবং করণীয়
প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০১৭, ১১:১৭
একজন শোষিত নারী শোষণের স্বরূপ বুঝতে না পেরে জীবনের কোন এক সময় শোষিত হন এবং কোন এক সময় শোষণ করা শুরু করেন। স্পষ্ট করে বললে ভাইবোনের মধ্যে ভাইদের অগ্রাধিকার দেখে বড় হওয়া, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ি কতৃক নির্যাতিত, এবং নিজে শাশুড়ি হবার পরে নির্যাতকের ভূমিকায় এসে অট্ট হাসি হাসা নারীটি জানেন না তাকে পুরুষতন্ত্র কীভাবে নিজেদের এজেন্ট বানিয়ে ফেলেছেন। এরা শুধু জানেন ছোট বেলায় ভাইদের অগ্রাধিকার মেনে নিলে পরিবারে কোন অশান্তি হবে না, বাবা মা ভালো মেয়ে বলবে। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে শাশুড়ির একটু আধটু আদুরেঅত্যাচার (এই ছোট খাট অত্যাচারের মধ্যে বাচ্চা ডেলিভারির তারিখে সকালবেলায় বিশাল এক বালতি কাপড় ধোয়ানোও আছে। শাশুড়ি ভাষায় - কাপড় ধোয়া শেষ করে দুপুরের ভাত রান্না করে এরপরে বাচ্চা বিয়াও। যেন চাইলেই নরমাল বাচ্চা খুব সহজে বের করে ফেলা যায়) সহ্য করলে ভালো বউ হওয়া যাবে। আর নিজে যখন শাশুড়ি হবেন তখন তো নিজের ভূমিকায় অত্যাচারের শোধ তোলা যাবেই।
নির্যাতিত হবার পরে কেন মানুষ একই নির্যাতকের ভূমিকা নেয় এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম এক বন্ধুকে। আড্ডায় র্যাগিং নিয়ে ওঠা কথা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, “আমি র্যাগ খাইলে র্যাগ দেবই। না খাইলে দেব না” আমি বাধা দেবার চেষ্টা করে বললাম, “তাহলে তো সেই একই সাইকেলের অন্তর্ভুক্ত তুমি হয়েই গেলে। ভূমিকা তো নির্যাতকের।” সে আর কথা বাড়াল না।
যাই হোক ফিরে আসি নির্যাতন-নির্যাতক প্রসঙ্গে। এই নারীগুলো নিজেরা ভালো মেয়ে হয়ে থাকা কিংবা ধর্মানুসারে স্বর্গের লোভে এই নির্যাতন সহ্য করে থাকেন। নির্যাতিত মেয়েরা খুব ভালোভাবেই জানেন তাদের জীবনটা খুব সম্মানীয় নয়। কিন্তু খানিকটা পারিপার্শ্বিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে তারা এই ভূমিকায় কাজ করে থাকেন।
এদের ভাবনা হল - ছেলেরা সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের চেয়ে উন্নত। ছেলেরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে মেয়েদের চেয়ে বেশি বোঝে। ছেলেরা ভবিষ্যতে মা-বাবার দায়িত্ব নেয় এজন্যে তারা মেয়েদের চেয়ে বেশি ভালো। ছেলেরা একটু আধটু বদমায়েশি করতেই পারে, এটা মেয়েদের সহ্য করতে হবে। পুরুষ মানুষেরা টাকা কামিয়ে আনে তাই সংসারে এদের একটু বেশি যত্ন নিতে হবে। রাতের বেলায় শারীরিক সম্পর্কে তাদের অনেক কষ্ট করতে হয় এজন্যে একটু বেশি যত্ন নেয়া আবশ্যক।
উপমহাদেশীয় সাংস্কৃতিক অভিধান শাবানা ধরনের মেয়ে দেখতে অভ্যস্ত। আশাপূর্ণা দেবীর ত্রয়ী - প্রথম প্রতিশ্রুতি, সুবর্ণলতা, বকুল কথার নায়িকাদের দেখলে সত্যবতী মানুষ হিসেবে দুর্দান্ত হতে পারলেও মা হিসেবে পারেন নি। তার চারপাশ তাকে সেই সুবিধা দেয় নি। সুবর্ণলতাকে আমার ভালো লাগে নি সর্বংসহা মানসিকতার জন্যে। বকুলকে ভালো লেগেছে জীবনের প্রতি তার দর্শক-দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে। বকুলকে আমি শ্রদ্ধা করি, অনেক ক্ষেত্রে অনুসরণও করি।
কথা হল এই তিনটি চরিত্রের কেউই পুরুষতান্ত্রিক নয়। কিন্তু তবুও কোন কোন ক্ষেত্রে সহ্য করে যাওয়াই অত্যাচারকে বাড়তে দেয়ার নিয়ামক। এজন্যে সুবর্ণকে আমার কাছে অত্যাচারী মনে হয়েছে।
ফিরে আসি পুরুষতান্ত্রিক নারী প্রসঙ্গে। এই নারী কখনো ভালো মা হতে পারেন না। তিনি নিজে বড় হয়েছেন ভাইকে বেশি সুবিধা দেয়া পরিবেশে। লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে সমান মনোবৃত্তি তার গড়ে ওঠে নি। মেয়ের ব্যাপারে হয় তিনি উদাস হবেন অথবা খুব সচেতন হবার পরেও তিনি ঐ ‘বিয়ে দিলে মেয়ে তো পর’ নীতি মিনে লালন করে মেয়ে বড় করবেন। মেয়ে যদি খুব দায়িত্বশীল হয়েও বেড়ে ওঠেন তবুও মেয়ের যত্ন নিয়ে তিনি মনে মনে লালন করবেন, “ছেলেই ভালো”।
এই মতাদর্শের নারীর মতামতে আমার কোন শ্রদ্ধা নেই, অশ্রদ্ধাও নেই। তাদের যা ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে তারা তাই ভেবেছেন। তারা জীবনের কোন এক সময়ে এসে বুঝেছেন, “শাড়ি আর গয়না দিয়া ভুলায়া রাখছে” (গয়নার বাক্স দ্রষ্টব্য) তবুও তারা এই অসম্মানজনক জায়গা থেকে উত্তরণের কোন পথ বেছে নেন নি। তারা তাদের মেয়েদের জন্যে কোন ভালো দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন না। তবুও সমাজের এই প্রচলিত অংশটাকে আমরা বাদ দিয়ে এগোতে পারি না।
এখন আসি মেয়েদের করনীয় প্রসঙ্গে। একজন নারী হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক এই নারীগুলোর কাছ থেকে মূল্যায়ন পাওয়ার আশা তোমাকে ত্যাগ করতে হবে মেয়ে। খুব ছোটবেলায় কিংবা বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে এসে যদি দেখো ভালো স্কুল কলেজে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির বিষয়ে অনার্স শেষ করার পরেও তোমার মা সেই ‘বিয়ে দিলেই মেয়ে পর’ নীতিতে আছেন তবে বলব নিজের জীবনকে নিজের হাতে গড়তে শেখ। মূল্যায়ন না পেলেই কাউকে অবমূল্যায়ন করতে হবে কিংবা মূল্যায়ন না পেলেই তোমার সংগ্রাম ব্যর্থ তা কিন্তু নয়। তাই পারিবারিক মূল্যবোধের বাইরেও তোমার একান্ত মূল্যবোধের জায়গাটুকুকে মূল্য দিতে হবে তোমাকেই। যেহেতু তুমি পরিবার থেকে কোন সমর্থন পাচ্ছ না নিজের ভাবনাকে বিকশিত করতে তার বাস্তবায়নের জায়গা খুঁজে বের করতে হবে তোমাকেই।
ক্লাস টেনে পড়া অবস্থায় আমার এক গণিত শিক্ষক শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা শুরু করলে আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি ব্যথিত হয়ে বললেন, “তুমি আমাকে পুরুষ মনে করছ মিম্মা? আমি তো তোমার শিক্ষক। শিক্ষকের কোন লিঙ্গ হয়? এর চাইতে বড় কথা আমি তো একজন মানুষ। এরপরে আসবে আমার লিঙ্গ। তুমি আগেই যদি দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে বসে থাকো তাহলে সিকোয়েন্স কেমন গোলমেলে হয়ে গেল না?” স্যার এর কথা থেকে আমি জীবনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনেছিলাম। এক - শিক্ষকের কোন লিঙ্গ হয় না, দুই - একজন মানুষ প্রথমে মানুষ এরপরে আসবে তার লিঙ্গ। এই মহামূল্যবান দুটো জিনিস বাচ্চাকালে ব্যাখ্যা করার জন্যে আমার জীবনের সেরা শিক্ষকদের মধ্যে তিনি একজন।
তাই তোমাকেও বলব আগে তুমি মানুষ। এরপরে মেয়ে। মানবিক গুণে সমৃদ্ধ না হতে পারলে মানব জন্ম ব্যর্থ।
প্রচন্ড দরকারি একটা কথা মাথায় রেখ - শোন, শোন এবং শোনার চর্চা করো। বাজে কিছু না, কারো পরনিন্দা না, গিবত না। ভালো কিছু - ভালো গান, ভালো কবিতা। ইউটিউব ঘাটলেই তুমি সব পাবে। সেখান থেকে বাছাই করে নাও। কারও প্রশংসা কর উদার ভাবে। দ্বিমুখী মানুষ এড়িয়ে চলো কারণ এরা ছোবল দিতে বিশেষ পারদর্শী। সঙ্গী খোঁজা খুব কঠিন কাজ। তবুও খুঁজতে খুঁজতে মাঝ রাতে প্রাণ খুলে আড্ডা দেবার মত অনেককেই পেয়ে যাবে। নিজবোধে উন্নত হতে পারলে মানুষের কিছু দরকার হয় না আর। নিজের বোধে স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে আমার পৃথিবীর অভিবাদন নিও। নিজস্বতার গন্ধ আমার খুব প্রিয় তাই ভালোবাসা নিয়ে বলছি শোন, “জগতের আনন্দযজ্ঞে তোমায় নিমন্ত্রণ”!
সংগ্রামী ভালোবাসা সবার জন্যে। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক!
লেখক: জাবি শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী