এই মাটি জঙ্গিবাদের নয়
প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৬, ১৩:১৮ | আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬, ১৩:২১
গুলশান হামলার পর থেকেই প্রায় বোবা হয়ে ছিলাম! মাথাটা একটা শুন্যতায় ভরা ছিল। এটা কি হচ্ছে? একটা অস্থিরতা আর নিস্তব্দতা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কিভাবে সম্ভব? চেনা নেই, জানা নেই, কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই শুধু মাত্র বেহেশতের লোভে এতগুলো মানুষকে এমন নির্মমভাবে হত্যা! কিছুতেই মনের ভার কমাতে পারছিলাম না। বিশেষ করে ফেসবুকে আর সংবাদ মাধ্যমে হত্যাকারীর ছবি দেখে তাদের পারিবারিক পরিচয় আর চেহারা দেখে আরো হতভম্ব! এরা কি সত্যি আমার প্রিয় বাংলাদেশের সন্তান? এই তো মাত্র তিন বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ আন্দোলনে যে হাজার হাজার তরুণ তরুণী ছিল তাহলে তারা কারা?
নিজেকে এই ট্রমা থেকে বের করতেই গত পরশু এবং গতকাল গিয়েছিলাম বাংলা সিনেমা দেখতে। কি অদ্ভুত এখানে শোক বা আতঙ্কের রেষ মাত্র নেই। ঈদের আনন্দে শত শত উৎসব মুখর বাঙ্গালি তাদের বন্ধু,পরিবার পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছে। আহ! কি অসাধারণ সেই দৃশ্য! গত ক’দিনের শোক আমাকে পাথর করে দিয়েছিল কিন্তু ওই সময়টুকুতে আনন্দে আমার চোখে এক ফোঁটা জল চলে এল। এই তো বাঙ্গালি, চিরাচরিত বাঙ্গালি।
বাংলা বদ্বীপের এই ভুখন্ডের মানুষের মধ্যে যতটা না ধর্মীয় পরিচয় বোধ কাজ করে তার চেয়েও বেশী কাজ করে তার বাঙ্গালি সত্ত্বা। আদিকাল থেকেই তাই এখানকার মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য আরব বা মধ্য প্রাচ্যের মুসলমানদের থেকে একেবারে ভিন্ন। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি মাদ্রাসায় পড়া বা মৌলবি বলে পরিচিতজনরা ছাড়া নিয়মিত লম্বা পায়জামা, পাঞ্জাবী, টুপি এসব কেউ পড়তেন না, এখনও তাই। ভারত বা অন্য দেশের পরিচালকরা যখন বাংলাদেশের কোন চরিত্র রুপায়ন করেন তখন তারা এই বিষয়টা লক্ষ্য করেন না, তাদের কাছে বাংলাদেশের কোন মুসলমান চরিত্র হলেই মাথায় টুপি, পাঞ্জাবী গলায় আরবি স্কার্ফ আর তাবিজ থাকে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শিশু নিয়ে সম্প্রতি যে ছবিটা তৈরি হয়েছে সেখানেও একই ভুল যা আমাকে বিভ্রান্ত করেছে যে ছবিটার চরিত্র পাকিস্থানি নাকি বাঙ্গালি!
আপামর বাঙ্গালির যে চরিত্র তা একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যে কারনেই তাঁর দল আওয়ামী মুসলীম লীগ থেকে আওয়ামীলীগ হয়েছিল আর স্বাধীনতার পরে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মুল স্তম্ভ হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
বাঙ্গালির আরও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেহিসেবী, একরোখা, গোঁয়ার, আবেগী, উৎসব মুখর, সুর আর সঙ্গীতের প্রতি আসক্তি ও বাউন্ডেলে। ২০০২ সালে যখন ১ লা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের নববর্ষ উদযাপনের সময় বোমা হামলা হল তার পরের বছর থেকে রমনায় মানুষের জমায়েত বহুগুণ বেড়ে গেল আর আজকে তো এটা রাষ্ট্রীয় উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে। শুধু রমনা নয় সারা দেশের আনাচে কানাচে এই উৎসব পালিত হয় মহা ধুমধামে। এবারের ঈদ আনন্দের মাঝে আমি আবারো সেই প্রত্যয় দেখলাম সবার মাঝে। গুলশান বা শোলাকিয়ায় যে জঙ্গী নামক দানব আমাদের ঈদ উৎসবকে শোকে পরিনত করতে চেয়েছিল তারা আজ বেওয়ারিশ লাশ মৃত্যুর পরে স্বজনের শেষ স্নেহ তো ভাল স্বীকৃতিটুকু মেলেনি এমনকি মুসলমান হিসেবে জানাজার। ঘৃণা আর ধিক্কারের সাথে সাথে শোককে শক্তিতে রুপান্তর করছে বাঙ্গালি সে কারনেই বলি যত বড় পরিকল্পনাই হোক না কেন বাংলাদেশ কখনও সিরিয়া বা ইরাক হবেনা। এদেশের মাটিতে ফুল হবে, ফল হবে, ধান শষ্যে শ্যামল বাংলায় জঙ্গিবাদ হয়ত কোন ক্ষমতালোভীর বারান্দায় লাগানো টবের দু একটা শখের আগাছা যেটা ঠিক ই উপড়ে পড়বে।
লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক ও এক্টিভিস্ট