কথায় কথায় নারীকে দোষারোপ করা বন্ধ করুন
প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৪৩
ছোট একটা কথা বলেই রেখে দিই। কাজও আছে, আর আমার প্রিয়তমা স্ত্রী বিদেশে যাওয়ার আগে কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমি যেন কারো ধর্মীয় ব্যাপারে নাক না গলাই। হোক সেটা মুসলিমদের হিন্দুদের বা বৌদ্ধদের- যার যার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে, প্রথা আছে, নিয়ম আছে, নীতি আছে, কানুন আছে। ওরা ওদের মতো চলবে, নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে, নিজেদের নিয়মে বিবাদ মীমাংসা করবে। তোমার কি? ছেড়ে দাও। আমি একটু মিন মিন করে বলতে চাইলাম, না মানে একজন বড় ভান্তে এক নারীর গৃহে ছিলেন বলে..., তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন। তুমি কি বৌদ্ধ? তুমি তো বল যে তুমি নাকি নাস্তিক, নাস্তিক হইলে নাস্তিকের মতো থাক, ধার্মিকরা ওদের নিজেদের বিষয় নিয়ে কি করে না করে তাতে তোমার কি?
কথা তো তিনি ঠিকই বলেছেন। এই কথার তো আর জবাব নাই। সুতরাং আমি ধর্মতিষ্য থেরোর জীবনে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে কিছু বলবো না। এটা নিয়ে বৌদ্ধরা তর্ক করছেন, আলাপ আলোচনা করছেন, করতে থাকুন ওরা। আমার তাতে কিছু আসে যায় কিনা জানিনা- কিন্তু কিছু বলবো না। কেননা আমার প্রিয়তমা স্ত্রী নিষেধ করেছেন। আমি তথাগতের পঞ্চশীলের দুই একটা শীল ভঙ্গ করতে পারি, কিন্তু আমার ভগবতী জেনিফা ম্যাডামের কাছে নেওয়া একটা শীলও ভঙ্গ করার ক্ষমতা আমার নাই। সুতরাং সেই বিষয়ে বাদ।
কিন্তু আপনারা যে নারীটিকে এইভাবে স্ক্যান্ডালাইজ করছেন, গালাগালি করছেন এটা ঠিক না। এই কাজটার আমি প্রতিবাদ করবো। ধর্মতিষ্য ভান্তে এই নারীর গৃহে বাস করেছেন কিনা, নারীটির সাথে তাঁর কি সম্পর্ক, তিনি অরহত্ব লাভ করেছেন কিনা এইসব নিয়ে আপনারা আলোচনা করেন। স্বর্গপুরি ভান্তে আর ভান্তে থাকছেন কিনা, সংঘ কর্তৃক তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেওয়া হবে কিনা সেগুলি ওদের নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু নারীটিকে আপনারা গালাগালি করবেন কেন?
লোকে যে সন্দেহ করছে, ধর্মতিষ্য থেরোর সাথে নারীটির সম্পর্ক নিয়ে, সেটি যাই হোক না কেন- প্রণয় হোক বা সাময়িক ভালোলাগালাগি বা যাই কিছু হোক, সেটি হয়েছে দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে। সম্পর্কটা যদি আপনি নিন্দনীয় মনে করেন, তাইলে নিন্দা দুইজনকেই করবেন। সম্পর্কটা যদি অপরাধজনক হয়, তাইলে শাস্তি দুইজনেরই হবে। মেয়েটা একলা কি অপরাধ করেছে যে আপনারা তার পূর্বের সব বিবাহ ইত্যাদি তুলে গালাগালি করে তাঁর গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছেন? সে যদি আগে চারটা বিবাহ করে বা চৌদ্দটা বা চল্লিশটা বিবাহও করে থাকেন তাতে আপনার কি?
শোনেন, এই যে শুধু নারীকে দোষ দেওয়া- বড়লোকের পোলা রাত্রিবেলা কাজের মেয়েকে চেপে ধরে আর কাজের মেয়ে যদি চিৎকার করে ওঠে তাইলে হয় মেয়েটার দোষ, মাগী তুই আমার পোলার মাথাটা খাইছিস- এই কুঅভ্যাস বাদ দেন। কথায় কথায় নারীর দোষ দিবেন। এতোবড় ভান্তে, অনেকে বলে তিনি অরহত হয়ে গেছেন, স্বর্গপুরি নামে ডাকেন সকলে, যাদুর মতো দেশনা ডান করেন, ওর সামেন মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। তিনি চাইলে মানুষজন নিজের সর্বস্ব দান করে দেয়, নারীরা গায়ের গহনা খুলে দিয়ে আসে- এইরকম তাঁর ক্ষমতা। তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একটি সামান্য শ্রমজীবী নারী ইয়ে করে ফেলেছে? বুলশিট।
নারী সম্পর্কে আমাদের ভান্তেরা এমনিতেও খুব ভালো কথা বলেন না। একজন বনভান্তের কথা আমি জানি- তিনি নাকি বলতেন যে বণের বাঘ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, বনের বাঘে খেলে কেবল তোমার মাংস খাবে, কিন্তু লম্বা চুলওয়ালা এই যে বাঘ- নারী- নারী যদি তোমাকে খায় তাইলে তোমার আর মুক্তি নাই। সুতরাং আপনারা যে চট করে নারীকে গালাগালি শুরু করবেন তাতে অবাক হচ্ছি না। তবুও অনুরোধ করি, জোড় হাত করে অনুরোধ করি, চট করে নারীটিকে গালাগালি করবেন না।
একজন নারী আর একজন পুরুষ পরস্পরের সম্মতিক্রমে যাই করুক না কেন তাতে দোষের কিছু নাই। তাতে লজ্জার কিছু নাই। আর তাতে সচি আপনাদের নিয়ম ভঙ্গ হয়- হোক সেটা ধর্মীয় বিধান বা পিনাল কোডের বিধান, সেটার জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য সেটা দেন। ক্ষমতা আছে, শাস্তি দিবেন, দেন। দুইজনকেই দিবেন। শুধু নারীটিকে গালি দিবেন আর আমি এটা সহ্য করবো- সেটি হবে না। আমি নিন্দা করবো আর নিন্দা করবো আর আপনার বিরুদ্ধে ধুরে দিব ক্রোধ আর ঘৃণা।
কেন? কেননা আমি আনন্দ। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু সিদ্ধার্থকে আমার বন্ধু মানি আর আমিই আনন্দ। কেন, তোমরা কি জাননা আনন্দ কি বলেছিল যখন মহাপ্রজাপতি গৌতমি এসেছিলেন সিদ্ধার্থের কাছে সংঘে যোগ দিবেন বলে? তোমরা কি ভুলে গেছ যে সিদ্ধার্থ প্রথম নারীদেরকে গ্রহণ করতে চাননি সংঘের ভিক্ষুণী হিসেবে? তোমদের কি জানা নাই যে এরপর মহাপ্রজাপতি গৌতমি প্রাসাদ ত্যাগ করে মাথায় কেশ মুণ্ডন করে রংবস্ত্র পরিধান করে উপস্থিত হয়েছিলেন সিদ্ধার্থের কাছে? সিদ্ধার্থ কি মহাপ্রজাপতি গৌতমিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন ভিক্ষুণী হিসাবে? না।
আনন্দ সেদিন তথাগত বুদ্ধের কাছে নিবেদন করেছেন, তথাগতের সাথে তর্ক করেছেন। পুরুষ যদি ভিক্ষু হতে পারে নারী কেন নয়? যে নারী চিরতরে তাঁর গৃহ ত্যাগ করে মাথা মুণ্ডন করে চীবর পরিধান করে হাজির হয়েছেন সংঘে যোগ দিবেন বলে, কেন তিনি ভিক্ষুণী হতে পারবেন না? আনন্দ সেদিন নারীর পক্ষে বলেছিল, আনন্দের যুক্তিতে কেবল মহাপ্রজাপতি গৌতমিই নন, অন্য সকল নারীরাও ভিক্ষু হয়েছিলেন। মনে রাখবেন, আমিই আনন্দ- আমার সামনে আপনি নারীকে গালি দিবেন আর নারীকে কথায় কথায় বেশ্যা বলে দুশ্চরিত্রা বলে যাদুকরী কুহকী বলে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করবেন আর আমি চুপচাপ সহ্য করবো?
না, আমার ক্ষমতা থাকলে আমি আপনার পেছনে এমন লাথি মারবো যে মুখ থুবড়ে পড়বেন, পারলে সেই জিহ্বাটা কেটে নিব যে জিহ্বা নারীকে এইসব কথা বলে ছোট করতে চায়। সে তো আর পারবো না, অন্তত আপনাদের মুখে তো ঘৃণার থুথু ছড়িয়ে দিতে পারি আরকি।
লেখক: আইনজীবী