রোহিঙ্গা সমস্যা: অতীত থেকে বর্তমান
প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:৫০
মিয়ানমারের রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস, দক্ষিণে মঙ্গোলয়েড বংশোদ্ভুত ‘মগ’ ও উত্তরে ভারতীয় (অষ্ট্রোলয়েড) বংশোদ্ভুত ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আর রোহিঙ্গারা মুসলিম ধর্মাবলম্বী। যাদেরকে অনেক বার্মিজ নাগরিক বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে হিসেবে গণ্য করে। রোহিঙ্গা (Rohingya) আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখ্যযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং, মংডু, কিয়কতাও, মাম্বা, পাত্তরকিল্লা, কাইউকপাইউ, পুন্যাগুন ও পাউকতাউ এলাকায় এদের নিরঙ্কুশ বাস। এছাড়া মিনবিয়া, মাইবন ও আন এলাকায় মিশ্রভাবে বসবাস করে থাকে। ২০১২ সালের হিসাবে, প্রায় ১৩,০০,০০০ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের বসবাস করে। মিয়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫ লাখ সৌদিআরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয় যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যেহেতু বার্মা সরকার তাদের পড়াশুনার সুযোগ দেয় না, তাই অনেকেই মোলিক ইসলামী শিক্ষাকেই একমাত্র পড়াশুনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তীতে চাঁটগাইয়া, রাখাইন, আরাকানী, বর্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভুত এই সংকর জাতি ত্রয়োদশ-চর্তুদশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল। মায়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হল ভারতীয়, বাঙালি ও চাঁটগাইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে পরিষ্কার জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়তে পারে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় "বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনগোষ্ঠী এবং "বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু"। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে: রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যপকভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের উপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
১৯৭৮ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর 'নাগামান' ('ড্রাগন রাজা') অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ (২০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশী অবৈধভাবে মায়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যার ঘটনা ঘটে। ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। ২০০৫ সালে, জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরণের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী ও অং সান সুচি মিয়ানমারেরর ক্ষমতায় আসলে ২৪ আগস্ট ২০১৬ জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। রোহিঙ্গা বিষয়ক এই কমিশনের নাম 'রাখাইন উপদেষ্টা কমিশন' যা ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি অন্তর্জাতিক কমিশন।
সর্বশেষ গত ৯ই সেপ্টেম্বর ২০১৭ মায়ানমারের কিকানপিন বর্ডার গার্ড হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন দুটি পুলিশ চেকপোষ্টে এক অতর্কিত হামলাতে মিয়ানমার পুলিশের ৯ জন সদস্য নিহত হয়, ৪৮টি অস্ত্র ও ৬৬২৪ রাউন্ড গুলি খোয়া যায়। সেই হামলাতে দুই জন হামলাকারীকে মায়ানমারের পুলিশ জীবিত ধরতে সমর্থ হয়। রোহিঙ্গাদের আকামুল মুজাহিদিন নামের একটি সংগঠনের জঙ্গিরা এই হামলা করেছিল বলে এই হামলার জের ধরে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। রাখাইন প্রদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসেবে এই অভিযান চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করছে সেনাবাহিনী। এর পর থেকেই সেখান থেকে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফে ঢোকার চেষ্টা করে অনেকে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার মতে ইতোমধ্যে বাংলদেশে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী প্রবেশ করেছে যা আরো বাড়তে পারে।
সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারের বাহিনীর নিপীড়নের নিন্দা ক্রমশ বাড়ছে, কিন্তু দেশটির প্রধান শহর ইয়াঙ্গনে পুরো ব্যাপারটাই দেখা হচ্ছে একেবারে অন্যভাবে। যদি আপনি রাস্তার লোকজনের সাথে রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে তা নিয়ে কথা বলেন, তাহলে আপনি 'রোহিঙ্গা' শব্দটিই শুনতে পাবেন না। বিবিসির বার্মিজ সাভিসের স ইয়াং নাইং লিখছেন, সংখ্যালঘুদের মিয়ানমারে বর্ণনা করা হয় 'বাঙালি' বলে। এ দেশে মূলধারায় রোহিঙ্গাদের কি ভাবে দেখা হয় - এতেই তার একটা আভাস পাওয়া যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা হচ্ছে 'বিদেশি' - বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী - যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাখাইন প্রদেশের সহিংসতাকে দেখা হচ্ছে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা হিসেবে, কিন্তু মিয়ানমারে এটি দেখা হয় জাতীয় সার্বভৌমত্ব-সংক্রান্ত বিষয় হিসেবে। উত্তর রাখাইনে যে সেনা অভিযান চলছে তার প্রতি সমর্থনও এখানে ব্যাপক। এখানে বরং আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরকেই দেখা হচ্ছে 'একপেশে' হিসেবে। যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের দুর্দশার খবর এখানে সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট প্রচার পায় না।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন যে মিয়ানমারের সরকার সে দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমারের জাতিগত নিধনের ব্যাপারে এতদিন ধরে যে অভিযোগ করে আসছিল, এবার জাতিসংঘও সেই অভিযোগ করছে। তবে মিয়ানমার সরকার বলে থাকে যে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। তাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগও মিয়ানমার অস্বীকার করে থাকে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের দায়িত্ব নেওয়া উচিত বলে মনে করে ইন্দোনেশিয়া। কারণ, রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর যে মানবিক সংকটের শুরু, এর উৎস মিয়ানমারেই। কাজেই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের একটি নিবন্ধিত শরণার্থী শিবির এবং একটি অস্থায়ী শিবির পরিদর্শনের পর এ মন্তব্য করেন।
রোহিঙ্গা সমস্যার শেকড়ে কেউই যেন হাত দিতে চান না। সকলে এর কেবল কয়েকটি ক্ষত স্থানের একটি স্থানে পানি ঢালার বিষয়ে কথা বলছেন। অর্থাৎ গত কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন তাদের ভরণ-পোষণের জন্য সবাই কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এটা জরুরী। কোন একটি সমস্যার কারণে যখন মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, প্রতিবেশী কোন দেশে আশ্রয় নেয়, তখন গোটা বিশ্বের দায় পড়ে ওই মানুষগুলোকে আগে বাঁচানো। পাশাপাশি গোটা বিশ্বেরই দায় পড়ে কেন ওই মানুষগুলো বাস্তুভিটে ছেড়ে, শত শত বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে সেই সমস্যার সমাধান করা। এ ধরনের সমস্যাগুলো সম্পূর্ণরূপে বিশ্ব ফোরামের বা বিশ্বের সকল দেশের দায়। কোন দুটি দেশের দায় নয়। বাংলাদেশের গত কয়েক যুগ ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি সমাধানের সব থেকে দুর্বল দিক, এ সমস্যাকে ধরে নেয়া হয়েছে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। অর্থাৎ এ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সমস্যা। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা কখনই ভারত-পাকিস্তানের কাশ্মীর সমস্যার মতো নয়। এ কোন মতেই দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয়। সমস্যাটি সম্পূর্ণরূপে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাই এর সমাধান মিয়ামারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ধর্মের ভিত্তিতে নয়, মানবতার খাতিরে মিয়ানমারকে করতে হবে। এছাড়া মিয়ানমারের উপর রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আসবে নিঃসন্দেহে। তবে এই সমস্যার সুরাহা করতে হবে মিয়ানমারকে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রেখে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভাষায় কথা বলা উচিত। বাংলাদেশ সরকার দেশবাসী কে সাথে নিয়ে জাতিসংঘ, ও.আই.সি, আসিয়ান সহ সকল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনে জাতিসংঘে দ্বারস্থ হতে পারে। তাহলেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
লেখক: সরকারী কর্মকর্তা