ধর্ষণ এবং লিঙ্গ কর্তন: ভারসাম্যহীন বিতর্ক আর কত?
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০১৭, ২২:৪৯
মাত্র কয়েকদিন আগে পরিবর্তনে এই বিষয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে যেখানে আমি সবদিকে লক্ষ্য রেখেই আমার বক্তব্য উপস্থাপন করেছি। আমার কিছু বিজ্ঞ ফেসবুক বন্ধু আমার সেই লেখায় কোনো সরাসরি রিয়েকশন দেননি কিন্তু পরবর্তিতে নিজেদের স্ট্যাটাসে নিম্নরূপ বক্তব্য দিয়েছেন:
'ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন করবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশে রিপোর্ট করুন। উন্নত বিশ্বের নারীরা তাই ই করে থাকে।'
সাথে তারা উন্নত বিশ্বে ঘটে যাওয়া কিছু যৌন নিপীড়নের ঘটনাও উল্লেখ করেছেন। লোকজন যখন এ ধরনের কথা বলে, তখন খুব অসহায় বোধ করি। এসব কথার উত্তরে যুক্তিগুলো সংখ্যায় এতো বেশি এবং ওজনেও এতো ভারি যে আমার শিক্ষিত বন্ধুরা নিজেরাই সেগুলো জানার কথা তবু তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য কিছু কথা বলবো।
প্রথমত, আইনই যখন ধর্ষণের সম্ভাব্য শিকারকে অধিকার দিয়েছে আত্মরক্ষার জন্য যে কোন ধরনের একশন নিতে সেখানে কি একে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া বলে নাকি আইনের আশ্রয় নেয়া বলে? কোনো এক মৎস্য খামারে পানির পাম্প চুরি করার অপরাধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে এক কিশোরকে, আরো কোথাও মোবাইল চুরির অপরাধে উত্তম মধ্যমে প্রাণ হারিয়েছে আরো একজন কিশোর। এক্ষেত্রে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া নিয়ে আপনাদেরকে ততটা সরব হতে দেখিনি যতটা সরব আপনারা ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন নিয়ে। কারণটা কি? আপনাদের সবার এক একটি লিঙ্গ রয়েছে বলেই কি এতো দুশ্চিন্তা? মোবাইল বা পানির পাম্প চুরির সাথে নিজেদেরকে বোধ হয় ঠিক এভাবে রিলেট করা যায় না, যতটা লিঙ্গ-কর্তনের সাথে?
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের কোনো ঝুপরি কুটিরে রাতের অন্ধকারে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির একজন শ্রমজীবী দরিদ্র নারীকে ধর্ষণ করার চেষ্টাকে কীভাবে উন্নত বিশ্বের কোনো উৎসবে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের সাথে তুলনা করেন আপনারা, যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে এবং আইনের প্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে সমান?
সব তর্ক ফেলে আমাকে একটা কথা বলুন, শুধু একটা কথাই বলুন- ঐ নারীটির ঐ মুহুর্তে কী করণীয় ছিল? ধর্ষককে তার লিঙ্গ নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে দিয়ে ধর্ষিত হওয়া এবং পরের দিন সকালে পুলিশের কাছে যাওয়া? আপনার নিজের স্ত্রী, কন্যা বা বোনকেও কি আপনি এই একই পরামর্শ দেবেন?
উল্লেখ্য যে আলোচ্য শ্রমজীবী নারীটিকে উল্লেখিত পুরুষটি আগেও উত্যক্ত করেছে, ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। তিনি বিচার চেয়েও পাননি। তাকে বলা হয়েছিল প্রমাণ নিয়ে আসতে। ধর্ষণের ইচ্ছা কী করে প্রমাণ করবে একজন দরিদ্র নারী যার ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই? তার জন্য প্রমাণ আনার উপায় একটাই- ধর্ষিত হয়ে নিজের দেহে ধর্ষকের বীর্য মেখে তারপর পুলিশের কাছে যাওয়া। শুনতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠছে না? অবশ্য আপনারা যারা ধর্ষকের পক্ষে তাদের কাছে এটাকেই সভ্যতা বলে মনে হবে।
আমিও বলি দেশে আইন আরো জোরালো হোক, নারীর ক্ষমতায়ন হোক, ধর্ষণের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় এসব আলোচনা যুক্ত হোক। দেশে এমন একটা পরিবেশ আসুক যেখানে কেউ কারো প্যান্টের চেইন অনিচ্ছুক ব্যক্তির সামনে খুলবে না, তার লিঙ্গও অক্ষত থাকবে। কিন্তু যতদিন তা হচ্ছে না, ততদিন ধর্ষণের চেষ্টাকে প্রতিহত করতে নাক, কান, হাত, পা, লিঙ্গ সবকিছু কর্তিত হতে থাকুক।
লেখক: শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক