ধর্মে বিশ্বাস করে নারীবাদী হওয়া যাবে না!
প্রকাশ | ২২ আগস্ট ২০১৭, ২৩:০৩
বাংলাদেশে নারীবাদ আন্দোলনে যুক্ত আছেন খুবই হাতে গোনা কয়েকজন নারী ও পুরুষ। এই নারীরা প্রায়শই বিভিন্ন পুরুষবাদীদের নোংরা বীভৎস আক্রমনে জর্জরিত হন। তখন আমরা দল বেঁধে লড়াই করি, একত্র হই।
কিন্তু ট্রাজেডিটা হলো, এই অল্প সংখ্যক নারী এক্টিভিস্টগণ আবার নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভালো নারীবাদী, খারাপ নারীবাদী, সংসার করা নারীবাদী, সংসার না করা নারীবাদী, স্লিভলেস নারীবাদী, ফুলস্লিভ নারীবাদী, হিজাবী নারীবাদী, শিক্ষিত নারীবাদি, অশিক্ষিত নারীবাদী ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলে নিজেদের বিভক্ত করেন, 'এটার সাথে নারীবাদ যায় না, ওটার সাথে যায় না' না বলে ফুল স্টপ দিয়ে দেন। আর পুরুষতন্ত্রকে ভাতে পানিতে মোটা তাজা করেন।
এরকম বিভাজনের সর্বশেষ ফতোয়াটি হলো 'ধর্মে' বিশ্বাস করে আর যাই হোক নারীবাদী হওয়া যাবে না (!!!)। তার মানে নারীবাদ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার প্রথম শর্ত হলো নিজেকে ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত করে 'নাস্তিক' হতে হবে? আস্তিক বা ধর্মবিশ্বাসীরা নারীবাদ আন্দোলনে অচ্ছ্যুত?
কে কয়টা প্রেম করে, কে কি পোশাক পরে, কে সিগারেট খায়, কে সমপ্রেমী, কে বি-সমপ্রেমী, কে দাম্পত্যে থাকে, কে একলা থাকে এসব যেমন নারীবাদকে সার্টিফাই করে না তেমনি কে ধর্ম পালন করে, কে করে না তাও নিশ্চয়ই নারীবাদকে সার্টিফাই করতে পারে না। এটা খুব জাজমেন্টাল আচরণ।
যাই হোক, আলোচনাটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মুল আলোচনায় যাওয়ার আগে স্বীকার করে নিই যে, পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থই নারী এবং পুরুষের জন্য সমান অধিকারের কথা স্বীকার করেনি। আবার এটাও সত্য যে, নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য, পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য ধর্মই একমাত্র নিয়ামক নয়। এর জন্য আরো অনেক শক্তিশালী মাধ্যম যেমন, আইন, ধর্মগ্রন্থ, সাহিত্য, ভাষা, গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞান এসবও নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরুষ। পুঁজিবাদ সেই নিয়ন্ত্রণের কাঠি নেড়েছে।
এর কোনটাই আমরা পুরো অস্বীকার করি না বা করতে পারি না। আমরা শুধু পারি ধর্ম বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে। অথচ ধর্ম বিষয়টা একান্তই স্বাধীন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। খেয়াল করুন, আমাদের আইন কিন্তু নিজেই একচক্ষু এবং পুরুষতান্ত্রিক। অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে আপনি ধর্মকে অস্বীকার করলেও, আইনকে মেনে চলতে বাধ্য হন।
আপনি কি নারীবাদ করতে গিয়ে প্রচলিত আইনকে অমান্য করতে পারেন? পারেন না। যেমন মুসলিম বিয়ে চুক্তিতে দেনমোহর এর বিধান আপনি আইন অনুযায়ী মেনে নিয়েই যদি 'বিয়ে' করতে চান। 'একত্রবাস' আবার সে আইন মানে না। কিন্তু আইন সংশোধনের জন্য লড়াই আপনি করতে পারেন।
ধর্মীয় বিধান, আচার, প্রথাও কিন্তু যুগে যুগেই পরিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে। ধর্ম বিশ্বাসীদের হাতেই হচ্ছে। লড়াইটা সেটাই। উদাহরণ দিই, মুসলিম ধর্ম, মুসলিম আইন এবং প্রথা একযোগ হয়ে পুত্র এবং কন্যাকে সম্পত্তির সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এবং তার জন্য কিছু হালকা যুক্তিও রেখেছে। কিন্তু আমি যদি সেই যুক্তির বিপরীতে আরো গ্রহণযোগ্য যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করে, আমার সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তির সমান বন্টন করি, তা করতে পারবো না এমন বিধান কিন্তু কোথাও নেই। আমি লড়াইটা ঠিক ওখানটাতেই করি।
ধর্মকে উড়িয়ে না দিয়ে লজ্যিকাল করি, ক্ষেত্র বিশেষে চ্যালেঞ্জ করি। তাই ধর্মগ্রন্থের যেখানে পুরুষকে নারীকে 'প্রহার' করার 'অধিকার' দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমি যেমন চড়া গলায় প্রশ্ন তুলি। আমার অনেক লেখাতেই। সে প্রশ্ন আমি স্পষ্ট করেই তুলেছি। আবার তেমনই করুণাময়ের অবদানকে স্বীকার করে নত হতে আমার কখনো সমস্যা হয়নি।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের একজন কর্মি হিসেবে আমার কাজ হলো যে সব প্রতিষ্ঠান বা প্রথা বা আচার বা বিধান নারীর প্রতি বৈষম্য করছে, সেই বৈষম্যগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা, পরিবর্তন করা। আমি সেই কাজটাই আমার ব্যক্তিজীবনে, পরিবারে করার চেষ্টা করি। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীতে কিছুই অপরিবর্তনশীল নয়। না ধর্ম, না আইন, না কেতাব। আমি আরো বিশ্বাস করি, "মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন"।
ধর্ম বিষয়টাই মানুষের স্বাধীন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। আপনি ধর্ম মানেন না, আমি মানি। আপনার না মানা নিয়ে যেমন আমি জাজমেন্টাল হই না, আমার মানা নিয়েও আপনি জাজমেন্টাল হতে পারেন না। আমার স্বাধীন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে কোন 'বাদ' বা 'আন্দোলন' যায় না বলে ঘোষণা দিয়ে আমার সারাজীবনের নারীর অধিকারের জন্য লড়ে যাওয়াটা ইনভ্যলিড করে দিতে পারেন আপনি? কে সেই অধিকার দিয়েছে আপনাকে?
যে মেয়েটি নিজের ইচ্ছায় হিজাব পরে, কিংবা বিকিনি পরে এবং তার নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার লড়াইটিও করে, তাকে উড়িয়ে দিবেন আপনি? সে 'নারীবাদী' নয়, এমন সার্টিফিকেট কি আপনি/ আপনারা দিতে পারেন আদৌ? নারীবাদ কি নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের, নিজস্ব বিশ্বাস যাপনের অধিকারকে স্বীকার করে না?
এবার আসি মুল কথায়। ব্যক্তিগত জীবনে আমি ধর্মবিশ্বাসি মানুষ এবং ধর্মিয় আচার প্রথা যতোটুকু সম্ভব পালন করি যতোক্ষণ তা আমাকে 'নারী' হিসেবে আমার অধিকারকে কোনভাবে সংকুচিত না করে, বৈষম্য আক্রান্ত না করে। হ্যাঁ, আমার কাছে ধর্মাচরণ এবং ধর্মগ্রন্থপালন আলাদা বিষয়।
আমি বিশ্বাস করি, পরম করুণাময় মহাপ্রভু কেউ আছেন। আমি দিনের শেষে তাঁর কাছে নত হই। আমি নত হই, এই মানবজীবনের জন্য, আমার সুন্দর তিনটা সন্তানের জন্য, আরো হাজার হাজার মানব সন্তানের উপকার করার সক্ষমতা আর সুযোগ দানের জন্য।
আমি বারবার তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ হই আমার যা কিছু আছে তার জন্য। যা কিছু নেই তার জন্যও। যা কিছু ভালো হয় তার জন্য, যা কিছু খারাপ হয় তার জন্যও। আমি বারবার করুণাময়ের করুণাকে স্বীকার করি, আমার সুস্থতার জন্য, সচ্ছলতার জন্য, আমার সুন্দর হাত চোখ পা মাথা সবকিছুর জন্য, যেগুলো পলকেই হারাতে পারি আমি। জ্বি, এটুকুই আমার ধর্মবিশ্বাস।
আপনার মতো শক্ত হৃদপিন্ড আমার নেই বলে আমি বলতে পারি না, "কোন মহাশক্তি আমাকে করুণা করেনি, যা করেছি আমিই অর্জন করেছি"। বরং আমার দুর্বল হৃদপিন্ডের কারণেই আমি বারবার স্মরণ করি,
আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।।
তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে,
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে;
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ,
প্রতিদান কিছু চাওনি।।
আমায় রাখিতে চাও গো, বাঁধনে আঁটিয়া,
শতবার যাই বাঁধন কাটিয়া।
ভাবি ছেড়ে গেছ, ফিরে চেয়ে দেখি,
এক পা-ও ছেড়ে যাওনি।।
শেষ করছি, দক্ষিণ এশীয় নারীবাদ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা দ্য লিজেন্ড কমলা ভাসীনকে কোট করে, ".... নারীবাদ এক রোমাঞ্চকর গতিশীল ভ্রমন। ভালো খারাপ বিচার করার কোন সুযোগ নারীবাদে নেই। কারণ এটিই একমাত্র মতবাদ যেখানে চূড়ান্ত বলে কিছু নেই, এটি একটি ধীর এবং শিখন প্রক্রিয়া। এখানে আমরা সবাই শিখছি। এটি অনন্য, কারণ, এটি অন্য কারো দ্বারা, অন্য কোথাও থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে আসেনি। নারীবাদ প্রতিদিন নতুন করে বিকশিত হয় এবং আমরা আমাদের প্রয়োজন এবং চর্চার সাথে একে মানানসই করে নিতে পারি"।
বিশ্বের সকল ধর্ম বিশ্বাসী, আধা বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী হালাল হারাম নারীবাদীর অন্তরের বন্ধন অটুট হোক। আমাদের বিশ্বাস আলাদা, চর্চা ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু গন্তব্য একই। মনে রাখবেন, যে যেখানে যতটুকু লড়ে যায় সেটাই নারীবাদ। সবার ভালো হোক।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ