সময় কি সুযোগ দেবে আমাদের?
প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০১৭, ০০:১৪
আমার ছেলের জন্মের পর প্রথম আমার ইংরেজি গান শোনা শুরু হয়েছিল। তার বয়স যখন তিন/চার মাস, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম টিভিতে দ্রত লয়ের বা আপবিট গান বাজতে থাকলে সে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপ করে শোনে, ঘরের কাজ করতে কোন অসুবিধা হয় না আমার। মুখে যা তুলে দেই, যতটুকু দেই আপত্তি না করে খেয়ে ফেলে।
তখন আমাদের বাসায় নতুন ক্যাবল টিভি এসেছে। দু'টো গানের চ্যানেল- এমটিভি আর জিউক বক্স। মাইকেল জ্যাকসন তার খুব প্রিয় ছিল, কিন্তু সবসময় পছন্দসই গান একটানা বাজতো না। তার পছন্দের গান রেকর্ড করে দশ/বারোটা তিনঘন্টা দৈর্ঘের ভিডিও ক্যাসেট ভরিয়ে ফেললাম। ঘরের কাজের সময় তার যে কোন একটা লাগিয়ে দিলে আর ছেলেকে নিয়ে আমাকে কিছু ভাবতে হতো না।
জানি, সন্তান পালনের ক্ষেত্রে খুব প্রশংসনীয় কোন উদ্যোগ নয়। সে যা ই হোক, একজন অল্পবয়সী মায়ের পৃথিবীতে, যাকে কোন সাহায্য ছাড়া অনেক দিক সামলাতে হতো, ইংরেজি গান একটা বিশেষ জায়গা দখল করে নিল। গানগুলো যে আমার নিজের ভাষা ও জীবন বোধ উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছিল সেটা অবশ্য তখন সচেতনভাবে বুঝিনি।
আনিস ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাকে সেই সময়ে ছেলের সাথে অসংখ্যবার শোনা একটা গানের কথা মনে করিয়ে দিল। আনিস ভাইয়ের সাথে আমার পরিচিতি ছিল না, ঘনিষ্ঠতা ছিল না। গতবছর প্রথম সুপ্রীতিদি'র মুখে আনিস ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যয় সংকুলান বিষয়ে আমি প্রথম তার কথা শুনি। পরবর্তীতে আমার এবং বন্ধুদের বিভিন্ন পোস্টে তার সংক্ষিপ্ত, মজার ও অর্থবহুল মন্তব্যগুলো পড়ে তার প্রতি ভীষণ আগ্রহ জন্মায়। সন্তান পালন প্রসঙ্গে আমার একটি পোস্টে তার একটা সুন্দর মন্তব্য আমি একটা লেখায় কোটও করেছি।
বলেছিলাম, 'পরের বার এসে আপনার বাসায় হানা দেব আনিস ভাই।' খুব খুশি হয়েছিলেন। এবার অগাস্টে দেশে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হলো না, আনিস ভাইয়ের সাথে প্রতিশ্রুত সাক্ষাতের সম্ভাবনা তার সাথেই চিরতরে মিলিয়ে গেল। একটা 'অপরিচিত' মানুষকে হারানো এতটা বেদনাদায়ক হতে পারে, কে জানতো? এক ঘরে এক ছাদের নিচে জীবন কাটিয়েও মানুষ অচেনা থেকে যায়, আবার কখনো দেখাই হয়নি এমন মানুষকেও কত চেনা মনে হয়। আপনি খুব চেনা মানুষই ছিলেন আনিস ভাই, পরিচয়টাই শুধু বাকি ছিল।
যে গানটার কথা বলছিলাম। মাইক এন্ড দ্য মেকানিকসের গাওয়া 'ইন দ্য লিভিং ইয়ারস'।
I wasn't there that morning
When my Father passed away
I didn't get to tell him
All the things I had to say
I think I caught his spirit
Later that same year
I'm sure I heard his echo
In my baby's new born tears
I just wish I could have told him in the living years
গানটা আগে অজস্রবার শুনলেও আব্বার মৃত্যুর পর এর মর্মার্থ আমার মর্মে প্রথম গভীরভাবে নাড়া দেয়। বেঁচে থাকা বছরগুলোতে তাকে যে কথাগুলো বলা হয়নি সেগুলো বলতে চাওয়ার ব্যাকুলতা অহর্নিশি আমাকে কুরে কুরে খেতে থাকে।
কত মানুষের সাথে দেখা করার সাধ থাকে আমাদের, কত জায়গায় যাওয়ার স্বপ্ন থাকে, কত কথা বলার ইচ্ছা থাকে কিন্তু সব ইচ্ছা আর স্বপ্নকে আমরা বাক্সবন্দী করে রাখি। ভাবি, সময় আছে তো, একসময় করা যাবে। কিন্তু আসলে কি সময় আছে? সময় কোথায় থাকে? তার ঠিকানা কেউ কি জানি? সময় বড় অধরা বস্তু, আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুতলয়ে হাঁটে আর হঠাৎ করেই ফুরিয়ে যায়। আনিস ভাইয়ের বিদায় আবার গানটির কথা মনে করিয়ে দিল, সেইসাথে না-বলা আরো অনেক কথা।
কত প্রিয় মানুষদের সাথে আজকাল অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে নানান রকম ছোটখাটো অগুরুত্বপুর্ণ বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি থেকে। আবার সেইসব ভুল বোঝাবুঝিও খুব ঝাপসা। আজকাল আপনজনেরা আগের মত ঝগড়া করে না, চুপচাপ দূরে সরে যায়। আমি অপেক্ষা করি একসময় সেইসব ঝাপসা ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে, তারা ফিরে আসবে। তারাও হয়তো ভাবে হাতে সময় আছে, একসময় ফেরা যাবে; বা হয়তো আমিই একসময় ফিরবো।
আমরা কেউ কারো দিকে ফিরে তাকাই না, সময়ের উপর বড় বেশি ভরসা আমাদের। তবু আমি মাঝে মধ্যে আমার অভিমানপত্রগুলো মনে মনে সাজাই। কোন দুরারোগ্য ব্যাধি ধরা পড়লেই তাদের কাছে সেই চিঠিগুলো লিখে ফেলব। যাবার আগে তাদেরকে বেশি করে কাঁদানোর ব্যবস্থা করে রেখে যাব আমি, বুঝবে তখন মজাটা। কিন্তু আসলেই কি সময় সেই সুযোগ দেবে আমাকে, অথবা তাদেরকে?
একদিন দুষ্টুমি করে বলেছিলাম মানুষের মরণোত্তর সভাটা বেঁচে থাকতে করলেই ভাল ছিল, ইন দ্য লিভিং ইয়ারস। তাহলে তারা জেনে যেতে পারতো কতটুকু ভালবাসা মেঘ হয়ে জমেছিল তাদের জন্য কিন্তু বৃষ্টি হয়ে ঝরবার ফুরসত পায়নি 'বেঁচে-থাকা সময়ে'। আনিস ভাইকেও আমি কখনো বলিনি তাকে কতটুকু ভাল লাগে, অসংখ্য অবুঝ মানুষদের সীমাহীন হাউকাউর মধ্যে তার একটুখানি বোধের জানান দেয়াটা আমাকে কতটা সাহস যোগায়। না বলা হয়নি, আর বলা হবেও না।
সময় পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। আনিস ভাইকে না বলতে পারা কথাগুলো আপনাদেরকে বলে ফেলতে হবে। আজই, এখুনি। আমার লেখা যারা পড়েন, পছন্দ বা অপছন্দ করেন, প্রশংসা অথবা তিরষ্কার করেন, আপনাদের সবার প্রতি আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। একটি পাড়াগাঁয়ের স্কুলে পড়া, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা-না-দেয়া, স্বল্পবুদ্ধির এই নারীকে অনেক মনোযোগ দিয়েছেন আপনারা। আমার যেসব কাজ আর কথা অনেক আপনজনকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, সেগুলোর জন্যই কাছে টেনেছেন আপনারা। আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন বারবার, কোন দায় ছাড়াই পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমার কাছে যাদের দেনা ছিল তারা দূরে ঠেলে দিয়েছে। আপনাদের কোন ঋণ নেই তবু শোধ করেছেন। আপনাদের জন্য ভালবাসা।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক