পুরুষতান্ত্রিক নেটওয়ার্কে সকলেই ধর্ষক
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:০৬
যাত্রাবাড়ীতে আবার সাত বছরের শিশু জারিয়াকে ধর্ষণের পরে হত্যা! এ নিয়ে কথা বলতেও এখন লজ্জা লাগে। কি বলব! কি বললেই বা এই ধর্ষণযজ্ঞ কমবে? আমার বলাতেই বা কি আসে যায়? এসব ভেবে চুপ করে থাকি। তবুও পারি না। কিছু না বললে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়।
ফেসবুকে ভিডিওটা দেখলাম। একটা লাল বিছানা চাদরে মোড়ানো একটা ছোট্ট পুটলি। ঠিক লাল শাড়িতে মোড়ানো যেমন একটা টুকটুকে পুতুল। লোকজন খুলল চাদরটা। পিছনে দুহাত বাঁধা, পেটটা ফুলে আছে। সারা শরীর কেঁপে উঠলো আমার, চোখের সস্তা দু ফোঁটা জলও বেরিয়ে পড়লো।
ধর্ষণ নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে কিছু লিখিনি এখন পর্যন্ত।
"সকল ধর্ষকই পুরুষ, কিন্তু সকল পুরুষই ধর্ষক নয়"--এমনটাও লিখেছি ফেসবুকে। কিন্তু না, আজ আমি সকল পুরুষকেই ধর্ষক বলতে বাধ্য হলাম। বস্তুত এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই একটা ধর্ষক। যদি তাই না হবে তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়ে নিয়ে এত এত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেড়াচ্ছেন আর এই গুটিকয়েক ধর্ষককে কেন, কিভাবে সহ্য করছেন?
আসলে ধর্ষকরা গুটিকয়েক না। আপনারা সকলেই ধর্ষক। কেউ প্রত্যক্ষভাবে ধর্ষণ করে ধর্ষক, কেউ পরোক্ষভাবে ধর্ষক, কেউ ধর্ষককে সমর্থন করে ধর্ষক, কেউ ধর্ষককে জায়গা দিয়ে ধর্ষক, কেউ ধর্ষকের পক্ষের আইনজীবী হয়ে ধর্ষক, কেউ সালিশীর মাধ্যমে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে ধর্ষক, কেউ এই আইন তৈরী করে ধর্ষক, কেউ টাকার বিনিময়ে পারিবারিক মীমাংসার মাধ্যমে ধর্ষক, কেউ ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে ধর্ষক, কেউ ধর্ষকের কঠোর শাস্তির বিপক্ষে মানবতা দেখিয়ে ধর্ষক, কেউ ধর্ষকের বিরুদ্ধে একটা কথাও না বলে ধর্ষক, আমরা যারা ধর্ষণের জন্য পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতাকে দায়ী করে লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করি, পরিবর্তন চাই এই ব্যবস্থার, তাদেরকে নারীবাদী গালি দিয়ে উপহাস করে কেউ কেউ ধর্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কি ধরনের সম্পর্কের বেলায় ধর্ষণ ঘটে নাই?
কেউ নিজ বাবা হয়ে ধর্ষক, কেউ সৎ বাবা হয়ে ধর্ষক, কেউ ভাই হয়ে ধর্ষক, কেউ নিজ ছেলে হয়ে ধর্ষক (কিছুদিন আগেই ভারতে ঘটেছে এমন ঘটনা), কেউ স্বামী হয়ে ধর্ষক, কেউ স্বামীর বন্ধু হয়ে ধর্ষক, কেউ নিকট আত্মীয় হয়ে ধর্ষক, কেউ চাচা-মামা-খালু হয়ে ধর্ষক, কেউ শ্বশুড় হয়ে ধর্ষক, কেউ প্রতিবেশী হয়ে ধর্ষক, কেউ প্রেমিক হয়ে ধর্ষক, কেউ প্রেমিকের বন্ধু হয়ে ধর্ষক, শিক্ষক হয়ে ধর্ষক, ইমাম হয়ে ধর্ষক, গুরুবাবা হয়ে ধর্ষক, মালিক হয়ে ধর্ষক, চাকর হয়ে ধর্ষক, ড্রাইভার-চিকিৎসক-প্রকৌশলী হয়ে ধর্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কোথায় ঘটে নাই ধর্ষণের ঘটনা?
চলন্ত বাসে ধর্ষণ, ট্রেনে ধর্ষণ, পরিত্যক্ত বাড়িতে ধর্ষণ, জঙ্গলে ধর্ষণ, রাস্তায় ধর্ষণ, বাড়িতে ধর্ষণ, হোটেলে ধর্ষণ, অফিসে ধর্ষণ, বাংলোতে ধর্ষণ, বারে ধর্ষণ, চিপায় ধর্ষণ-চাপায় ধর্ষণ, মাদ্রাসায় ধর্ষণ, মসজিদে ধর্ষণ, কোচিং-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ, ডেরায় ধর্ষণ, গুহায় ধর্ষণ, যুদ্ধাবস্থায় ধর্ষণ, শরনার্থী শিবিরে ধর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কি কি কায়দায় ঘটে নাই ধর্ষণ?
ছোট্ট শিশুকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, প্রেমের ফাঁদ পেঁতে ধর্ষণ, ব্ল্যাকমেইল করে ধর্ষণ, পীর সেজে ধর্ষণ, দাতা সেজে ধর্ষণ, সাহায্যের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণ, ডেকে নিয়ে ধর্ষণ, জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, চাকুরীর লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, নায়িকা বানানোর আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণ, ডাকাতি করতে গিয়ে ধর্ষণ, পুরুষ হয়ে ছেলে শিশুকে ধর্ষণ, দলবেধে ধর্ষণ, ক্ষমতাশীল হয়ে ধর্ষণ, ক্ষমতাহীন হয়ে ধর্ষণ, জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রণ করে ধর্ষণ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কোন কোন সামাজিক-অর্থনৈতিক স্তরে পাওয়া যায় নাই ধর্ষক?
উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, অনুন্নত দেশ, ইসলামিক দেশ, কোটিপতি, ফকির-মিসকিন, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, মিস্ত্রী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ইত্যাদি সকল স্তরের ধর্ষক পাওয়া গেছে।
কোন দল ক্ষমতায় থাকাকালীন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নাই?
কোন দল ক্ষমতায় থাকাকালীন কোন ধর্ষক পার পেয়ে যায় নাই?
সবসময় ঘটেছে ধর্ষণের ঘটনা, সবসময় পার পেয়ে গেছে ধর্ষক।
কোন রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থায় উৎপাদিত হচ্ছে না ধর্ষক?
গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ইসলামিক আইন, অনৈসলামিক আইন ইত্যাদি কোন ব্যবস্থায় ধর্ষক নির্মূল করা যায় নাই, পার্থক্য শুধু কম আর বেশিতে। ধর্ষণের পরিমান কম এমন কোন ব্যবস্থাও আমি মেনে নিতে পারি না। একটি রাষ্ট্রে একজন ধর্ষককে মানতেও আমি রাজি নই।
আমি ক্লান্ত। মনে হচ্ছে আরো দুইদিন ধরে লিখলেও ধর্ষক ও ধর্ষণের ক্যাটাগরি থেকে বের হতে পারব না। তাই এখানেই ক্ষান্ত হলাম।
এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যেহেতু সব অবস্থায়, সকল ব্যবস্থায় সর্বোপরি সকল পুরুষই ধর্ষক তাহলে ধর্ষণ নির্মূল বা কমানো যাবে কিভাবে? পুরুষহীন সমাজ তো সম্ভব না।
যেহেতু পুরুষদেরও দয়া-মায়া আছে, পুরুষরাও মানুষ, পুরুষদেরও মানবতা আছে, সমাজে ভালো পুরুষরাও আছে তাহলে সকল পুরুষের ধর্ষক হয়ে ওঠারই বা কারণ কি?
কারণ একটাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবী। যেহেতু কেবল পুরুষরাই ধর্ষক সেহেতু বুঝতে হবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ক্ষমতার কারণেই এমনটা ঘটছে। (দয়া করে কেউ নারীরাও ধর্ষণ করে এই উদাহরন টেনে ফালতু তর্কে জড়াবেন না। ধর্ষকের স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ধর্ষিকা বলতে কোন শব্দ নেই। ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না। ধর্ষকের স্ত্রীলিঙ্গ এখন পর্যন্ত ধর্ষিতাই)। শুধু ধর্ষণ কেন নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার কারণ ঐ একটাই, বাবু পুরুষতন্ত্র মহাশয়।
পুরুষতন্ত্র একটা জাল, একটা অদৃশ্য নেটওয়ার্ক। আপনি কোন না কোনভাবে এই জালে আটকে আছেন, আপনি সকল অবস্থানে, সকল মানসিকতায় এই নেটওয়ার্কের আওতাধীন। এমনকি নারীরাও এই নেটওয়ার্কের শিকারে পরিণত হয়ে পরোক্ষ ক্যাটাগরিতে ধর্ষকের পর্যায়ে পড়বে। এই জালটা কিভাবে দুষ্টুচক্রাকারে কাজ করে সেটা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা হবে, নয়তো লেখা শেষ করা যাবে না।
আচ্ছা, আপনাদের লজ্জা হয় না? আমি পুরুষ হলে ধর্ষকের অপবাদ মাথায় নিয়ে লজ্জায় মরে যেতাম। লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত আপনাদেরও। আর যদি মরতে না পারেন, বীরদর্পে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চান তাহলে সৎ সাহস, দৃঢ় মানসিকতা, বিবেক ও বুদ্ধি খাটিয়ে আজ থেকে, এখন থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, আমার উল্লেখিত বা অনুল্লেখিত ধর্ষকের কোন ক্যাটাগরিতে নিজেকে ফেলতে দিয়েন না প্লিজ। আপনারা সবাই মরে গেলে তো পৃথিবীটা চলবে না। বিশ্বাস করেন, আমরা আপনাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মত শুধু নারীর ক্ষমতাভিত্তিক একটি নারীতান্ত্রিক সমাজও চাই না। আমরা সমতার ভিত্তিতে সসম্মানে সুস্থ ও সুন্দর একটা সমাজে ধর্ষকমুক্ত একটি পৃথিবীতে জারিয়াদের নিয়ে একসাথে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে চাই। সেটা আপনাদের জন্যই সম্মানের ও স্বস্তির।
লেখক: লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট