এভাবে আর ক’দিন চলবে!
প্রকাশ | ১১ জুলাই ২০১৬, ১৭:০১
গুলশান ট্র্র্যাজেডির পর থেকে জঙ্গিরা ‘জংলী’ তা আর ঢালাওভাবে বলা যাচ্ছে না। শুধু মাদ্রাসা শিক্ষাই জঙ্গিবাদের সূতিকাগার এ কথাটিও হয়তো অতো জোরালোভাবে কেউ বলতে চাইবেন না। জঙ্গি নাফিজ ফাহিম, নিবরাস, রোহান, সামিহ এবং অতি সম্প্রতি শোলাকিয়ার ঘটনার আবির সবাই ঢাকার অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত মেধাবী। শুধু দেশের অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নয়, দেশের বাইরেও নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন এদের অনেকে। এদের পারিবারিক পরিচয়, ব্যক্তিগত জীবন যাপন, ফ্যাশন সচেতনতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে আমাদের সকলের চোখের সামনে চলে এসেছে। কিন্তু খুব অবাক লাগছে যে, অভিজাত পরিবারের এতোগুলো সন্তান নিখোঁজ হবার ঘটনা আমাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে পারেনি।
আমরা সংসার করি, কর্মস্থলে পদোন্নতি পাই, সুবিধামতো ধর্ম পালন করি, ধবধবে পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যাই, টিকিট কেটে হিন্দি গান শুনি, সিরিয়াল দেখি, পার্লারে যাই, অন্যের নামে কুৎসা গাই, হাতে একটি স্মার্ট ফোন দিয়ে টেলিফোনে কথা বলি ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কিন্তু সন্তানদের পেছনে সময় ব্যয় করার অবসর নেই। দেখেও দেখছি না ছোট শিশুটির বাবা-মায়ের একটু স্নেহ, স্পর্শ আর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাকিয়ে থাকা। দেখছি না ছেলে শিশুটি চরম হতাশাগ্রস্ত, অবহেলিত এবং নিগৃহীত হচ্ছে কি না। শিশুদের খেলার মাঠ নেই, বাড়িতে গল্প বলার দাদা-দাদি নেই, নেই নানা-নানি। শোনেনি খুদিরাম সূর্যসেনের কথা, ঈশ্বরচন্দ্র রাজা রাম মোহন রায়ের কথা, দুখু মিয়ার নজরুল হয়ে ওঠার কথা, একাত্তরের হাজারো বীর শহীদের কথা, জাহানারা ইমামের রুমির কথা।
এইতো কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হলের একটি ভিডিও দেখছিলাম। একটি বিড়াল ছানা তিন তলার কার্নিশে আটকা পড়ে কাঁদছিল। বিড়াল ছানাটি একটু সামনে এগোলেই পরে গিয়ে মরে যাবে। ছাত্রদের কেউ একজন তা দেখে সব বন্ধুরা মিলে একটি মই জোগাড় করে এনেছে। সব বন্ধুরা মই ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর এক বন্ধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে উঠে গিয়ে আস্তে আস্তে বিড়াল ছানাটিকে নামিয়ে নিয়ে আসলো। একটি বিড়ালের বাচ্চাকে বাঁচিয়ে একে অপরকে আনন্দে জড়িয়ে ধরছিল।
একটি পশুর ছানাকে বাঁচাতে পেরে তারুণ্যের যে কী আনন্দ তা দেখে গর্বে আর আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলাম। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। আমাদের হয়তো অনেক কিছুই নেই, কিন্তু আছে আবেগ, আছে ভালোবাসা। যা দিয়েই আমরা জয় করেছিলাম ’৭১ এবং ’৫২। আমাদের ভালোবাসার সেই তরুণ সমাজ আজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিখোঁজ রয়েছে বহুদিন। আমাদের সন্তানরা আজ স্কুল-কলেজে গিয়ে আর বাসায় ফিরে আসছে না। তারা ফিরে আসে হত্যাযজ্ঞে, হত্যা করে।
হত্যাযজ্ঞের পর, সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর আমরা জানতে পারি জঙ্গি ছেলেটি নিখোঁজ ছিল পারিবারিক বন্ধন থেকে। শিক্ষককে হত্যাচেষ্টার সময় ফাহিমকে যখন জনগণ ধরে দিয়েছিল তার আগে ফাহিমও অনেকদিন নিখোঁজ ছিল। ঠিক একইভাবে নিখোঁজ ছিল সামিহ, নিবরাস, উজ্জ্বল রোহান।
নিখোঁজ হয়ে হুমকি দিচ্ছেন সাবেক সঙ্গীত শিল্পী সাফি ও চিকিৎসক তুষার। মূলত এই নিখোঁজ হওয়ার গল্প এখন জঙ্গি হওয়ার চলমান প্রক্রিয়ার প্রথম সোপান। আজকের নিখোঁজ হওয়া পাশের বাড়ির ছেলেটিই হতে পারে আপনার-আমার আগামীকালের হন্তারক।
মনে প্রশ্ন জাগে এতোগুলো ছেলে নিখোঁজ হয়েছে আমরা জানতে পেরেছিলাম, কিন্তু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার কোনোই উপায় কেন আমাদের ছিল না। নিখোঁজ হওয়া ছাত্র ফাহিমকে ধরে ফেলার পর অন্যান্য নিখোঁজ হওয়া জঙ্গিদের বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিলে হয়তো গুলশানের ঘটনা নাও ঘটতে পারতো। বেঁচে যেতে পারতো খুন হওয়া মানুষগুলোর জীবন। গুলশান ট্র্যাজেডির হতবিহ্বল অবস্থা কাটতে না কাটতেই সেই নিখোঁজ ছেলের দলের একজনই আবার বোমা ফাটিয়ে মরলো শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে।
এখানেও হামলাকারী একজন নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় পুলিশের হাতে আটক নাফিজও বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘দামি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।
এতো হতাশা আর দুঃখবোধের মধ্যেও খুব হাস্যকর লাগছে যখন দেখি একজন প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলে, যার জীবনের লক্ষ্যে ছিল রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করা, তার জঙ্গি হয়ে ওঠা। যে ছেলেটি ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গান গেয়ে মানুষের ভালোবাসা পেয়ে প্রতিযোগিতায় সাফল্যে লাভ করেছে, সেই ছেলেটি সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য জঙ্গি হয়ে উঠেছে ভাবতে হতবাক লাগে। কীভাবে নিজের দেশের আলো বাতাসে বড় হয়ে, ভিন দেশে গিয়ে নিজের দেশের মানুষদের আঙুল উচিয়ে হত্যার ভয় দেখাচ্ছে।
অন্য একজন জঙ্গি, যিনি সাবেক ডেন্টাল কলেজের চিকিৎসক, তিনি ‘জাযাকাল্লাহ খায়ের’ বলে জিহাদি ভাইদের হত্যাযজ্ঞকে আবেগাপ্লুত হয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কিন্তু তাকে দেখে এবং তার ভাষায় অস্পষ্টতা ও জড়তা দেখে একবারও মনে হয়নি যে সে একজন জঙ্গি। মনে হয়েছে ক্লাসের পেছনের বসা একজন ভোম্বল দাস। যেখানে সেবার ব্রত নিয়ে একজন ছাত্র চিকিৎসক হয়, সেখানে তারা মানুষ হত্যার জন্য হাতে নিয়েছে চাপাতি, গ্রেনেড। এদের দু’জনের শারীরিক ভাষা ও বক্তব্য দেখে মনে হয়েছে তারা জীবনে কিছু একটি করে দেখাতে চেয়েছিল। তা না পেরে নিজের জীবন দিয়ে হলেও মানুষ মেরে তারা ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে। তাই সরকারের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ছেলে সঙ্গীত শিল্পী না হয়ে, হয়ে গেলো দুর্ধর্ষ আত্মঘাতী জঙ্গি, মেজরের ছেলে ডাক্তারি বিদ্যা ছেড়ে দিয়ে হায় হুতাশ করছে খেলাফত নিয়ে। রাজনৈতিক নেতার ছেলে ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াচ্ছে বেহেস্ত পাবার প্রলোভনে। আমাদের তরুণ সমাজের এই ব্যাধির কারণ কী? এই হ্যামিলনের বংশীবাদক কারা?
এমনওতো হতে পারে যে না জেনে হত্যা করার পর একজন জঙ্গি দেখলো হত্যা হওয়া নারীটি তার মা ছিল, কোলে পিঠে মানুষ করা আদরের ছোট বোন ছিল, যাকে কাঁধে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো হতো সারাটি বিকেল। যে বাবা গত ছয় মাস ধরে নিখোঁজ ছেলের খোঁজ করে বেড়াচ্ছেন সে বাবার গলায় ছুরি চালিয়েছে তারা। যে হিন্দু গণিতের শিক্ষক তার বাসায় এসে ক্যাল্কুলাসের সমাধান করে দিয়ে যেতো, তাকে কুপিয়ে শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করেছে তারা। জানি না কীসের অভাবে, কোন প্রলোভনে তারা এই হন্তারকের পথ বেছে নিলো। কারা আমাদের এই ভালোবাসার ঘর, শহর ভেঙে চুরে একাকার করে দানবে পরিণত করছে? এই বর্বরতা রোধে এখনই জাগতে হবে আমাদের, ঝাঁপিয়ে পরতে হবে সকলকে। তাই কবি হাসান হাফিজের মতো করে বলছি-
একটা কিছু করুন
এভাবে আর ক’দিন চলে
দিন ফুরালে হাসবে লোকে
দুঃসময়ে আপনি কিছু বলুন।
একটা কিছু করুন...
দোহাই লাগে একটা কিছু করুন।
লেখক : সহকারী ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণ, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড