সম্প্রীতির বন্ধন হোক দৃঢ়
প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৭
বাংলার হিন্দু বাংলার খ্রিষ্টান,
বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান
আমরা সবাই বাঙালি...
অসাধারণ একটা গণসংগীত এর প্রথম কয়েকটা লাইন, আমার ভীষণ প্রিয়। আবহমান বাংলার সম্প্রীতির এই চিরচেনা রূপটি ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। আমরা সেই কবে থেকেই সুখে দুঃখে পাশে থেকেছি। ক্রমেই আমরা অস্থির হয়ে উঠছি কেন? ভোট এলেই কেন চিহ্নিত কিছু পাড়া মহল্লায় আগুন জ্বলে? পূজো পার্বণ এলেই কেন সনাতন ধর্মানুসারী বন্ধুদের কপালের ভাঁজ স্পষ্ট হয়?
পূজো আসলেই বেশ কিছু বছর থেকেই দেখতে পাচ্ছি এখানে সেখানে প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কারা ভাংচুর করছে? তাদের ধরা হয়েছে বলে শুনতে পাই না কেন? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ঘটে যাওয়া ক্ষত এখনো বেশ দগদগে আমাদের স্মৃতির পটে। রসরাজ একজন গ্রাম্য যুবক, মাছ ধরছিলো বিলের জলে আর তার মুঠোফোন ছিলো বাড়িতে। সেই রসরাজের নামে একটি ফেইসবুক একাউণ্ট থেকে কুরুচিপূর্ণ ছবি প্রচার হতেই ফুঁসে উঠলো একদল ধর্মাশ্রয়ী উন্মাদ। জ্বালিয়ে দেয়া হলো মন্দির আর সনাতন গ্রামবাসীদের বাড়িঘর, তাদের অপরাধ? রসরাজ ও তাদের ধর্ম এক... এ কেমন যুক্তি? দোষ যদি রসরাজ করেও থাকে, তার দায় নিতে হবে রসরাজকেই, তার সম্প্রদায়ের অপরাধ কি? অবশেষে প্রমাণিত হয়েছে যে রসরাজ এখানে বলির পাঠা মাত্র, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের, আর ঢাল এখানে ধর্ম।
রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে যে বীভৎস হামলা হয়েছিলো সেটা কি আমরা ভুলে গেছি? নাসিরনগরের মতোই একটা গুজব রটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ উপাসনালয় আর বাড়িঘর। সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যায় করে তা গড়ে দিয়েছেন, কিন্তু তাদের মনের ক্ষত কখনোই মুছবে কি না আমি জানি না। ইদানিং রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আছেন শঙ্কায়। ইতিমধ্যে তারা মায়ানমারের নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়েছেন, সহমর্মিতা জানিয়ে তাদের সুদীর্ঘ কালের ধর্মীয় রীতি ফানুস না উড়িয়ে সেই অর্থ বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জন্য দান করে বিরল সম্মান জানিয়েছেন। এটাই কি তবে ভালোবাসা নয়।
নিজের ধর্ম ত্যাগ করে নতুন নাম ধারণ করেছেন কবির সুমন যিনি সুমন চট্টোপাধ্যায় নামেও সুপরিচিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটা গান তিনি গেয়েছিলেন “আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ, আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু...” এই গানের প্রতিটি লাইন কি অপূর্ব! আমরা সত্যিই কোন দিন এমনটা ভাবতে পারবো এই দেশে? মনে পড়ে গেলো ক্যাম্পাসের দুই বন্ধুর কথা, লিটু আর সালমা। ভালোবাসায় ধর্ম তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি তখনো। ক্যাম্পাসের পুরোটা সময় একসাথেই কাটিয়েছে, কিন্তু ঘর বাঁধা হয়নি তাদের। কারণ তারা কেউ পরিবার হারাতে চায়নি।
বাউল শাহ্ আব্দুল করিম গেয়েছেন “গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”... অর্থাৎ তখন বা তারো আগে থেকেই থেকেই হয়তো বিভেদের দেয়াল উঠছিলো, তাই উল্লেখ করেছেন আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। ধর্মের বাড়াবাড়ি কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না, এমন কি নিজ নিজ ধর্মের ক্ষেত্রেও। বাউল গান করতেন বলে প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা’র মৃত্যুর পর জানাজা পড়তে আসেনি কেউ, স্ত্রীকে দাফন করেছেন বাড়ির উঠোনে একা, আর গান বেধেছেন: “আমি কূলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী...” ঠিক তেমনি লালন ফকির ভিন্ন ধর্মের কারো হাতে অন্ন গ্রহণ করেছেন এই অজুহাতে ধর্ম খুইয়েছেন। স্ত্রীর কাছে যেতে পারেন নি, গর্ভধারিণী মায়ের স্নেহ স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে আজন্ম মানব ধর্ম পালন করে দেহতত্ত্বের অনুসন্ধান করে গেছেন, গেয়েছেন: “ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি, এক জলে সব হয়গো শুচি, দেখে শুনে হয় না রুচি, যমে তো কাউকে ছাড়বে না... জাত গেলো জাত গেলো বলে, একি আজব কারখানা"।
আমার শিক্ষার হাতেখড়ি হয় শ্রীমতি আরতী পাল এর হাত ধরে। আমার শিক্ষক, তাকে আমি মায়ের চেয়েও বেশী ভয় পাই এখনো। বিয়ে করেন নি, সবাইকে বলেন আমি তারই সন্তান। আমিও ম্যাডামকে মা এর মতোই ভালোবাসি। আম্মা ছোটবেলায় আমাকে ম্যাডামের ভয় দেখিয়ে শায়েস্তা করতেন। এই ভয়, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। একসময় দুর্দান্ত প্রতাপশালী পাল বাড়ির জমিদার ছিলেন ম্যাডামের বাবা। উনাদের বাড়ির সামনে দিয়ে নৌকার পাল নামিয়ে যেতে হতো। বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা উড়িয়ে কিংবা পায়ে জুতো দিয়েও যেতে পারতো না কেউ... সেই সময় এখন সুদূর অতীত। জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ও বাবার মৃত্যুতে ম্যাডাম আর বিয়েই করেননি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশনি করে বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সংসার চালিয়েছেন। পড়া শেষ না হলে বা বাড়ির কাজ বাকী থাকলে ম্যাডাম আমাকে বাসায় ধরে নিয়ে যেতেন। পড়া আদায় করে তবেই ছাড়তেন। ম্যাডামের শাড়ীর আঁচলে আধুলি বাঁধা থাকতো, আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার সময় দুই একটা চকোলেট কিনে দিতেন। তখন ওভাল্টিন ও মাল্টোভা ফ্ল্যাভারের বেশ চমৎকার চকোলেট পাওয়া যেতো মাত্র ৫০ পয়সায়। সন্ধ্যা হলেই ম্যাডামের মা পূজোর ঘরে সুরেলা কণ্ঠে আরাধনা করতেন, আর ধূপের সেই সুমধুর গন্ধ এখনো যেনো জীবন্ত স্মৃতি। মাসী সেই বৃদ্ধ বয়েসেও খুব ভোরে আমাদের বাসায় আসতেন শিউলী ফুলের জন্য। মুসলমান বাড়ির ফুল দিয়ে অঞ্জলী দিয়েছেন পূজোর ঘরে...
আমার বন্ধু চপল, শান্ত ছিলো না কোন কালেই। বড় দুই দাদা অনেক আগেই দেশ ছেড়েছিলেন জীবন ও জীবিকার তাগিতে। গন্তব্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বাবা কাকারা তাদের সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছিলেন আগেই। দাদারা সেই ভাগের অংশ দিয়ে কোলকাতায় দোকান করেছিলেন। ব্যাবসা ভালোই চলছিলো। এসএসসি পাশ করার পর, তাকেও বলা হলো দাদাদের সাথে ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু সে কিছুতেই যেতে চাইছিলো না। সে এই দেশেই থেকে যেতে চাইছিলো। অবশেষে তাকে পাঠানো হলো একপ্রকার জোর করেই। লুকিয়ে কাঁদত সে, ভালোবাসতো আমাকে ভীষণ। বলতো তার দুঃখের কথা। ভারতে পাড়ি দেয়ার দুই বছর পর একবার দেশে এসেছিলো। আমার জন্য একটা পাঞ্জাবী এনেছিলো সাথে করে। আর দেশে আসেনি সে। পড়ালেখার চাপ ও বাস্তবতায় বন্ধুর সাথে দেখা হয় না অনেক বছর। কয়েকবছর ধরে ভাবছিলাম একবার কোলকাতায় গিয়ে ওকে চমকে দেবো! উল্টো আমিই চমকে গেলাম! চপলের স্বজন বন্ধুদের কাছে ওর খবর নিতে গিয়ে জানলাম আরো পাঁচ বছর আগেই ও দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করেছে... আমার কাছে এটা স্রেফ আত্নহত্যা। খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে ও মদ্যপানেই সমাধান খুঁজেছিল। তার ফলাফল লিভার সিরোসিসে অকাল মৃত্যু... বন্ধুর এই পাঞ্জাবী আমি এখনো সযত্নে আঁকড়ে আছি। ছিঁড়ে গেছে, তবুও ফেলবো না কোন দিন। যতোদিন বাঁচি চপলের দেয়া পাঞ্জাবি আমি গায়ে দেবোই। এই পাঞ্জাবি গায়ে জড়ালেই চপলের অস্তিত্ব অনুভব করি...
“মা, তোমার পায়ে জোড় মিনতি
এ অসময়ে তুমি এসো না
আমি তোমার সঠিক সম্মান দিতে পারবো না
কষ্ট নিও না মা
আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও...”
একজন ফেইসবুক বন্ধুর টাইম লাইন থেকে নিয়েছি। উনি দেবী দুর্গাকে মা সম্বোধন করে ক্ষমা চেয়েছেন, কারণ সময়টা এখন বড্ড প্রতিকূল! দেবীর আগমনে অনন্দিত না হয়ে বরং শঙ্কিত এই ভেবে, যদি মায়ের অসম্মান হয়। অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় আমাদের সমগ্র বাঙালির জন্য। এই বাংলাদেশ আমরা নিশ্চয়ই চাইনি। মিতু, সানা, চপল, দীপঙ্কর, কনক, বাপ্পি, মানিক, নয়ন, পুলক, রনি, বান্টি, জনি, মিতা, কনিকা, ওলি কিংবা চন্দন, টিটু কত বন্ধু আমার। কত সন্দেশ চেয়ে খেয়েছি, ওদের পূজোর খিচুড়ির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। কতো ইফতারে ওদের ডেকেছি। লক্ষ্মী পূজোর নাড়ু চেয়েছি। গলাগলির দিনগুলো গালাগালিতে রূপ নিচ্ছে কেন?
অসাম্প্রদায়িক একটি বাংলাদেশের জন্য ত্রিশ লক্ষ শহীদ রক্ত দিয়েছেন। এই রক্তগঙ্গায় সব ধর্মের শহীদের রক্তই ছিলো। গায়ের রং সাদা, কালো বা শ্যমলা হতে পারে; ধর্ম, গোত্র, বর্ণ আলাদা হলেও রক্তের বর্ণ কিন্ত একটাই, লাল।
শরতের আকাশে এখন অনেক নীল, সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে দিকবিদিক। কখনো বা বৃষ্টি হয়ে তপ্ত ধরণীকে শীতল স্পর্শে ধন্য করছে। সামাজিক মানুষ একা বাঁচতে পারে না, তাই যুথবদ্ধ হয়েই বসবাস করছে সুপ্রাচীন কাল থেকে। ধর্ম একটি বিশ্বাস মাত্র, এতে মতভেদ থাকতেই পারে। আসুন আমরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভেঙ্গে ফেলি ধর্মের অদৃশ্য দেয়াল।
আমরা ভুলে যাইনি বড়ু চণ্ডীদাসের মানবিক আহ্বান, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
শারদীয় শুভেচ্ছা সবাইকে, মানবতার জয় হউক।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী