পুরুষ রচিত ধর্ম, বিকলাঙ্গ নারী

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০১৬, ০১:৩৯

নারী কি কেবলই যৌনদাসী? সমাজ সংসারে কড়াই খুন্তির সংসারে নারীকে দাসী রূপে আবদ্ধ করে রাখা হয়। এর পিছনে দায়ী কি? দায়ী আমাদের মানসিকতা। ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা, সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের নোংরা মানসিকতা। আর এই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দায়ী ধর্ম। ধর্মের ছায়া তলেই পিতৃতন্ত্র সমাজ আজও রাজত্ব করে চলছে।

মেয়েরা নষ্ট হবেই হবে। সে কিছু করুক বা না করুক। হাজারো অন্যায় করলেও পুরুষের চরিত্র নষ্ট হয় না, হবেও না। কারণ পুরুষের চরিত্রের রক্ষা কবচ পরিয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর। ধর্মগুলো দিয়েছে পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব। আর এই সমাজ-রাষ্ট্র সেসব মেনেই বানিয়েছে প্রচলিত নিয়ম কানুন।

বাইরে আমরা যত উদারতার কথা বলি না কেন, ভেতরে কিন্তু ততটা উদার নই। আর সমস্যাটি ঠিক সেখানেই। যার ফলে কোনও বিষয় বা ঘটনা যখন বিশ্লেষণ করি, তখন তা একপেশে হয়ে যায়। এক পক্ষের হয়। অন্য পক্ষের কথা আমরা শুনি না। দেখি না। বলি না। ভাবতেও চাই না।

আজকাল আমরা যে নারীবাদের কথা বলছি তা কিন্তু ‘পুরুষতান্ত্রিক নারীবাদ’ হয়ে আছে। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা-বিশ্বাস, সংস্কার ও সংজ্ঞার বাইরে নারীরাও যেতে পারে নি। ফলে নারী যতোই প্রতিবাদী হোক পুরুষের শিখিয়ে দেওয়া পুঁথি, বিদ্যাই তাদের যুক্তি। এই যুক্তি পুরুষের হাতেই অস্ত্র তুলে দেয়। আর নারী হয় আত্মঘাতী।

এই নারীবাদ নারীকে মানুষ বলে ভাবে না, ভাবে সে কেবল ‘মেয়েমানুষ’, সে একজন নারী। এখন সময় বদলেছে কিন্তু বদলায়নি এই সমাজ। এই সমাজে এখনো পুরনো বস্তাপচা রীতিনীতি, বিশ্বাস, পুঁথিগত সংজ্ঞাকে আঁকড়ে ধরে আছি আমরা। প্রথাগত ধারণার বাইরে এসে যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে, বাস্তবতা দিয়ে অনেকেই বুঝতে চাই না। এখনো নারী-পুরুষ উভয়ের চিন্তার পায়ে ধর্মের শেকল জড়ানো। ভাবনার রন্ধে রন্ধে মন্ত্র শেখায় পুরুষতন্ত্র।

ধর্ষণ একটি অসভ্য যৌন আচরণ। সহজভাবে বললে, অসভ্য যৌন আক্রমণ। অথচ ধর্ষণের এই সংজ্ঞাটিই ভীষণ রকমের পুরুষতান্ত্রিক। এই সংজ্ঞা যতদিন থাকবে, ততদিন নারী ধর্ষিত হবে, অসম্মানিত হবে, অপমানিত হবে ও নির্যাতিত হবে।

ধর্ষণ সংজ্ঞাই নারীকে সম্ভ্রমহানির গুহা থেকে বেরোতে দেয় না। এই সংজ্ঞায় যৌনতা ও যৌন আক্রমণের সব ক্ষমতা চলে যায় পুরুষের কাছে। পুরুষ তখন ক্ষমতা ভেবে, আধিপত্য ভেবে আরও অধিক মাত্রায় ধর্ষণ করতে থাকে। অথচ বোকা নারীরা বোঝেন না, এই সংজ্ঞাটি মেনে নেওয়াই তাদের জন্য চরম অবমাননাকর।

প্রতিনিয়ত কোন না কোনভাবে পুরুষ দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারী। পৃথিবীতে প্রতিদিন ঘরে-বাইরে অসংখ্য নারী ধর্ষিত হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার নারী যৌনাঙ্গের ব্যথা নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তা আমরা ক’জন শুনতে পাই, বুঝতে পারি?

দিন বদলেছে, এ কথার মধ্যেই যেন আমরা সীমাবদ্ধ। অথচ একবারও ভাবছি না যে, দিন বদলেছে, এবার আমাদেরকেই বদলাতে হবে এই সমাজ। বস্তাপচা, ঘুণে-ধরা এই সমাজ নিয়ে ভাবতে হবে নতুন করে। ভাঙতে হবে একপেশে সমাজ ব্যবস্থা, গড়তে হবে সমতার সমাজ, পৃথিবী। বিশ্বাস করতে হবে উদারতায়, মানবতাবাদে। বিশ্বাস করতে হবে নারী-পুরুষ নয়, সকলেই মানুষ। ফলে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে-পুরুষের জন্য যা প্রযোজ্য, নারীর জন্য তা নয় কেন?

আমরা নারীকে যৌনবস্তু ভাবি, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ভাবি, যৌন বিলাসে ব্যবহার করি। কোন নারী যদি সন্তান উৎপাদনে অসমর্থ হন, তখন চারপাশের মানুষ তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। নারী কি কেবল সন্তান উৎপাদনেরই যন্ত্র? তাকে সন্তান উৎপাদন করতেই হবে। সে সন্তান উৎপাদন করতে বাধ্য।

ধর্মও সন্তান ধারণে ব্যর্থ নারীদের প্রতি দিয়েছে নির্মম নির্দেশ। যা রীতিমতো ভয়াবহ। যা প্রকৃত মানুষ কখনোই মেনে নিতে পারবে না। আর এমন নির্মম কথা যে ধর্ম বলে সে ধর্ম আর যা হোক নারীকে সম্মানিত নয়, করেছে চরমভাবে অপমান, অপদস্থ।

যেমন ‘মাকিল ইবন্ ইয়াছির হতে বর্ণিত একজন মানুষ নবীর কাছে এসে বলল, "আমি একজন উচ্চ বংশীয় সুন্দরী নারীর সন্ধান পেয়েছি কিন্তু সে সন্তান দিতে অপারগ, তাকে কি আমার বিয়ে করা উচিৎ? নবী উত্তর দিলেন, 'না'। লোকটি আবার নবীর কাছে একই বিষয়ে আবার জিজ্ঞেস করল এবং নবীর উত্তর হলো, 'না'। সে তৃতীয়বারের মত আবার আসলো। নবী বললেন, "উর্বর গর্ভ বিশিষ্ট সুন্দরী নারী বিয়ে করো, কারণ আমি তোমাদের দ্বারা আমার অনুসারী বৃদ্ধি করবো"। আবু দাউদ, বই -১১, হাদিস-২০৪৫

পুরুষের যৌন সুখের জন্য নারী কতকাল আর যৌন-বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হবে? নাকি আপনিও ভাবেন, নারীর কাজ তো তাই যৌন-ক্রিয়া আর সন্তান উৎপাদন? আমরা এ জাতীয় ধারণায় বন্দী অনেককাল ধরেই। তাই নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়, পুরুষের যৌন লালসা একজন নারীকে প্রতি মূহুর্তে বিব্রত করে, অসম্মানিত করে।

ধর্ম এবং সামাজিক অবকাঠামো আমাদের শেখায়-স্ত্রী হলো স্বামীর সম্পত্তির মতো। হাঁটা-চলার সময় পুরুষরা স্ত্রীদের গণিমতের মালের মতো বগল দাবা করে রাখেন। কারো দিকে তাকালেও সন্দেহ, আপত্তি।

একজন নারী বিবাহিত বা অবিবাহিত যাই হোক না কেন, সে কি স্বাধীন? না। অবিবাহিত জীবনে নারীকে হয় বাবা নয় তো ভাইয়ের অধীনে থাকতে হয়। আর বিবাহিত জীবনে স্বামীর অধীন তাকে থাকতেই হবে। আবার বয়োবৃদ্ধ হলে ছেলের অধীনে থাকতে হয়। এটাই বাস্তবতা।

একজন নারী কোথাও একা ঘুরতে পারেন না, বেড়াতে পারেন না সঙ্গে স্বামী, ভাই, বাবা, মা কাউকে ছাড়া। যদি বিবাহিত অথবা অবিবাহিত কোনো নারী একা একটু বাইরে বের হয় তবে সন্দেহের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, নানা রকম প্রশ্ন তাকে জর্জরিত করবেই। জোড়া জোড়া চোখ লাল করে জানতে চাইবে ‘তুমি কোথায় ছিলে, কার সঙ্গে গিয়েছিলে, কেন গিয়েছিলে’? এমন আরো হাজারো প্রশ্ন। অথচ সমাজ-সংসার বুঝতে চায় না প্রতিটি মানুষের জীবনে কখনও কোন সময় একাকীত্বেরও প্রয়োজন হয়।

একজন স্বামীর কাছে তার স্ত্রী কেবলই যৌনদাসী। অথচ যৌনতার বিষয়টি যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। ক’জন স্বামী আছেন বোঝেন স্ত্রীকে, বুঝতে চান নারীকে? নারী তো তাদের ধারণায় যৌন বস্তুই। তাই স্বামীর দরকারে তাকে আসতেই হবে। ইচ্ছে না থাকলেও শুতে হবে। ধর্মও পুরুষকে তাই বলে দিয়েছে! যেমন,

"স্বামী স্ত্রীকে আহবান করলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে হবে, যদিও স্ত্রী চুলার পাশে বসে থাকুক তবুও"। (তিরমিযি, তাগরীব-৩/৩৮)

আবার,

"স্বামী তাহার স্ত্রীকে স্বীয় বিছানায় আসিবার জন্য ডাকিলে যদি স্ত্রী স্বামীর ডাকে সাড়া না দেয় (এবং স্বামী তাহার প্রতি অসন্ত্তষ্ট হয়) তবে ভোর পর্যন্ত সারা রাত্র ফেরেশতাগণ ঐ স্ত্রীর প্রতি লানৎ ও অভিশাপ করিতে থাকেন"। (বুখারি,২/২৮২)

এছাড়াও 

কোরানে মেয়েদের সংজ্ঞায়িতই করা হয়েছে শস্যক্ষেত্র হিসেবে, "তোমাদের স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্যে (সন্তান উৎপাদনের) ফসল-ক্ষেত্র, তোমরা তোমাদের এই ফসল-ক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই গমন করো"। (সূরা আল বাকারা, ২:২২৩)।

সোজা কথায় নারীর স্বার্থ কখনও পুরুষ দ্বারা রচিত ধর্ম দেখেনি; দেখার কথাও নয়। তাই প্রচলিত সবগুলো ধর্মগ্রন্থ আতিপাতি করে খুঁজেও পুরুষতান্ত্রিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে এমন একটা শব্দও পাওয়া যাবে না। আসলে পুরুষের চোখ নারীকে যেভাবে দেখে, দেখতে ভালোবাসে, যেমন করে নারীকে পেতে চায় ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঠিক সেভাবেই সাজানো হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক আল্লাহ/ঈশ্বর/গড ভয়ানক এক চোখা! ভয়ানক রকম পুরুষতান্ত্রিক নারীলোভী; আবার আর সেই পরিমাণ-ই নারী বিদ্বেষী!

আর নয়। আমরা ধর্ম নয়। বিবেক বোধ দিয়ে নারীকে মানুষ ভাবতে শিখব। দিন বদলেছে। এবার সমাজ বদলানোর পালা। আসুন আজকের সভ্য পৃথিবীতে আমরা কেউ নারীকে আর যৌন বস্তু হিসেবে ভাববো না। কোনো নারী যেন যৌন নিগ্রহের, হয়রানির, অত্যাচারের, নিপীড়নের শিকার না হয়। বৈবাহিক, অ-বৈবাহিক কোনও ধর্ষণের শিকার যেন আর একজন নারীও না হয়। আসুন আমরা সমস্বরে বলি জয় হোক মানবতার।

লেখক: ব্লগার