নারীবাদের জন্য নারী কতটুকু প্রস্তুত?
প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০:৫৭
"ওরা তোমাকে নারীবাদী লেখক বলে কেনো, তুমি তো নারীবাদী নও!" আমার নারীবাদী পরিচয় নিয়ে আমার খুব প্রিয় মানুষের প্রতিক্রিয়া এরকমই। আবার এরকম প্রচুর নারীকে আমরা জানি যারা নারীমুক্তি আন্দোলনের সাথে থাকেন, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন, লেখেন তারপর ঘরে ফিরে "আমি কিন্তু নারীবাদী নই" বলে ঘোষনা দেন। তাদের দৃষ্টিতে নারীবাদী হওয়া একটা অপরাধ, নারীবাদীরা ভুল পথে চলছেন এবং নারীবাদীরা সমাজে অস্থিরতা ছড়াচ্ছেন।
কিছুদিন আগে মন্ত্রীপরিষদের একজন নারী সদস্যের সাথে আলাপকালে তিনি বলছিলেন, “যেদিন নারীরা তুচ্ছ শাড়ি গয়নার লোভকে পেছনে ফেলে শিক্ষিত হবে, রোজগার করবে, পরিবারে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ করবে, সেদিনই সম মর্যাদা পাবে...” আমি খুব আশাবাদী হয়ে যখন সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার, অবিভাবকত্ব আইন নিয়ে কথা তুললাম, তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “এসব নারীবাদী ইস্যু তুলে সমাজে অহেতুক টেনশন তৈরি করার দরকার নেই”।
"এসব নারীবাদী ইস্যু" !! "আমি নারীবাদী নই" !!
হ্যাঁ, এটাই পুরুষতন্ত্রের নতুন ভাষা, খেলার নতুন চাল। অনেক নারী এখন পুরুষের এই চালের গুটি হয়ে গেছেন। নারীবাদ নিয়ে এই ক্ষমতাবান নারীদের, এবং অনেক সাধারণ নারী পুরুষের যে শঙ্কা বা সংস্কার তা পুরোই রাজনৈতিক, যেখানে পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আছে। কারণ, নারীবাদ বুঝুক বা না বুঝুক, একটা মেয়ে নিজের অধিকার আদায় করার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এই ব্যাপারটি খুব ভয়ঙ্কর পুরুষতন্ত্রে।
তাই পুরুষ শাসিত সমাজ নারীবাদ নিয়ে এতো বিভক্তি, বিতর্ক আর সংস্কার তৈরী করেছে যে, সাধারণ নারীরাতো বটেই, অনেক ক্ষমতাবান নারীরাও এই মতবাদকে স্বীকার করতে ভয় পান। অনেক সময় নারী অধিকার কর্মীরাও তাই নিজেদের নারীবাদী বলতে লজ্জা পান। নারীদের এই বিভক্তি, ভয় আর সংস্কারই পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে যুগ যুগ ধরে।
ডেমি রেবেকা ওয়েস্ট, একজন ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “নারীবাদ কী আমার ঠিক জানা নেই। আমি শুধু জানি, যখনই আমি আমার ভেতরের আমিকে প্রকাশ করি এবং তা আমাকে পা মোছার পাপোষ বা বেশ্যা হওয়া থেকে আলাদা করে, তখনই লোকে আমাকে নারীবাদী বলে ডাকে”।
পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি ঠিক এটাই চায় যে, নারীদের মধ্যে আদর্শিক বন্ধন গড়ে না উঠুক, নারীরা বিভক্ত হোক, নারীবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হোক। কারণ, পুরুষতন্ত্র জানে নারীবাদ বা ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন ঠিক পুরুষতন্ত্রের কোন জায়গায় আঘাতটা করে। সুতরাং পুরুষতন্ত্রকে আরো হাজার বছর টিকিয়ে রাখার জন্য নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বিভক্ত করার, নারীবাদ এর মত গতিশীল একটি মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, নারীদের মধ্যে অনৈক্য নিয়ে আসার মতো ভালো অস্ত্র আর কী আছে পুরুষের হাতে?
এই পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে নারীরা বিভক্ত হয়, দ্বিখন্ডিত হয়। একদল বলে তারা নারীবাদিই নন, আবার একদল প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠে তারা ‘ভালো’ নারীবাদী আর অন্যরা ‘খারাপ’ নারীবাদী। একদল আস্তিক নারীবাদী তো অন্যদল নাস্তিক নারীবাদী! এই বিভক্ত নারীরা না জেনে, না বুঝে নিজেদের বিভেদ বাড়িয়ে শুধু পুরুষতন্ত্রকেই দীর্ঘজীবি করেন।
এই নারীরাই পুরুষের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নারীবাদকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে চলেন। তারা পুরুষতন্ত্রের শেখানো ভাষাতেই নারীবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, ব্যক্তি নারীকে আক্রমন করে সমান অধিকারের লড়াই করা নারীদেরকে 'তসলিমা নাসরিন, নাস্তিক, ডিভোর্স প্রমোট করা, পরিবার অস্বীকার করা, বাচ্চা ঘৃণা করা, পুরুষবিদ্বেষি, ঝগড়াটে, এ্যারোগেন্ট, মেয়েলি (?)কাজ ঘৃণা করা, পুরুষ হতে চাওয়া' মেয়ে বলে স্টিগমাটাইজ করেন।
আসলে নারীবাদের সঠিক তথ্যের চেয়ে বিকৃত তথ্য অনেক বেশী পেয়েছি আমরা। পুরুষতন্ত্র এ কথা প্রচার করতে সফল হয়েছে যে, নারীবাদ হচ্ছে বিকার।
নারীর সমান অধিকার আন্দোলন নিয়ে বিরক্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এমন শিক্ষা-দীক্ষা, প্রথা-প্রচারণা চালিয়ে এসেছে যেন নারী নিজের অস্তিত্ব, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ইত্যাদি মৌলিক মানবিক বিষয়ে ভাবার সুযোগ না পায়। পুরুষরা নিজেদের সুবিধামতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনের চর্চায় অগ্রসর হয়ে যেখানে পৌঁছে গেছে, সেখানে নারীদের জন্য আলাদা করে একটা মতবাদ বোঝার জন্য বা চর্চা করার জন্য কোন ক্ষেত্র অনায়াস করে রাখেনি।
তাই নারীবাদ নিয়ে এই যে নারীদের ভয়, সংস্কার, তা কিন্তু 'নারীবাদ' শব্দটিতে নয়, বরং এই ভয় নারীবাদের একশনে। পুরুষতন্ত্রের বানানো ট্যাবু ভেঙ্গে, নারীবাদকে পুরোপুরি বোঝা এবং স্বীকার করার মানেই হচ্ছে পুরুষের তৈরি অসম নিয়ম, আইন, ধর্ম, অসাম্যের পরিবার, সম্পর্ক, ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, মিথ ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ করা এবং প্রতিরোধ করার কাজে লেগে যাওয়া।
কিন্তু নারীবাদকে স্বীকার করে তা চর্চার জন্য যে মনোবল, উদ্যম এবং ঝুঁকি নিতে হয় তা বেশিরভাগ নারীরাই নিতে চান না বা পারেন না। কারণ, নারীবাদকে স্বীকার করলে বা চর্চা করলে নারীরা ট্যাগড হয়ে যায় র্যাডিকাল নারীবাদী, যৌন-স্বাধীনতাকামী, পরিবার অস্বীকার করা নষ্ট মেয়ে হিসেবে। পুরুষতন্ত্র আসলে নারীর মনোজগতও নির্মাণ করেছে নিজেদের মতো করে। অনেক নারীই তাই নারীবাদ বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। কারণ তারা জানে পুরুষ এটা পছন্দ করে না। তাই বাংলাদেশে নারীর সমান অধিকারের আন্দোলনে এখনো নারীদের বড় একটা অংশের কোন সম্পৃক্ততা তো নেই-ই, ন্যুনতম কৌতুহল পর্যন্ত নেই।
নারীবাদ বোঝা ও চর্চার বিষয়টি পুরুষের মতো এই নারীদের কাছেও যথেষ্ট বিরক্তিকর। কারণ, নারীদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস ও আচরণ, পুরুষসুলভ নিপীড়ন এবং ক্ষমতালোভের উৎসগুলোকেও নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। নারীবাদ সেই নারীদের আচরণকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, যারা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করে এবং পুরুষের সব প্রতারণাকে সমীহ করে।
আবার এই যে পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা, তা শুধু পুরুষদের কাছেই অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, নারীদের জন্যও যথেষ্ট কষ্টের। কারণ, নারীবাদই একমাত্র মতবাদ যা সুখী সংসারের পুরুষতান্ত্রিক মিথকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নারীকে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোর ভেতরে থেকেই এসব প্রশ্ন তুলতে হয় এবং এর মধ্যেই সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণ করতে হয়। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলে নারীদের অনিবার্যভাবেই নিজের বাবা-ভাই-বন্ধু-স্বামী-প্রেমিক-পুত্রের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হয়। কারণ, এরাই সেই পুরুষ যারা নারীর জীবনে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ হয়ে ফ্রন্টলাইনে আসছে।
নারীবাদের এই যাত্রা তাই কঠিন ও বেদনার। তবু দিনের শেষে এই মতবাদ নারী পুরুষ উভয়কেই লাভবান করে। তাই একটি সমতার পৃথিবী সৃষ্টির জন্য নারীবাদের মতো একটি আন্দোলনকে সব রকম কুসংস্কার আর ট্যাবু থেকে মুক্ত করা খুব জরুরী। আমাদের কন্যাদের, উত্তরনারীদের এই পৃথিবীতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার পথ তৈরী করতে চাইলে আর কোন রাস্তা কিন্তু খোলা নেই।
সুতরাং যে কোন সচেতন নারী, সকল অপবাদ আর শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে কোন এক সুন্দর ভোরে নারীবাদের লড়াই এ যুক্ত হবেন, আমি নিশ্চিত। কারন, নারীর তো এক শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই।
সেদিন এই পৃথিবীতে নতুন নারীরা নেতৃত্ব দেবে, যারা লক্ষ-কোটি বৈষম্যপীড়িত নারীর সম্মলিত শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করবে লিঙ্গ বৈষম্যের অপ-রাজনীতিকে।
লেখক: কলামিস্ট, প্রধান নির্বাহী- সংযোগ বাংলাদেশ