বাংলা ভাষা ও শব্দে পুরুষতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত প্রভাব
প্রকাশ | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:৪২
ছোটবেলায় নীতিকথা পড়তাম- গ্রামে-গঞ্জে এখনও প্রচারিত। ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে,’ ‘ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’। এই নীতিকথাগুলো ভালোই লাগতো। মা, খালা, কাকীরা শিখাতো। কিন্তু চেতনার পরিবর্তনের সাথে সাথে বুঝতে শিখলাম- এই নীতিকথাগুলোতে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের একচোখা দর্শন। প্রথম নীতিকথাতে নারীদের প্রতি চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে অবজ্ঞা ও অপমান। কেননা, ‘রমণী’ শব্দে নারী যেন ব্যবহার্য পণ্যে রূপান্তরিত। বলছি, ব্যাকরণের ভাষ্যে, রমণ+ঈ=রমণী। আর ‘রমণ’ অর্থ হলো মৈথুন/রতিক্রিয়া/প্রমোদ-কেলি ইত্যাদি। তাহলে দেখা যায়, ‘রমণী’ অর্থ, যার সঙ্গে রমণ করা হয় বা যায়। এ থেকে বোঝা যায় নারীর এই শব্দটি লজ্জার। শুধু নারীর লজ্জা নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য লজ্জা বলে মনে হয়। আমার বিবেচনায় এই শব্দটির ব্যবহার রহিত হওয়া উচিত! কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ, কবি, সাহিত্যিক মনে করবেন, তুমি ব্যাকরণের উপর খবরদারি ফলাও। তা একটু চেষ্টা করে দেখলাম। বাংলা অভিধানের এমন শব্দগুলো ‘জাদুঘরে’ চলে যাওয়া উচিত। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে।
এবার বলছি, নিত্যপুরুষবাচক শব্দ অর্থাৎ যে পুরুষবাচক শব্দগুলোর কোনো স্ত্রীবাচক শব্দ নেই সেগুলো মূলত বীরত্বব্যঞ্জক, একইসাথে ‘নিত্যস্ত্রীবাচক’ শব্দ অর্থাৎ যে স্ত্রীবাচক শব্দগুলোর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই সেগুলো প্রায় সবই হীন, লজ্জাজনক ও অপমানকর। ভয়াবহভাবে পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব রয়েছে।
এক্ষেত্রে বিশ্ব কবি এবং বিদ্রোহী কবিও নারীকে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেননি বলে মনে হয়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘রমণীর মন/সহস্রবর্ষেরই সখা, সাধনার ধন। কবিতায় নজরুল লিখেছেন: ‘নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো/এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো। ইহাদের অতিলোভী মন/ একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়/যাচে বহুজন।’ যেভাবেই উচ্চারিত হোক না কেন, এটা নারীর জন্য অপমান বটে! নারীকে বশে রাখা, যথেচ্ছ ব্যবহার করা- এসবের উদ্দেশ্য।
শব্দের বৈষম্যতা ভেবে দেখুন, ডাইনি, শাঁখচুন্নি, বাইজি, শাঁখিনি, কুলটা, সতিন ইত্যাদি নিত্যস্ত্রীবাচক শব্দ, আর রাষ্ট্রপতি, সেনাপতি, যোদ্ধা, কবিরাজ ইত্যাদি নিত্যপুরুষবাচক শব্দ, কী ভয়াবহতা, ভাবা যায়! নারীদের জন্য কত হীন, লজ্জাজনক আর অপমানকর শব্দ! পক্ষান্তরে পুরুষকে বানিয়েছে বীর। উপরোক্ত নিত্যস্ত্রীবাচক শব্দগুলোর অর্থের সাথে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। ডাইনি, বাইজি, শাঁখিনি এই শব্দগুলোর কোনো পু:লিঙ্গ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, যে মেয়েটি বাইজি হলো, যারা তাকে বাইজি বানালো বা রাত্রব্যাপী তার নিতম্ব সঞ্চালনে যে পুরুষেরা লালসা মেটালো তাদের অভিহিত করার মতো কোনো শব্দ নেই। অথচ ইচ্ছে করলেই কিন্তু বাইজির বিপরীতে শব্দ থাকতে পারতো। যেমন: বাইজা। আরেকটি ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দেখেন, এক পুরুষের একাধিক স্ত্রী হিসেবে নারী থাকতে পারবে এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে ‘সতিন’। কিন্তু নারী কখনো একাধিক পুরুষকে একই সময়ে বিয়ে করতে পারবে না। কেন! এ ব্যবস্থাটি শুধু পুরুষের জন্য, নারীর জন্য এটা নিষিদ্ধ। হিন্দু ধর্মেও এর ভয়াবহ প্রভাব রয়েছে: বিবাহিতা ও স্বামী-বর্তমান হিন্দু নারীদের ‘এয়ো’ বা ‘এয়োতী’ বলা হয়; এর পুরুষবাচক কোনো শব্দ নেই। তার অর্থই হলো তুমি অন্যের দারস্থ, তোমার কোনো নিজস্বতা নেই। যেমন: বাঙালি এয়োতীদের চিহ্ন শাঁখা-সিঁদুর ইত্যাদি। কিন্তু বিবাহিত পুরুষের এ জাতীয় চিহ্ন বা প্রতীক ধারনের কোনো রেওয়াজ নেই। অর্থাৎ নারীরা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হলেই সমাজকে জানিতে দিতে হয় তারা বিয়ে করেছে; স্বামী মারা গেলে শাঁখা-সিঁদুর খুলে সাদা পোশাক পড়ে সারা জীবন শোক প্রকাশ করতে হয়। নিরামিষভোজী থাকতে হয়। পুরুষের বেলায় এসবের কোনো বালাই নেই। গ্রামে প্রচলিত আছে: ‘ভাগ্যবানের স্ত্রী মরে, অভাগার মরে গরু।’ কতটা অপমানজনক কথাটা ভেবে দেখেছেন!
লৈঙ্গিক শব্দাবলীর আলোচনার বাইরেও বাংলার অসংখ্য শব্দ রয়েছে, যেগুলো নারীকে নির্লজ্জভাবে উপস্থাপন করে, পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু তার বিপরীত। বীর উপাধি দিয়ে গড়ে তোলে।
আর একটি উদাহরণ টানছি, কবি বলেছেন: ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুর অন্তরে’। কেন এখানে মাতা-পিতার অন্তরেও হতে পারতো। আসলে এ সবই পুরুষতান্ত্রিক চেতনার অন্তর্লোকে লালিত এক বিরাট ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’র আধিপত্য। যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিক জল-বাতাসে লালিত পালিত হয়ে নারী-পুরুষ প্রত্যেকের চেতনায় ধীরে ধীরে জন্ম নেয়।
সবশেষে বলা যায়, পুরুষতান্ত্রিক চেতনা শুধু পুরুষরাই ধারণ করে না, নারীরাও করে। বরংচ নারীরা এক্ষেত্রে পুরুষকে একান্তভাবে সহযোগিতা করে থাকেন। নারী এবং পুরুষের উভয়ের চেতনার উলম্বনের মধ্য দিয়ে এই সংকট থেকে কাটিয়ে উঠা যাবে। আর এই সংকট মনুষ্য সমাজের সংকট। প্রতিটি সংকটের সাথে সামাজিক ব্যবস্থপনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভূগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক জড়িত- এটিও তাই। পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে বিরোধিতা মানে পুরুষকে বিরোধিতা নয়, পুরুষ আমার সবচেয়ে ভালো সঙ্গী, প্রিয়জনও বটে। কিন্তু তার পশুত্ব আচরণকে ঘৃণা করতে হবে, তাকে গড়ে তোলার জন্য এবং নিজেকে রূপান্তরিত করার জন্য একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আবারও বলছি- আমি পুরুষবিদ্বেষী নয়, তবে তার আরোপিত অন্যায় যেন আমাকে বশ করতে না পারে সেদিকে আমার চেতনাকে শাণিত করছি! আমি মনে করি সে আমার শ্রদ্ধানুগত্য হবে, আমিও তার শ্রদ্ধানুগত্য হবো। চেতনা দিয়ে চেতনাকে শাণিত করে মানবমুক্তির পথে অগ্রসর হবো।
জয় মানবতার জয়
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট