কয়েকটি মন খারাপ করা ঘটনা
প্রকাশ | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০৭ | আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৮:৩৬
০১.
আগস্ট মাসটি মনে হয় সত্যিই বাংলাদেশের জন্য অশুভ একটা মাস। কীভাবে কীভাবে জানি এই মাসটিতে শুধু মন খারাপ করা ঘটনা ঘটতে থাকে। দুঃসময় নিশ্চয়ই এক সময় কেটে যাবে, তার পরও যখন ঠিক এই সময়টির ভেতর দিয়ে যেতে হয় তখন মন খারাপ হয়ে যায়।
শুরু হয়েছে বন্যা দিয়ে। বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেল, মাঠে-ঘাটে পানি, স্কুলে পানি, বাড়ির ভেতর পানি। আমরা যারা পুরো সময়টা শুকনো মাটিতে কাটিয়েছি তারা নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারি না পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকায় দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা সময় কাটাতে কেমন লাগে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি কখন বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে যাবে, দেশের মানুষ আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে।
শুধু যে নদীর পানির ঢলে বন্যা হয়েছে তা নয়, ঢাকা শহরের অনেক জায়গা জলাবদ্ধতার কারণে পানিতে ডুবে আছে। মানুষজন সেই পানি ভেঙে যাতায়াত করছে, ধরেই নিয়েছে এটাই জীবন। এসব জায়গায় যারা থাকে তারা গরিব মানুষ, সাধারণ মানুষ তাই তাদের কণ্ঠস্বর খুব বেশিদূর যেতে পারে না। তারা মেনেই নিয়েছে এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে।
প্রতিবছরই বন্যা আসে এবং প্রতিবছরই আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে চিন্তা করি, কোনো একটি রহস্যময় কারণে আমাদের বাংলা ভাষায় ‘বন্যা’ শব্দটি কিন্তু নেতিবাচক নয়। যদি এটা নেতিবাচক শব্দ হতো তা হলে আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা কিন্তু তাদের মেয়েদের নাম কখনই বন্যা রাখতেন না! কখনো কোনো মানুষের নাম খরা, ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড় হতে দেখিনি কিন্তু বন্যা নামটি যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং মিষ্টি একটি নাম।
মনে হয়, এই দেশের মানুষ বন্যার পানিতে বেঁচে থাকার পদ্ধতি বহু বছর থেকে জানে। ব্যাপারটি টের পাওয়া গেছে টেক্সাসের বন্যা দেখে। আমাদের দেশের পত্রপত্রিকার সাদা চামড়ার মানুষের জন্য মায়া মনে হয় একটু বেশি তাই দেশে বসে টেক্সাসের বন্যার খুঁটিনাটি আমরা জেনে গেছি! দেশটি যে এ রকম দুর্যোগ সামলাতে পারে না, সেটি খুবই স্পষ্ট।
যে বিষয়টি আমার চোখে আলাদাভাবে পড়েছে সেটি হচ্ছে বন্যাকালীন কারফিউ। সেই দেশে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর মানুষজন বাড়িঘর লুট করতে শুরু করল এবং সেটা বন্ধ করার জন্য কারফিউ জারি করতে হলো! বন্যার সময় আমাদের দেশে হাজারো রকমের সমস্যা হয় কিন্তু বাড়িঘর রক্ষা করার জন্য কারফিউ দিতে হয় সেটি কখনো শুনিনি!
আমেরিকার জন্য এটি অবশ্য নতুন কিছু নয় একবার নিউইয়র্ক শহরে কয়েক ঘণ্টার জন্য ব্ল্যাক আউট হয়েছিল, তখন পুরো শহর লুটপাট হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে ব্ল্যাক আউট নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, ভাগ্যিস আমরা এখনো আমেরিকান কায়দা-কানুনে দিন কাটানো শিখিনি।
০২.
আগস্ট মাসের মন খারাপ করা বড় ঘটনাটি সবাই জানে। রূপা নামের এক কলেজছাত্রীকে বাসের ভেতর ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেল্পার সবাই মিলে গণধর্ষণ করে এক ধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছে। প্রথম যেদিন খবরটি পত্রিকায় বের হয়েছে, আমি দেখেও না দেখার ভান করে চোখ সরিয়ে নিয়েছি।
আমি দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, এ ধরনের খবরগুলো আমি সহ্য করতে পারি না, তাই সেগুলো থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাই। কিন্তু মানুষ উটপাখি নয় যে, বালির ভেতর মুখ গুঁজে রাখলেই পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে তাই ধীরে ধীরে আমাকেও রূপা নামের এই অল্পবয়সী কলেজছাত্রীর ঘটনাটি জানতে হয়েছে।
ঘটনাটি জেনেছি কিন্তু যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা কেমন করে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটাতে পারে সেই বিষয়টি কোনোভাবেই বুঝতে পারি না। বিচ্ছিন্নভাবে একজন বা দুজন মানুষ যারা বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা নিয়ে মানসিক রোগী হিসেবে বড় হয়েছে তারা কোনো ধরনের অপরাধবোধ ছাড়াই এ রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে পারে কিংবা ঘটিয়ে আনন্দ পায় সেটা আমরা জানি।
কিন্তু একেবারেই পারিবারিক কয়েকজন মানুষ মিলে এ ধরনের নিষ্ঠুরতা করতে পারে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। তবে কি আমাদের মেনে নিতে হবে এ রকম ঘটনা সব সময়ই ঘটছে এবং যারা ঘটাচ্ছে তারা বেশিরভাগ সময়ই পার পেয়ে যাচ্ছে। তাই সমাজের একশ্রেণির মানুষ এটাকে খুবই সহজ-স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে?
আমরা শুধু একটি-দুটি ঘটনার কথা জানি, তাই সমাজের আসল ছবিটি আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে! যেগুলোর কথা পত্রপত্রিকায় আসে সেগুলোরও কি বিচার হয়? অপরাধী শাস্তি পায়? এ দেশের অনেক বড় আলোড়িত ঘটনা হচ্ছে তনু হত্যাকাণ্ড ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে কী তনুর হত্যাকারীর বিচার হয়নি? হবে না?
আমাদের ডিকশনারিতে গণধর্ষণ শব্দটি ছিল না (কী কুৎসিত একটি শব্দ, লিখতে গিয়ে কলম সরতে চায় না)। আমরা শুধু পাকিস্তানে এই ঘটনা ঘটার খবর পেতাম এবং শুনে হতবাক হয়ে যেতাম। কীভাবে কীভাবে জানি এই ঘটনাটি বাংলাদেশেও ঘটতে শুরু করেছে। এখন এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিল্লিতে একটা বাসের ভেতরে এক মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল, ঠিক তার পরপরই আমাদের দেশের বাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করল। নৃশংসতা কি অনুকরণ করতে হয়? এটা কি একটা শেখার বিষয়? মনোবিজ্ঞানীরা কি এটা নিয়ে গবেষণা করে বিষয়গুলো আমাদের বোঝাতে পারবেন?
আজকাল খবরের কাগজগুলো খোলা যায় না। মনে হয় পুরো খবরের কাগজটাই বুঝি ধর্ষণের খবর দিয়ে বোঝাই। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের নেতাদের ধর্ষণ, নানার নাতনিকে ধর্ষণ, ঈদের দিনে আনন্দোৎসবে ধর্ষণ, বান্ধবীকে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে ধর্ষণ, কমবয়সী শিশুকে ধর্ষণ শুধু খবরের শিরোনাম পড়েই একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে।
আমি মনোবিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের মানুষ নই, তাই বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ বা একটি সমাজ কীভাবে অন্যায় করে কিংবা অন্যায়কে প্রতিহত করে সেটা জানি না। কিন্তু কিছু বিষয় সব সময়ই আমাকে বিভ্রান্ত করে এসেছে। আমি একবার এক মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি, নামাজ শেষে ইমাম দোয়া করতে করতে এক সময় বললেন, যারা এই দোয়ায় শামিল হয়েছে তাদের সবার ‘গোনাহ’ যেন ‘সওয়াবে’ পরিণত করে দেওয়া হয়।
আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম, কারণ সত্যিই যদি একদিন শুধু দোয়া করে জীবনের সব পাপকে পুণ্যে পাল্টে দেওয়া যায় তাহলে সেটা কী মানুষকে অন্যায় করতে প্রলুব্ধ করবে না? সারাজীবন খুন, জখম, চুরিচামারি, অত্যাচার, অনাচার, ধর্ষণ করে জীবনের শেষপ্রান্তে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় যদি তার সব পাপকে পুণ্যে পরিণত করে ফেলা যায় সেটি নিশ্চয়ই অনেক পুণ্য লাভের সবচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি।
ধর্মের এই ব্যাখ্যা সমাজের কত গভীরে, কত ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে আমি জানি না। সেটি এই দেশের মানুষের চিন্তাভাবনার জগৎকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কেও আমার কোনো ধারণা নেই। (আমি অবশ্য পারিবারিকভাবে ধর্মের অনেক সুন্দর এবং মানবিক একটা ব্যাখ্যা শুনে বড় হয়েছি। আমি জেনে এসেছি প্রত্যেকটা মানুষের ওপর খোদার একটা হক আছে এবং মানুষেরও একটা হক আছে। খোদার হক পালন না করলে, খোদার কাছে কান্নাকাটি করে মাফ চাইলে খোদা চাইলে মাফ করে দিতেও পারেন। কিন্তু মানুষের হক পালন না করলে সেই মানুষটি যতক্ষণ পর্যন্ত মাফ না করবে ততক্ষণ কোনো মুক্তি নেই! ধর্মের এই ব্যাখ্যায় সারাজীবন পাপ করে শেষ বয়সে সব পাপকে পুণ্যে পাল্টে দেওয়া কিংবা পাপকে মুছে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই!)
যারা রূপা মেয়েটির ওপর এই নৃশংস অত্যাচার করেছে তাদের সবাইকে ধরা হয়েছে। মানুষগুলোর বাবা-মাও তীব্র অপরাধবোধে ভুগছেন, বলেছেন তাদের সত্যিকারের শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের কী শাস্তি হবে আমরা জানি না, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যাবে কিনা সেটাও আমরা জানি না।
ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তার পরও যারা ধরা পড়েছে তাদের ফাঁসির আদেশ মওকুফ হয়ে গেছে। কয়েক বছরের ভেতরেই তারা নিশ্চয়ই আরও বড় নেতা হিসেবে বের হয়ে আসবে!
কাজেই রূপার হত্যাকারী এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কী আমরা জানি না, জেলহাজতে বসে বসে তারা কী ভাবে, তাদের বিবেক দংশন করে কিনা কিংবা কোনোরকম অপরাধবোধে ভোগে কিনা সে সম্পর্কে আমি কিছু জানি না, কিছু অনুমানও করতে পারি না।
কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহূর্তে রূপার মনে কী ভাবনা কাজ করেছিল, সেটি আমরা কল্পনা করতে পারি। কমবয়সী এই মেয়েটির বুকের ভেতর নিশ্চয়ই ছিল গভীর হতাশা এবং এই বিশাল পৃথিবীর ওপর তীব্র অভিমান। এই দেশ, এই রাষ্ট্রযন্ত্র, এই সমাজ কোনো কিছু তাকে রক্ষা করতে পারল না কী ভয়ঙ্কর একটি কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো। আমি সেই কষ্টের কথা কল্পনাও করতে পারি না।
০৩.
আগস্ট মাসের আরও একটি মন খারাপ করা ঘটনা হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার। রোহিঙ্গা চরমপন্থিরা পুলিশ-মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করার পর তার প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গা মানুষদের ওপর। বাংলাদেশে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে এক দশকের বেশি সময় ধরে বসবাস করছে।
গত কয়েকদিনে রোহিঙ্গাদের ওপর রীতিমতো গণহত্যা শুরু হওয়ার পর প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে ছুটে এসেছে। এটি অনেক বড় একটি ঘটনা, সারা পৃথিবীতে এটা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। আমরা জানি এসব নিয়ে তোলপাড় হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না।
রোহিঙ্গাদের নিয়েও হইচই হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আর দায়িত্ব নেবে না, এই অসহায় মানুষগুলোকে অসহায়ভাবে এ দেশে মানবেতর জীবন কাটাতে হবে। একাত্তরের পর বিহারিরা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে কত যুগ জেনেভা ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে মনে আছে?
এই রোহিঙ্গাদের মৃত্যু উপত্যকায় ফিরিয়ে না দিয়ে মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে দেখে আমি একটুখানি শান্তি পাচ্ছি। আমি কিছুতেই ১৯৭১-এর ঘটনা ভুলতে পারি না, এ দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, যদি ভারতবর্ষ তখন আমাদের আশ্রয় না দিত তা হলে আমাদের কী হতো? ১৯৭১ সালে আগরতলার মোট জনসংখ্যা থেকে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল।
সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে মৃত্যুভয়ে কাতর অসহায় মানুষদের একটুখানি আশ্রয় দেওয়া অনেকখানি বড় কাজ। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষদের জন্য সেটা যদি না করি তা হলে কেমন করে হবে?
যে নোবেল কমিটি মিয়ানমারের জননেত্রী অং সান সু চি’কে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দিয়েছিল এখন তারা মাথা চাপড়াচ্ছেন কিনা সেটি আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, শাবিপ্রবি