ধর্ষণের মহামারী ও পরিত্রাণের উপায়
প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০১৭, ২৩:৩৭
একসময় পত্রিকার পাতা খুলতেই এসিড সন্ত্রাসের খবর দেখতে পেতাম। মুহূর্তেই একজন রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে উঠতো অস্পৃশ্য। রাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে মানুষ বেছে নিয়েছিলো এই নোংরা পথ। দেশে এসিড সহজলভ্য ছিলো, তাই যেখানে সেখানে আক্রান্ত হয়েছে মানুষ, বলা ভালো নারী ও শিশু। পুরুষ এসিডের শিকার হয়েছেন কি না বলতে পারছি না। তবে একজন নারীকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেয়ার এই প্রয়াস ভীষণ কার্যকরী।
ক্যাম্পাসেও দেখেছি, যে মেয়ের প্রেমে কেউ হাবুডুবু খেতো, যার সম্পর্কে একটা কটু কথাও সে শুনতে পারতো না, প্রেম নিবেদনে সাড়া না পেয়ে সেই নারীই হয়ে উঠতো পৃথিবীর নিকৃষ্টতম নারী। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এমনকি সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়েও এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন নারী। এক সময় এই বীভৎসতা মহামারীতে রূপ নিলে সরকার আইন করে এর কঠোর শাস্তির বিধান করে। আর ব্যাটারি থেকে যত্রতত্র এসিড পাওয়া যেতো বলে ব্যাটারি পরিবর্তনের সময় পুরণো ব্যাটারি জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয় তখন থেকেই। সেই সাথে পুরণো ব্যাটারির একটা মূল্যও নির্ধারণ করে দেয় সরকার, এতে উৎসাহ দেয়া যেন মানুষ পুরণো ব্যাটারি ফিরিয়ে দেয়। মূলত কঠোর আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করায় ও তা দ্রুত বিচারের আওতায় আনায়, সেই নিষ্ঠুরতা কিছুটা হলেও কমেছে। এখন খুব বেশী শোনা যায় না।
ভারতের নয়াদিল্লীতে একটি চলন্ত বাসে একজন ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিলো। ভারত সহ বিশ্ব সোচ্চার হয়ে উঠলেও বাঁচানো যায়নি কন্যা সাহসিকাকে। ভারতে এখনো এই ধরণের ঘটনা ঘটছে, যদিও সেই ঘটনায় কড়া সাজা হলেও পার পেয়ে গিয়েছিলো একজন কিশোর অপরাধী, যে ছিলো সবচেয়ে নিষ্ঠুর! একজন কিশোর যদি এই ধরণের জঘন্য ঘটনার জন্ম দিতে পারে, সে কি বয়সের কারণে মার্জনা পেতে পারে? পাওয়া উচিত?
ভারতে সেই আলোচিত ঘটনা ঘটেছিলো ২০১২ সালে। বাংলাদেশেও এই ধরণের নোংরা একটা ঘটনা ঘটেছিলো ২০১৩ সালের শুরুর দিকে। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা আসার পথে। বাসের ড্রাইভার ও হেল্পার মিলে ঘটিয়েছিলো সেই কান্ড। কিছুদিন আগে দেখলাম নারায়ণগঞ্জে একটি কিশোরীকে (মেয়েটি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলো) পিকআপ চালক তার সহযোগীকে নিয়ে ঘটিয়েছে সেই একই কান্ড। তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে পত্রিকায় পড়েছি।
বনানীর রেইন ট্রি হোটেলে দুই ছাত্রী লাঞ্ছিত হয়েছেন আর তাই নিয়ে আপন জুয়েলার্স এর শত শত কেজি স্বর্ণ জব্দ করা নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। এর পর বনানীতে আবারো, যাত্রাবাড়ীতে, বগুড়াতে তুফান কান্ড গোটা দেশ কাঁপিয়ে দিলেও থেমে নেই ধর্ষণ! এইতো কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে দিনের পর দিন একটি তরুণীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। আসামী একজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার প্রভাব এখানে কাজ করছে।
বরগুনার বেতাগী উপজেলায় একজন স্কুল শিক্ষিকাকে শ্রেণীকক্ষে আটকে রেখে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এই দেশে ২২ মাসের শিশুকেও ধর্ষণ করা হয়! চাঁদা না পেয়ে স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্লজ্জ ধর্ষণের খবর আমরা এখন অবলীলায় পত্রিকায় পড়ছি! এমনই শত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে দেশে...
দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো নিরাপত্তা হেফাজতে, সেই শিক্ষায় বলীয়ান হয়ে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের একজন কনস্টেবল তার নারী সহকর্মীকে ধর্ষণ করায় মামলা হয়েছে। পুলিশ নিজেই এখন আসামী এবং ফরিয়াদি।
বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণী পুরান ঢাকায় খালু কর্তৃক ক্রমাগত ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করায় তা প্রকাশ্যে আসে। এই কিছুদিন আগে ঢাকার বাড্ডা এলাকায় পৌনে চার বছরের তানহাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে তারই প্রতিবেশী এক দিনমজুর শিপন। মেয়েটিকে চকোলেটের লোভ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলো। চকোলেটের লোভ শিশুদের থাকতেই পারে, তাই বলে এই বিশ্বাসটুকু একটা শিশু যদি হারিয়ে ফেলে, তাহলে এই সমাজের গন্তব্য কোথায়? কয়েকজন কুলাঙ্গারের কাছেই কি তবে জিম্মি হয়ে থাকবে গোটা মানব সভ্যতা?
বাংলাদেশে প্রতিদিন অগণিত মামলা হয় নারী নির্যাতনের, যার সিংহ ভাগ আবার ধর্ষণ জনিত। কিন্তু প্রায় অধিকাংশ মামলাই শেষ পরিণতি পায় না। বলা হয় এসবের অধিকাংশ মামলা হয় কাউকে না কাউকে বিশেষ করে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য? এ কেমন হাতিয়ার?
তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তো, দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত আবাসনেও সে নিরাপত্তা পায়নি। হত্যা করা হয়েছিলো তাকে, প্রথম ময়না তদন্তে আলামত না পেলেও পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফার ময়না তদন্তে ধর্ষণের আলামত মিললেও অপরাধীর খোঁজ মেলেনি আজো। মডেল তিন্নির লাশ পাওয়া গিয়েছিলো ব্রিজের পিলারে, কেউ তাকে ধর্ষণ করে ফেলে দিয়েছিলো। তিন্নি হত্যার পর একজন সাবেক সংসদ সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কিন্তু বিচার হয়নি আজো।
জাহাঙ্গীরণগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মানিক কেলেঙ্কারি নাড়িয়ে দিয়েছিলো গোটা দেশকেই। সেই মানিক সেঞ্চুরি করেও অপরাজিত থেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকুরী হারাচ্ছেন একের পর শিক্ষক... কোথায় যাচ্ছি আমরা?
অবাধ যৌনাচারের Promiscuity যুগ অতিক্রম করেও আমরা বন্য জানোয়ারের মতো হামলে পড়ছি কেন? বলা হচ্ছে ২০০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহতম বন্যার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশ। তারপরেও পত্রিকার পাতায় পাতায় ধর্ষণের মহামারীতে অতিষ্ঠ আমরা। আইনের কোন না কোন ফাঁক ফোঁকর নিশ্চয়ই আছে, তা না হলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় একের পর এক দিন তারিখ নিয়ে কালক্ষেপণের অর্থ কি? এই দায় কার? নিশ্চিত ভাবেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার দিতে বাধ্য।
কেন বাড়ছে ধর্ষণ:
আমার মনে হয় এর জন্য কতিপয় কারণ চিহ্নিত করা আবশ্যক। যেমন:
আইনের মারপ্যাঁচ ও বিচারে বিলম্ব: আদালতে শুনেছি এমন সব প্রশ্ন নির্যাতিতাকে করা হয়, যা দ্বিতীয়বার শোনার রুচি তিনি হারিয়ে ফেলেন। বারবার সময় চেয়ে হয়রানি করা হয় আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা তো আছেই।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া: ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে তখন এই ধরণের অপকর্মে নিজেরাই জড়িয়ে পরে। এর প্রমাণ বাংলাদেশে অসংখ্য।
পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব: পরিবার থেকেই শিক্ষার সূত্রপাত। নীতি ও নৈতিকতাবোধ এখান থেকেই পেয়ে থাকে মানব শিশু। ব্যস্ততা ও পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার এই যুগে ক্রমেই বিগড়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। ধর্মীয় শিক্ষা এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপে সক্ষম।
মাদক: মাদক এখন অনেক সহজলভ্য আর নিত্য নতুন মাদকে আসক্ত হয়ে তরুণদের মধ্যে বিপথগামীতা বেড়েই চলছে।
তারুণ্যের উদ্দামতা: তরুণেরা সাধারণত বাঁধনে আবদ্ধ না হয়ে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়। উদ্দামতায় অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ থ্রিল ভাবছেন।
মুক্ত সংস্কৃতির প্রভাব: তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সংস্কৃতি এখন উন্মুক্ত। অযাচিত ও অস্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি সিরিয়াল, ছবি ও গল্পে কেউ প্রভাবিত হয়ে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
অনলাইনের সম্পর্ক: আমরা অনেকেই অপরিচিত হয়েও খুব কাছে চলে আসছি অনলাইনের যুগে। এই সুযোগে ধর্ম, চিকিৎসা, পরামর্শের নামেও নারীদের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এর বাইরেও আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। মোটাদাগে এই কারণগুলোই এখন মনে হচ্ছে এই মহামারীর জন্য দায়ী। এর জন্য শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সুশীল সমাজকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
দ্রুত বিচার মানে দ্রুততম সময়েই এই সব মামলা পরিচালনা করা হউক। প্রয়োজনে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন আইনজীবীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী প্যানেল করে এই সব মামলা পরিচালনা ও মামলার কার্যক্রম কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ধর্ষণের এই মহামারীর বন্ধ না হলে সমাজিক বিপর্যয় আসন্ন।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী