লোকসঙ্গীতে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব
প্রকাশ | ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ২২:৩৬
‘বাংলা ভাষা ও শব্দে পুরুষতান্ত্রিকতার চরম প্রভাব’ এই আর্টিকেলটি লেখার পর থেকেই ‘লোকসঙ্গীতে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব’ নামে একটি লেখা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু যথেষ্ট পড়াশুনা না থাকায়, তথ্য না থাকায় লেখাটায় হাত দিতে পারছিলাম না। পড়ুয়া বন্ধুদের সহযোগিতা চেয়ে কিছু বইয়ের লিস্ট পেলাম যা থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হলো। একটা লেখা তৈরি করার আগে তার কাঁচামাল যথেষ্ট না হলে লেখাটা শক্তিশালী হয় না, তথ্যবহুল হয় না, বিভ্রান্তি থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আমরা বাস করছি ক্রম-অগ্রসরমান এক বিশাল সামাজিক রূপান্তরের যুগে। সমাজের সর্বস্তরে আমরা প্রত্যক্ষ করছি অস্থির মানস আর ক্রমবর্ধমান চঞ্চলতা, সুগভীর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে সুনিশ্চিত ঝোঁকের প্রকাশ। বহু প্রশ্নের মধ্যে! তা নিয়ে আলোচনাও চলছে, পরিসরও বাড়ছে আলোচনার। এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি হলো নারী-প্রশ্ন, বারবার যা সামনে আসছে। যাকে এড়িয়ে গিয়ে, পাশ কাটিয়ে গিয়ে সমাজের কোনো অগ্রগতি করা সম্ভব নয়। অথচ, নারীদেরকে সর্বজায়গায় হেয় প্রতিপন্ন করে রাখার পাঁয়তারা অব্যাহত রয়েছে।
তা হলেও নারী-প্রশ্ন আমাদের বিশেষ বিবেচনা দাবি করে। প্রাচীন সমাজে নারীর অবস্থান কি ছিল, আজ তার অবস্থান কোথায় এবং ভবিষ্যতের সমাজে তা কি হবে, এসবই মানবজাতির অন্তত অর্ধেকের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আসলেই এসব প্রশ্ন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেননা জনসংখ্যার এক বিপুল অংশই নারী। প্রধানত নারীর অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞতা, এমনকি নারীদের নিজেদের মধ্যেও এমন ধারণা যে তারা পুরুষের চেয়ে কম পারদর্শী, সব কাজে নারীদের যেতে নেই, নারীরা পুরুষের অধস্তন, দ্বারস্থ। অনেক পণ্ডিতমহাশয়রাও বলে থাকেন, নারী প্রশ্ন বলে আদৌ কিছু নেই, যেহেতু নারীর অবস্থান সব সময় একই রকম ছিল এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে, কেননা প্রকৃতিই তার নিয়তিকে স্ত্রী ও মা হিসেবে এবং তার কাজকর্মকে বাড়ির মাঝে সীমাবদ্ধ করে নির্ধারিত করে দিয়েছে। বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে এবং তার গৃহকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কহীন সকল কিছুই নারীর জন্য গুরুত্বহীন।
পুরুষের চাপিয়ে দেওয়া ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী নারী পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ কখনই নয়। এ বিশ্বাস লোক সমাজে বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে অনড় অচলায়তনে রূপ নিয়েছে। তাই নারীর অবদমন ও অধস্তনতা, ‘অবলা-অর্ধেক’ মানুষ পরিচয়ের ইতিহাসও সুদীর্ঘ। যুগ-যুগান্তরের পুরুষনির্ভরতার চিত্র বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতেও প্রতিফলিত হয়েছে। নিজেকে অবলা হিসেবে মেনে নেওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে পুরুষ নির্ভরতার শিক্ষা নারী তার পিতৃগৃহ থেকেই পেতে থাকে। বিয়েতেই নারীজীবনের 'চরম সার্থকতা' সমাজ আরোপিত এ ধারণা বংশানুক্রমিক বিশ্বাস-সংস্কারের শোণিতধারায় নারীর অস্থিমজ্জায় সংক্রমিত হয়ে এক সময় তা স্থিত হয়। নারীর কাছে তাই আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মবিকাশের বদলে স্বামী প্রাপ্তি কিংবা বিয়েই হয়ে ওঠে পরমা আরাধ্য।
উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানে অবিবাহিতা নারীর আর্তি এরকম: গাছের শোবা ফলরে যেমন চিরল নাগরে জল/আমার শোবা তুমিরে বন্দু নিদানের সম্বল। নায়ের শোবা বৈঠারে বন্দু গাঙের শোবা কূল/নারীর শোবা পতিরে বন্দু অকূলের কূল। এখানে ‘নিদানের সম্বল’ ও ‘অকূলের কূল’ শব্দগুচ্ছই নারীর ‘অবলাত্বের’ প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মেয়েদের একান্ত নিজস্ব রচনা কোনো কোনো মেয়েলি গীতে হবু বধূকে বলা হয়েছে ‘দাসী’ যে দাসীকে ছেলে তার মায়ের সেবা করার জন্যই আনতে যাচ্ছে। এঁয়োরা গাইছে সখীর খায়্যারে বাছা/বউ আনতে যাও, লক্ষ্মী আনতে যাও/নারে কে। কিন্তু মা যখন ছেলেকে প্রশ্ন করে: ‘বাবা কোথায় যাও?’ ছেলের তাৎক্ষণিক জবাব: ‘তোমার জন্য দাসী আনতে।’ যেহেতু দাসী হয়েই নারীর শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ, অতঃপর শুধু শাশুড়ি সেবাই নয়, প্রধানত তাকে করতে হয় স্বামী সেবা। কারণ, স্বামী তাকে ‘কামাই’ করে খাওয়ায় সে হলো ‘কামাইসুদ’ বা ‘কামিলগর’ অর্থাৎ উপার্জনকারী: দুপুইরা রৈদ মাতায় কৈরা/ওনারে আসতাছে কামিলনগর/ নোটা খড়োম জোড়া থুইয়া/ আগে তো পাংখা বলাই কিওনাহে, দুপুইরা রৈদ মাতায় কৈরা হে।’ কিন্তু দুপুরের কড়া রোদে ঢেঁকিতে ‘বারা বানতে বানতে’ যে নারীর গতর বেয়ে দরদর ঘাম ঝরছে সেও তো প্রত্যাশ্যা করে স্বামী বা অন্য কারো সেবা: ‘অফুলা শিমলার তলে যুব্বা নারী/বারা বানে/গাও বয়া পড়ে নারীর ঘাম/ কোনজন দরদী হবে/গাওয়ের ঘাম মোচেয়া দিবে/সোনা মুকেক মোর/তুলিয়ে দিবে পান।’ কিন্তু আমাদের সমাজে যেখানে নারীর শ্রমের মূল্যই স্বীকৃত নয়, সেখানে তার মেহনতের ক্লান্তি মোচনে সেবা পাওয়ার প্রত্যাশা অবান্তর বৈকি। পুরুষ কর্তৃক নারীকে সেবা করার কোনো সমাজ মনস্কতাই তৈরি হয় নি আমাদের দেশে। তাই নারী মূলত থেকে গেছে পুরুষের সেবাদাসী।
কোনো কোনো বিয়ের গীতে কন্যাপক্ষ তথা নারীর অধস্তনতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। পাত্রপক্ষের দাপটে কন্যাপক্ষ কোণঠাসা হয়ে থাকে অনেক বিয়েতেই। এমনকি পাত্রের মা, ভাবী বা অন্য কোনো মহিলা আত্মীয় কন্যাপক্ষের অভিভাবকদের হেনস্তা করে। কন্যাকে প্রায়শই খাটো করে দেখা হয়েছে এভাবে: ‘বউর বাপের সাদ্য কিলো এ্যাতো বড় কথা কয়। বউর মার সাদ্য কিলো এ্যাতো বড় আত দ্যাহায়।’ দেখা যাচ্ছে, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে মেয়ের বাপ উঁচু গলায় কথা বলতে পারবে না। প্রকারান্তরে নারীই এখানে নারীকে খাটো করে দেখেছে। আমাদের দেশে আজও পর্যন্ত মেয়ের বাবা-মাকে পাত্রপক্ষের অনেক কটু কথা ও দুর্ব্যবহারও হজম করে নিতে হয়, পাছে তাদের মেয়ের ওপর নেমে আসে নির্যাতন কিংবা ছুতোনাতায় তালাক পর্যন্ত দিয়ে দেয়ার আশঙ্কায় তারা আতঙ্কিত হয়।
বাংলাদেশের নারীরা কোনোকালেই পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতে পারে না। বিয়ের মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে নারী তার স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারে না। এমনকি নিজের বিয়ে করার মনোবাসনার কথাও প্রকাশ করতে সে অক্ষম। কারণ, এ ধরনের ইচ্ছা অকপটে ব্যক্ত করলে তাকে নিন্দাভাজন হতে হয়।
‘বাপক না কও সরমে মুই, মাওক না কও লাজে,/ধিকি ধিকি তুষের আগুন জ্বলছে দেহার মাঝে/পেট ফাটে তাও মুখ না ফোটে লাজ শরমের ভরে/খুলিয়া কলে মনের কথা নিন্দা না করে পরে।’
নারীর বিয়ে বা যৌনবাসনাই শুধু অচরিতার্থ থাকে তা নয়, একবার পরীক্ষায় ফেল করলে এবং সে সঙ্গে যদি থাকে প্রেম করার মতো অমার্জনীয় অপরাধ তাহলে পড়াশুনাও বন্ধ হয়ে যায়। তার সহপাঠী প্রেমিক ঠিকই বিএ পাস করে আসক্ত হয় অন্য নারীতে। কিন্তু ‘অবরোধবাসিনী’র আর বি.এ. পাস করা হয় না।
‘বাপো মায়ের/ মোন হইল ব্যাজার,/মোক ইস্কুলে যাবার/না দ্যায় আর/আরো না দেয় মোক/বাড়ির বার হাতে।
তোমরা কইরলেন বিএ/পাস মোর কইরলেন সর্বনাশ/পিরিতি করিয়া ছাড়িয়া গেইলেন মোরে।’
বি.এ. পাশ করাতো দূরের কথা, মেয়েদের বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই আমাদের বৃহত্তর জনসমাজ আজও এ মানসিকতা পোষণ করে। শিক্ষাদীক্ষায়, কর্মনৈপুণ্যে, পেশাগত পরিচয়ে এ দেশের নারীর এ যাবৎকাল তেমন একটা সাফল্য অর্জিত হয় নি। তারা এখন পর্যন্ত স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হয় এবং স্বামীর সাফল্যে গর্ব অনুভব করে। স্বামীর সাফল্যই তার সাফল্য। তাই স্বামীর উন্নতিপর্বে গর্বিতা নারী বুক ফুলিয়ে বলতে পারে: ‘শোন লো মাইজান দিদি/আমার বাড়ি-আলার চাকরি হবি,/তিরিশ টাকা মায়না পাবি/দশ টাকা আমারে দিবি,/দশ টাকা পথের খরচ/দশ টাকা মালগুজারী।’ যে সমাজে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন নেই, স্বাধীন ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই, সে সমাজের একজন নারী স্বামীর উপার্জনের সামান্য অংশ লাভ করতে পেরেই আনন্দিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া বিষয়গুলো অনেক সময় প্রথা অথবা সংস্কারের মতো কাজ করে। যেমন পুরুষ যদি নারীকে যাচ্ছে-তাই ভাবে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজও করে তাতে তেমন কিছু আসে যায় না। কিন্তু নারী যদি কোনো কারণে পুরুষকে গালি দেয় তাতে যেন মাথায় বজ্রপাত ঘটে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘নীলার বারমাসী’ গানে দেখা যায়, সাউদের কুমার নীলাকে দেহসম্ভোগের প্রস্তাব দিলে নীলা কুমারকে তিরস্কার করে বলে: ‘দগড় বাজে কাঁসা বাজে/শব্দ যায় দূর/হস্তিনী নারীর পিছে/ফিরে ভোগালু কুকুর।’ সাউদের কুমারের তাৎক্ষণিক জবাব: ‘কুকুর বইলতেরে তোর মুখে নাহি লাজ/তিরী হই পুরুষ নিন্দা শিরেত পড়ে বাজ।’
এভাবে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের নারীর অধিকারহীনতা, বৈষম্য, স্বাধীন ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সীমাবদ্ধতার কারণ সমাজ-মানসের অনেক গভীরে নিহিত। যুগ যুগ ধরে প্রথা ও সংস্কারের মতো নারীর পুরুষনির্ভরতা ও বিবিধ ক্ষেত্রে তার অধস্তনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে নারী-পুরুষের অসমতা বা ‘ল্যাক অফ ইকুয়ালিটি’র শিকড় এত গভীরে প্রোথিত যে, তাকে সহজে উপরে ফেলা সম্ভব নয়। আর নয় বলেই পুরুষদের সমানাধিকার অর্জনে নারীকে আরো মূল্য দিতে আন্দোলন করতে হবে। অন্তত নারী সম্পর্কে পুরুষশাসিত সমাজ আরোপিত অযৌক্তিক ও বদ্ধমূল ধারণাগুলো লোকমানস থেকে অপসৃত না হওয়া পর্যন্ত।
বাংলাদেশে যেমন গণমানুষের স্বাধীনতা ও শোষণমুক্তির লড়াইয়ের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস; তেমনি এই রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী নারী আন্দোলন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে এখানে জন্ম নিয়েছে হাল আমলের সর্ববৃহৎ নারী আন্দোলন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে এই আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করেছে। সুতরাং, নারীকে এভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার দায় এ রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থার। আর এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে নারীসমাজকেই।
একটি ঘটনা টানছি:
উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে সর্বপ্রথম একজন পুরুষ মনীষী রাজা রামমোহন রায় হিন্দু সমাজের অচলায়তনের ভিতকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। বর্বরতম একটি কুপ্রথা সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের সঙ্কল্প নিয়ে দুর্দান্ত সাহসের সাথে তিনি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং এই প্রথা উচ্ছেদে সাফল্যও অর্জন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনিই সর্বপ্রথম অশিক্ষা ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। সনাতন হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন করে, সব ধর্মের সারবস্তু নিয়ে রাজা রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম নামে যে নতুন ধর্মটি প্রবর্তন করেছিলেন, সেই ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী সমাজ সর্বাগ্রে তার নারী শিক্ষার আহ্বানে সাড়া দেন। ব্রাহ্ম মেয়েরা দলে দলে শিক্ষা গ্রহণ করতে এগিয়ে যান এবং আধুনিক শিক্ষার আলোকে তারা আলোকিত হন। ব্রাহ্ম মেয়েরা সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন। রাজা রামমোহন রায়ের মতোই আরেক মনীষী পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিস্তার, সামাজিক কুপ্রথার অবসান, বিশেষভাবে বিধবা বিবাহ প্রচলনের পদক্ষেপ নিয়ে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে রামমোহন ও বিদ্যাসাগর এই দুই মনীষীই হিন্দু নারীদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বন্দি জীবনে প্রথম আলোর শিখাটি জ্বেলেছিলেন। তারাই ছিলেন বাংলার নারীর জাগরণের পথিকৃৎ।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলিম নারীদের অন্তঃপুরে তখনো রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্রের প্রজ্জ্বলিত আলোর শিখা তেমন প্রবেশ করতে পারে নি। মুসলিম নারী সমাজ তখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত, কঠোর অবরোধ প্রথা ও রক্ষণশীল ধর্মীয় সামাজিক অনুশাসন ও বিধিনিষেধের শক্ত বেড়াজালে বন্দি। এই অবস্থায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত মুসলিম সমাজপতিদের রক্তচক্ষু ও অন্যায় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে সামাজিক রক্ষণশীলতার অচলায়তনকে ভেঙ্গে নারী সমাজকে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন অনন্য সাধারণ মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
এই ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। নারীআন্দোলনে পুরুষ সমাজেরও যে বড় ভূমিকা রয়েছে, তা ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামের পিছনে যুথবদ্ধতার গুরুত্ব বেশি। নারীকে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য লড়তে হবে। এই লড়াইটার শিক্ষা ইতিহাসবিদরা শিখিয়েছেন। আমাদের কাজ সেই শিক্ষাকে অবলম্বন করে বর্তমান পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা।
তথ্যসূত্র: দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, ইন্টারনেট, নারী সম্পাদনা: তাহা ইয়াসিন ও অনুপ সাদি, নারী মুক্তি প্রশ্নে, নারী পাতা।
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট