নারী শ্রমিকের কান্না ও পুরুষতন্ত্র
প্রকাশ | ১৮ আগস্ট ২০১৭, ০২:৩৯
সময়টা বেশি দিন আগের নয়। এইতো ২০১১ সালের ঘটনা। পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী আমি। সারাদিন সাংগঠনিক কাজ শেষে রাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে রাত্রিযাপন। তাদের জীবন-সংগ্রাম সম্পর্কে জানাবুঝার চেষ্টা। একেক দিন একেক শ্রমিকের বাসায় রাত্রিযাপন। ভোর ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তাদের ব্যস্ত জীবন। তাদের সাথে গল্প করার মতো সময় নেই। তাই বেছে নিই বিকল্প পথ। ভোরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে তাদের সাথে গার্মেন্টেস যাওয়া, দুপুরে খাবার সময় গার্মেন্টেসের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গল্প করা। নিতান্তই গল্প, তাদের কাছ থেকে তাদেরই কথা শোনা। তাদেরই জীবন-যাপন জেনে নেওয়ার চেষ্টা মাত্র। এইভাবেই চলছিল ‘বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনে’র কাজ।
শ্রমিকদের সাথে সম্পর্কটা বেশ জমেই উঠেছিল। একদিন কোনো কারণে তাদের কাছে যেতে না পারলেই ‘আফা’ কই, কেন আসেন নি? এইসব প্রশ্নের জবাব দিতেই হতো। এটা ছিল ভয়াবহ অনুভূতি।
শ্রমিকদের ভালোবাসা, তাদের আন্তরিকতা, তাদের শ্রদ্ধা ধীরে ধীরে আমাকে একজন পরিপূর্ণ সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
এই কথাগুলো বলার পিছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে! গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে কাজ করার পাশাপাশি আমার আরো কিছু সাংগঠনিক কাজ করতে হতো। মূল কাজটা ছিল- গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঝে সংগঠন গড়ে তোলা। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবারের রাত। রাত দশটা। চারজন নারী শ্রমিক একটি বাসা নিয়ে থাকেন। আমিও ওদের সঙ্গী হই মাঝেমধ্যেই। সেদিনও তাদের সঙ্গী। নানান খোশগল্প, কারো প্রেম কাহিনী, কারো বাবা, মায়ের গল্প। আমিও বেশ মনোযোগী শ্রোতা।
সেদিন রাতেই আমার পুনর্জন্ম হয়। আমি নিজেকে পড়ি, শিখি। চারজনই বিবাহিত শ্রমিক। চারজনেরই বিয়ে হয়েছিল। গার্মেন্টসে চাকরি করা অবস্থায় স্ব স্ব পছন্দে বিয়ে করেন। কারো সংসারই একবছরের বেশি টিকেনি। সম্পা নামের শ্রমিকটির একটি সন্তানও রয়েছে। সম্পার দুচোখের কান্নায় আমি বুঝতে পেরেছিলাম- পুরুষতন্ত্র। কতটা নির্মম! এই ব্যবস্থাপনা! কতটা বর্বর, আমাদের এই পুঁজিবাদী, ভোগবাদী ব্যবস্থা!
শুনুন, সম্পা ছেলেটিকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর থেকেই নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত ছিলেন। শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে। সম্পার স্বামীও শ্রমিক ছিলেন- গার্মেন্টস শ্রমিক। সম্পার ভাষ্যমতে, তার স্বামী ছিল শারীরিকভাবে অক্ষম। এই অক্ষমতাকে কোনোভাবেই স্বীকার করতেন না। বরং সম্পার পুরো শরীর কামড়িয়ে দাগ বসিয়ে দিতেন। ওটাই তার পুরুষত্ব। রাতের পর রাত তার এই পুরুষত্বের শিকার হতেন সম্পা। এই অসহনীয় নির্যাতনকে কোনোভাবেই নিতে পারেননি সম্পা। স্তন, নাভি, যৌনাঙ্গ কামড়িয়ে রক্তাক্ত করে দিতেন। পরের দিন বিছানা থেকে উঠে তার গার্মেন্টেসে যাওয়ার মতো অবস্থা থাকতো না। কিন্তু বাধ্য ছিলেন সম্পা। তার যে শ্রম বিক্রি করতেই হবে, যেতেই হবে ওই মৃত্যুকূপে। সম্পার পাশে ছিল না কেউ-ই।
এমনি অবস্থায় সম্পার গর্ভে সন্তান আসে। যে সন্তানটিকে ঘিরে ছিল সম্পার জীবনে নির্মম অভিজ্ঞতা। তার স্বামী সন্তানটিকে নষ্ট করার জন্য রাতদিন চাপ দিতেই থাকেন। এই অসহনীয়, অভাবনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও এই সংসারটিকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। কিন্তু যখন, তার মাতৃত্বকে শেষ করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিল- তখনই ঘুরে দাঁড়ায়, শক্তভাবে, দৃঢ়ভাবে। সম্পা গার্মেন্টেসের যাওয়ার কথা বলে অচেনা পথে পাড়ি জমায়। সম্পা আর ফিরে যায় নি- ওই নরপিচাশের কাছে। সম্পার দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল সেদিন। ‘আমি ভালো আছি আফা, আমি খুব ভালো আছি, আমি পুরুষদের থু থু দেই, দরকার নেই পুরুষের, প্রয়োজনে নিজের শরীরে নুন লাগাবো, তবুও পুরুষের কাছে যাবো না।’ পুরুষের প্রতি সম্পার এই ক্ষোভটাকে আপনি কিভাবে দেখবেন? আমি কিন্তু নেগেটিভভাবে নিতে পারছি না- কারণ সম্পা পুরুষতন্ত্র বুঝে না, পুঁজিবাদ বুঝে না, ভোগবাদ বুঝে না, সংস্কৃতি বুঝে না। তার বোঝ ওই পুরুষরা খারাপ। পুরুষ মানুষই খারাপ। না হলে, কেন আমাকে রাতের পর রাত কামড়াতো, কেন আমাকে যৌন সুখের বদলে যৌনাঙ্গ কামড়িয়ে ধরতো? যৌক্তিকতা আছে কিন্তু! সম্পা শুধু তার জীবনটাকেই বুঝে, জীবনসংগ্রামের যুদ্ধকে বুঝে। সম্পা, সেদিন বলেছিল- ‘আফা বহুত নারী এই অবস্থার শিকার কিন্তু বলে না, তাদের কিসের জানি ভয়! প্রেস্টিজবোধ, আমারও তা ছিল। কিন্তু এই বোধকে লাথি মেরেছিলাম, সমাজের মুখে চুনকালি মেখেছিলাম। তাতে আমার পাপ হয়েছে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না এটুকুও জানি। কিন্তু আমার সন্তানের জন্য আমি এটা করেছি।’ দেখুন, সম্পার সৎ মনোভাবকে। বুঝুন তার সরল অনুভূতিকে! সম্পা জীবনসংগ্রামে জয়ী। তার সন্তানটি আজ তার অবলম্বন।
এটি এক সম্পার গল্প। এরকম লক্ষ সম্পারা আজ পদদলিত। পুরুষতন্ত্রের কালোছায়ায় নিমজ্জিত। পুরুষতন্ত্রের ভয়াল আঘাতে জর্জরিত তাদের জীবন। কিন্তু এই যে, পুরুষতন্ত্রের ভয়াবহতা, নির্মমতা। এটা কিন্তু একদিনে জন্ম নেয় নি। সেই যে আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজে রূপান্তরিত হলো- সেদিনই পুরুষতন্ত্র চেপে বসলো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষতন্ত্রের কালোছায়া। যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পুঁজিবাদের ভয়াল আগ্রাসন। দাস সমাজে পুঁজির যে বিকাশ, সেই বিকাশই নারীকে অধস্তন করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। নারীরা তারপর আর এই ভয়ালতা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারেনি।
যারা নারীবাদী শ্লোগান তুলেন বা নারীবাদের মধ্যদিয়েই সকল কিছুর সমাধান খুঁজেন তাদের বলছি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলুন, আওয়াজ তুলুন। কেননা, পুঁজিবাদের ওই ভয়ালথাবা থেকে আপনি/আমি/আমরা কেউ-ই রক্ষা পাবো না/পাচ্ছি না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় কোনোভাবেই ‘নারীমুক্তি’ সম্ভব না। পুঁজিবাদ নারীকে পণ্য বানিয়ে রেখেছে, আমাদের নারীসমাজই সাময়িক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এই পণ্যকে লুফে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই যে, বাধ্য হওয়াটাকে ঠেকাতে হবে। চিন্তাশক্তিকে মনুষ্য চিন্তাশক্তির শামিল করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির সাথে নারীদের চিন্তার মুক্তিটা জরুরি। একজন নারী সমাজের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ হয়েও পুরুষতন্ত্রের ভয়ালথাবার শিকার হন/হচ্ছেন। কেননা, তার চিন্তাটা ওই পুরুষতন্ত্রেই ধারক-বাহক। শুনতে খুব তিতে শোনা গেলেও, নারীরা পুরুষতন্ত্রকে সন্তানেরই মতো লালন-পালন করছেন বা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা জেনে হোক বা না বুঝে হোক। এই ধারণ করার মানসিকতাকে সচেতনভাবেই পরিত্যাগ করতে হবে। এই সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দেখাতে হবে নারীও মানুষ। নারী সমাজকে পরিচালিত করতে পারে, নারী এই পুঁজিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে কিন্তু আমরা এর সত্যতা পেয়ে যাবো। নারী সমাজের অগ্রাধিকার ভূমিকাটা আজ এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সকল অন্যায়, বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন সকল কিছুর মূলে পুঁজিবাদী সমাজের ভয়াল আগ্রাসন। এই আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে হলে সকল জাতিগোষ্ঠির একটি সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এই নারীমুক্তিও সকল মানবমুক্তির সাথে জড়িত। সকল আন্দোলন-সংগ্রামই শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, আন্দোলন সংগ্রামের মূল হাতিয়ার হোক শ্রেণীবৈষম্য।
জয় হোক মানবতার।
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট