ধর্ষণ লিঙ্গ করে না, করে পৌরুষ
প্রকাশ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৯ | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৫৮
দেশে কোনও যুদ্ধাবস্থা নেই, তবু আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের প্রতিটি মা এখন মেয়েকে বুকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়। আমার সোনার বাংলাদেশ অবরুদ্ধ আজ আগ্রাসী ধর্ষকামী পৌরুষের হাতে। মধ্যবয়সী নারী, তরুণী, কিশোরী থেকে আড়াই-তিন-পাঁচ বছরের শিশু, সবাই নিরন্তর শিউরে পথ চলছে সবুজে মিশে থাকা ধর্ষকামী, হিংস্র পুরুষের ভয়ে।
গ্রাম, শহর, রাস্তা, খেলার মাঠ, ফসলের মাঠ, হলুদের ক্ষেত, যানবাহন, হাসপাতাল, কর্মক্ষেত্র, সেনানিবাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, থানা, নিজের ঘর- এক ইঞ্চি জায়গাও আর বাকি নেই যেখানে একটু নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। কোথাও কেউ নেই, কোথাও কিছু নেই যাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের কন্যারা, বাঁচতে পারে এই মড়ক থেকে। এই শঙ্কার দেশে, অবিশ্বাসের দেশে কোথায় লুকোবো আমাদের কন্যাদের?
একা পুরুষ দেখলে নারী ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের, দলবদ্ধ পুরুষ দেখলেও নারী ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের। কাছেই স্কুল, তবু শক্ত করে মুঠো ধরে স্কুলে দিয়ে আসি। বাসার দারোয়ান, ড্রাইভার, স্কুলের গার্ড সবাইকে ভয় পাই। কৃষকের মেয়ে মাঠে যাবে- সে আর কোনও ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; শহরের মেয়েটি স্কুলে বা কলেজে যাবে- সে ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; গার্মেন্টস এর মেয়েটি কাজে যাবে- ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের, কাজ শেষে মেয়েটি রাতে বাসে বা ট্রেনে ঘরে ফিরবে- ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের; মেয়েকে ঘরে রেখে মা বাইরে যাবে- সে আর কোন ভয় পাচ্ছে না, ভয় পাচ্ছে ধর্ষণের।
সুজান গ্রিফিন এর মতো বাংলাদেশের প্রতিটি কন্যার ভবিষ্যত বলছে ‘আমি কখনোই ধর্ষণের ভয় থেকে মুক্ত থাকতে পারিনি’।
দুঃসময়ে যে যেমন পারে নিদান নিয়ে আসে। এই ধর্ষণ মড়ক ঠেকাতে কেউ ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে ফেলতে চাইছেন, কেউ কেমিক্যাল ক্যাসট্রেশন এর কথা বলছেন। এই প্রক্রিয়ায় কখনও কখনও কাজ হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। আমি বরং মনে করি, রোগটা যেখানে, ঠিক সেই সেখানটাতেই ওষুধটা পড়া জরুরি।
ধর্ষণকে শুধুমাত্র ধর্ষিতার সমস্যা বলে একপাশে সরিয়ে রাখলে আর চলবে না। সময় এসেছে ধর্ষিতার পাশাপাশি ধর্ষকের দিকে মনোযোগ দেওয়ার। ধর্ষণ ও এর মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে লৈঙ্গিক সম্পর্ক ও রাজনীতি এবং পুরুষের সামগ্রিক মূল্যবোধের আলোকে। আমাদের বুঝতে হবে এই পুরুষদের মনস্তত্ত্ব কীভাবে কাজ করে, তাদের চিন্তা, আচরণ এবং কল্পনাশক্তির ওপর পুরুষতন্ত্র কী ধরনের প্রতিক্রিয়া করে।
এটা তো প্রমাণিত সত্য যে, এই ধর্ষকাম, আগ্রাসন, হিংস্রতা শুধুমাত্র পুরুষের লিঙ্গে তৈরি হয়নি। বরং এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষের মগজে ‘পৌরুষ’ নামে এই ধর্ষকাম আর আগ্রাসন এর বীজ বপন করেছে, তাকে যত্ন করেছে, বড় করেছে। সেই ‘পৌরুষ’ এর ফল ভোগ করছি আমরা নারীরা।
কেইট মিলেট প্রথম বলপ্রয়োগ নামে ধর্ষণ বিষয়টি আলোচনা করেন এবং দেখান যে, ‘নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশলগুলোর একটি হচ্ছে ধর্ষণ’। এই যে বিশাল সংখ্যক পুরুষ, যারা প্রতিনিয়ত শিশু ও নারীদের ধর্ষণ করছে, নৃশংসতা করছে, হত্যা করছে, তা কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে করছে না। বরং নিজের চাহিদা মেটানোর জন্য, পরিস্থিতিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য হিংস্রতার আশ্রয় নেওয়াটা এই পুরুষদের কাছে একটা সঠিক পদক্ষেপ এবং পৌরুষের প্রকাশ। কারণ, ধর্ষণ যতোটা না অবদমিত কামের প্রকাশ, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ নারীবিদ্বেষের।
এই ধর্ষকাম আর নারীবিদ্বেষ আমরাই তৈরি করেছি আমাদের ছেলেদের মনস্তত্ত্বে। দুটো সন্তানের ভেতরে লিঙ্গের বিভাজন তৈরি করে একজনকে বলেছি, তুমি ছেলে, তুমি পবিত্র, শক্তিশালী, তেজস্বী, উচ্ছৃঙ্খল, শৌর্যশীল, কর্তৃত্বকারী। সে দেখলো, তার ‘শিশ্ন’ নামক একটি অঙ্গ আছে যার কোনও ভয় নেই, লজ্জা নেই বরং গর্ব আছে, শৌর্য আছে। সে দেখলো শিশ্নের নাম দেওয়া হয়, খেলা করা হয়, ঘুঙুর পরানো হয়, পূজা করা হয়, অগ্রভাগের চামড়া কর্তনের উৎসব করা হয়।
নিজ ঘরেই পুরুষ দেখেছে ‘স্ত্রীলিঙ্গের’ ভার নিয়ে মেয়েদের ভীত হয়ে, কুঁকড়ে থেকে, বিব্রত, লজ্জিত, অবাঞ্ছিত, অসহায়, অধস্তন হতে। সে জেনেছে, মেয়ে অপবিত্র, তাকে শরীর লুকিয়ে রাখতে হয়, নত হতে হয়, লজ্জাশীল হতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গপাঠ এভাবেই তাকে ধীরে ধীরে করে তুলে প্রবল পরাক্রমশালী পুরুষ, যার যৌনতা নির্ভর করে কেবল তার স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ লিঙ্গের ওপর, নারী সেখানে ‘কর্ম’ মাত্র।
ব্রাউনমিলান এর ভাষায়, ‘‘পুরুষতন্ত্র ‘পৌরুষ’কে দেখে যে মুগ্ধ চোখে, তাতে গড়ে উঠে এমন গণমনস্তত্ত্ব- যা ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। পুরুষতন্ত্র যৌনক্ষমতাকে সম্মানিত করেছে, পুরুষ তাকে ক্যাপিটালাইজ করেছে। এই সমাজ এমন করে পুরুষ নির্মাণ করেছে যেখানে পুরুষের সমস্ত শক্তি, বিশ্বাস, সাহস ওই একটি লিঙ্গে পড়ে থাকে। যৌনতাকে কীভাবে পৌরুষের-মূল শক্তি হিসেবে প্রকাশ করে তা পথের মোড়ে মোড়ে যৌনশক্তিবর্ধক ওষুধের প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন ও বেচাকেনা দেখলেই বোঝা যায়।
যে সমাজের বিজ্ঞাপনচিত্রে যৌনসক্ষমতাকে ‘আসল পুরুষ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যে সমাজে শান্ত ছেলেরাও ‘মাইয়ালি বা মেয়েলি’ বলে আগ্রাসী পুরুষের ঘৃণা আর র্যাগিং এর শিকার হয়, সে সমাজ বাই ডিফল্ট ধর্ষক তৈরির কারখানা। এখানে লিঙ্গ ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর হলো ‘পৌরুষ’; ধর্ষণ লিঙ্গ করে না, করে পৌরুষ।
এই পুরুষের কাছে যৌনতা যখন যুদ্ধজয়ের আবেদন তৈরি করে, তখন নারীর প্রত্যাখান বা অস্বীকার তাদের মধ্যে ভয়াবহ ইগো সংকট তৈরি করে। যেহেতু পৌরুষ হেরে যেতে শেখেনি, ‘আমি না পেলে আর কেউ পাবে না’—এই আত্মশ্লাঘা তাদের হিংস্র করে। তারা কোপায়, এসিড মারে, ধর্ষণ করে, যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে দেয়, মেরে ফেলে। এই নৃশংসতার পেছনে আত্মতৃপ্তির চেয়ে বেশি কাজ করে ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, জয় করা এবং অধীনস্ত করার মনস্তত্ত্ব।
এই লিঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের কুৎসিত উল্লাসের সৃষ্টি হয়েছে পৌরুষের ক্ষমতার কাছে নারীত্বের আত্মসমর্পন থেকে। কেবল লিঙ্গ নয়, বরং সমস্ত পৌরুষত্ব দিয়ে নারীকে ধর্ষণ করে পুরুষ। একটি মেয়েকে জোর করে, কষ্ট দিয়ে ধর্ষক যে আনন্দ পায়, মেয়েটি ব্যথায় চিৎকার করলে ধর্ষকের যে বিকৃত উল্লাস হয়, সে আনন্দ ক্ষমতার, দমন-নিপীড়নের। অসহায় নারী হাতে পায়ে ধরে বাঁচার আঁকুতি করবে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাবে, করুণা ভিক্ষা করে বলবে, ‘বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, একজন একজন করে আসো’—তবেই না পৌরুষের মহান সম্মান টিকে থাকবে। নারীত্ব হেরে গেলে পৌরুষ আনন্দ পায়, জিতে যায়।
এই মড়ক থেকে রক্ষা পেতে চাইলে পুরুষের মনস্তত্ত্ব থেকেই জীবাণু দূর করতে হবে, ঠিক এখানেই কাজ করতে হবে আমাদের। যে সমাজ, লিঙ্গপাঠ শিখিয়ে শিশুর দেহে পৌরুষ বপন করে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে গোড়াতেই। প্রথমেই ঘর থেকেই শুরু হোক প্রতিরোধ। আমাদের পুত্রদের মগজ থেকে "পৌরুষ" দূর করতে হবে। লড়াইটা সেখানেই।
মনে রাখবেন, আপনার হাতেই সে হয়তো পুরুষ হবে, নয়তো মানুষ হবে। তাই পরীক্ষা পাশের যুদ্ধের মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে এই যুদ্ধ করতে হবে আপনাকে। আপনি, আমি যদি নিশ্চিত করতে পারি আমাদের সন্তান আর যাই হোক, ধর্ষক বা ধর্ষকামী হবে না, তবে এই দেশের একটি মেয়েও আর পুরুষের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে না। মনে রাখবেন আগে আমাদের ছেলেদের বাঁচাতে হবে এই ধর্ষকামী পৌরুষ নির্মাণের নষ্ট রাজনীতি থেকে। ছেলেরা বাঁচলে তবেই কন্যারা বাঁচবে।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ