ঈদের মেন্যুতে মানুষের জন্য ভালবাসা রাখুন
প্রকাশ | ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:২৪
এবারের ঈদে আপনার মেন্যুতে কী? কলিজা ভুনা, কালা ভুনা, খাসির পায়া, বিরিয়ানি, বোরহানি? আমার এবারের মেন্যু একেবারেই আকর্ষণীয় নয়। অনেক চেষ্টার পরও আমার মেন্যু বারবার অসহায় মানুষের আহাজারিতে অদ্ভুত রকমের দীনহীন রূপ ধারণ করছে। বন্যার্ত মানুষের হাহাকার, জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে ধর্ষিত ঘাড়-মটকানো লাশ হয়ে যাওয়া একটি নারীর আর্ত চিৎকার, জন্মগত পরিচিতির কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে পানিতে ভেসে থাকা একটি নিষ্পাপ শিশুর লাশ। এই আমার মেন্যু, আমার বাড়িতে এবার নেমন্তন্ন রাখতে আপনি আসবেন কি?
খুব বিরক্ত হচ্ছেন তো? হবারই কথা। বছর ঘুরে মাত্র দুইবার ঈদ আসে। বাচ্চাকাচ্চা পরিবার পরিজন নিয়ে একটু আনন্দ করবার এমন সুযোগ তো সবসময় পাওয়া যায় না। এসময়ে এসব মানবতার বুলি শুনতে কার ভাল লাগে? স্বয়ং স্রষ্টা বলে দিয়েছেন আপনাকে এই দিনে আনন্দ করতে, এইই আপনার ধর্ম। কেন আপনি আমার মত অর্বাচীনের অধর্মের কথায় কান পাতবেন? কিন্তু আপনার দেশের কাঁটাতারের ওপারে যে শিশুটি লাশ হয়ে পানিতে ভাসছে তার মা বাবা-ও আপনার মতই স্রষ্টার বাণীতে বিশ্বাসী। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে স্রষ্টার দয়া আজ আপনার সাথে, আপনার ঘরে, আপনার শিশুর নিরাপত্তায় নিয়োজিত। ঐ শিশুটিকে স্রষ্টা আজ ত্যাগ করেছেন কোনো এক অকল্পনীয় অপরাধে।
আপনি হয়তো একথার সাথেও দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। অকল্পনীয় কেন? আমরা কি জানি না রোহিঙ্গারা কত অসভ্য, অপরাধপ্রবণ, পলায়নপর একটি জাতি? এদের কথা ভেবে কেন আপনি নিজের ঈদের আনন্দ মাটি করবেন? ওদের প্রাপ্য শাস্তিই ওরা পাচ্ছে। এমন অপরাধপ্রবণ একটা জাতি এভাবে তিলে তিলে নির্যাতিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেই পৃথিবীর মঙ্গল। এদের নারীরা ধর্ষিত হলেও কিছু যায় আসে না। এমন একটা জাতির শিশুরাও আপনার কাছে অপরাধী। বিষাক্ত ফলের বীজ তো মিষ্টি হবার কথা নয়।
আপনি বলতে পারেন আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি। আপনি এতোটা নির্মম নন। রোহিঙ্গাদের কষ্ট দেখে আপনারও খারাপ লাগে, আপনিও চান ওদের সমস্যার সমাধান হোক। কিন্তু আপনি ভাবেন দায়টা কি শুধু আপনার দরিদ্র দেশ বাংলাদেশেরই? কেন জাতিসংঘ কিছু করছে না? কেন মিয়ানমার সরকার এদের জন্য কিছু করছে না? কেন বাংলাদেশকেই তার নিজের অনেক সমস্যার গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মত একগাদা রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হবে? ইতিমধ্যে কি এরা বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে যথেষ্ট অশান্তি সৃষ্টি করেনি? আপনি আপনার নিজের শিশুর জন্য একটি নিরাপদ দেশের, একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার, একটি নির্ভরযোগ্য অর্থনীতির স্বপ্ন দেখেন। কোথাকার কোন অসভ্য বর্বর এক জাতির থেঁতলানো আর পচে গলে ফুলে যাওয়া শরীরগুলো নিয়ে আপনার মাথা ঘামালে চলবে কেন? বিশেষ করে যখন আপনি জানেন আপনার শিশুর জন্য কল্পিত সুন্দর জীবনের সম্ভাবনাকে এরা নষ্ট করে দিতে পারে।
আপনি আরো বলতে পারেন আমি শুধু শুধুই আপনাকে বিদ্রুপ করছি। আপনি মহানুভব না হতে পারেন, কিন্তু অমানুষও নন। আপনি চান রোহিঙ্গা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হোক, এবং বাংলাদেশে এদেরকে আশ্রয় দেয়া মোটেই এর কোন স্থায়ী সমাধান নয়।
আপনি এবং আপনারা অনেক বলেছেন, এবার আমার বলার পালা এবং আমি প্রথম যে কথাটি বলব তা হচ্ছে আপনি চরম স্বার্থপর। মানুষের জীবন যখন বিপন্ন, আশ্রয়পার্থী নারী ও শিশুরা বিফল হয়ে পানিতে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে, আপনি তখন বাংলাদেশ নামক এক টুকরা জমির উপর নিজের মালিকানার গর্ব ও গৌরবে অনুপ্রাণিত হয়ে রোহিঙ্গাদের মত মাদকপাচারকারীদের আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশের জন্য কতটা অসমীচীন হবে সেই বিষয়ে ফেসবুকে একখানা স্ট্যাটাস মেরে বাচ্চাদের নিয়ে ঈদের শপিং করতে যাচ্ছেন। আপনার বাচ্চারা যদি জানতো নাফ নদীতে ভেসে থাকা তাদেরই বয়সের একটি শিশুর মৃত্যু আপনার মানবতাকে জাগাতে পারে না, তারা আপনাকে ঘৃণা করতো।
আপনার দৃষ্টিতে সকল রোহিঙ্গা মাদকপাচারকারী, তাদের শিশুরাও মাদক পাচারকারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। আসলে নিজেকে বিবেকের দংশনের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আপনি। এদের গায়ে অপবাদের কালি লেপে দিতে পারলেই এদেরকে ভুলে থাকাটা সহজ হয়, কিন্তু দীর্ঘকালের নিগ্রহ আর নিপীড়ন যে মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় তা কি আপনি জানেন না? মানুষ হিসেবে এসব বন্ধের জন্য আমাদের কি কোন দায় নেই?
কেউ কেউ আবার বলছেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের এই দুর্দিনে সকল মুসলমানদের এগিয়ে আসা উচিত, বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলিম পরিবারের উচিত একটি করে রোহিঙ্গা পরিবারকে আশ্রয় দেয়া। এসব যদিও কথার কথা তারপরও মুসলমানদের সাহায্যে শুধুমাত্র মুসলমানদেরকে এগিয়ে আসার ডাক দেয়ার মাধ্যমে আপনারা যে মানুষের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে তোলেন সেটা বোঝেন? মুসলমানরা মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসার অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটা হচ্ছে নিজেদের সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধি করা। যদিও অনেকে সচেতনভাবে এটা ভাবেন না, অর্থটা এরকমই দাঁড়ায় এবং এই ইঙ্গিতটি খুব একটা শুভ নয়।
নজরুলের কবিতা বুক ফুলিয়ে অনেক আবৃত্তি করেছি আমরা ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম/ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র!’ মানুষ মরছে, মানুষ তার জন্য কাঁদবে, পারলে কিছু করবে। এখানে হিন্দু মুসলমানের প্রশ্ন আসে কেন?
আপাতদৃষ্টিতে বিজ্ঞ সমাজসচেতন একজন নারী মন্তব্য করেছেন, ‘রোহিঙ্গারা পলায়ানপর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। এরা মুক্তিকামী জনতা নয়। এরা এদেশে ঢুকতে চায় পরগাছা হয়ে বাঁচার জন্য। এই ভীরু, কাপুরুষ, অধিকার সচেতনহীন জনগোষ্ঠীর সাথে আমাদের ৭১ এর মুক্তিকামী জনতার তুলনা কি করে করি আমরা?’
আমি জানিনা একটি জনগোষ্ঠীর সমস্ত মানুষ সম্পর্কে এরকম একটি মন্তব্য কীভাবে করা যায়? আজ যে শিশুগুলোকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তাদের কারো মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল না বলে আমরা কীভাবে বলতে পারি? মিয়ানমারে বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী বলে বিবেচিত এই জনগোষ্ঠীর পায়ের নিচে বস্তুতপক্ষেই মাটি নেই। তাদেরকে নাগরিক বলেই স্বীকার করে না রাখাইনের তথা মিয়ানমারের বৌদ্ধরা। তাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নির্যাতন, গণহত্যা, ধর্ষণের কথা বহির্বিশ্বের কাছে অস্বীকার করে দেশের সরকার এবং তারা জাতিসংঘের তদন্তকারী দলকে ভিসা দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এই ব্যাপারে আমি যা বলতে চাই তা ফেসবুক বন্ধু চৈতী আহমেদ চমৎকার ভাবে প্রকাশ করেছেন তার একটি লেখায়, ‘নাফ নদীতে ভাসমান মৃত শিশুটির দিকে তাকাতে না পেরে আমার মনে হয়েছে, মানুষের পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে ঐ মানব শিশুটির অধিকার ছিল। ওর নাগালের মধ্যে বাংলাদেশের ভূমিতেও ওর মানবিক অধিকার ছিল। কোনো অজুহাতেই তাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের পুশব্যাক করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার আমি বা আমরা কেউ নই। এতোদিন আমার জন্মভূমি বলে আমি ভূমিটি কুক্ষিগত করে রেখে কিছু মানুষকে মরার জন্য বন্দুকের মুখে, নাফ নদীর পানিতে ভাসতে বাধ্য করেছি, আমি অন্যায় করেছি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে দেয়া হোক। রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা বন্ধ করা হোক। পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক’।
রোহিঙ্গাদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলে মনে করা হয়, যাদের কাছে পৃথিবীর সব দরজাই যেন বন্ধ হয়ে আছে। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত, প্রতিবেশী দেশ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত, আন্তর্জাতিক সাহায্য লাভে অক্ষম এই মানুষগুলোর বাংলাদেশে পালানো ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। নিজেদের উন্নয়নের কথা ভেবে আমরা যদি এদের পাশে না দাঁড়াই তবে ইতিহাস আমাদের সম্পর্কে কী বলবে? যে দেশটি মাত্র কয়েক দশক আগে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, অসংখ্য নারীকে ধর্ষিত হতে হয়েছে যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সেই দেশের মানুষ অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াতে শেখেনি? শুধু কূপমন্ডুকের মত নিজের স্বাধীনতা নিয়েই গান গাইতে শিখেছে?
রোহিঙ্গাদের হয়তো ঘরে ডেকে তুলবো না আমরা কেউই, তবুও বলব এবারের ঈদের মেন্যুতে নিজেদের শিশুদের জন্য ভুরিভোজনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য অন্তত কিছুটা মমতা রাখুন, ভালবাসা রাখুন, দুই ফোঁটা চোখের পানি রাখুন, আন্তর্জাতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে এদের আশ্রয় দেবার ব্যাপারে সমর্থনটুকু অন্তত রাখুন।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক