জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি
প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৫০
খেলাটা জমেছে ভালোই। একদিকে ধর্ষণের মহোৎসব, আর আরেকদিকে আমাদের কণ্ঠ চেপে ধরার চেষ্টা। তোমরা তীব্র ঘৃণার আগুন ছুঁড়ে দিচ্ছো আমাদের দিকে। অশ্রাব্য গালিতে ভরিয়ে তুলছো টাইমলাইন। যত্ন করে লুকিয়ে রাখা দাঁত নখগুলোতে শান দিতে দিতে কিবোর্ড চাপছো। প্রতিটি শব্দে আঁচড়ে দিতে চাইছো, কামড়ে দিতে চাইছো আমাদের। আমাদের অপরাধ, আমরা চুপ করে থাকি না। তোমাদের বেঁধে দেয়া পথকে আমরা অস্বীকার করেছি। তোমাদের শেখানো বুলি আমরা পরিত্যাগ করেছি। অথচ চাইলে আমরা যার যার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি।
তোমরা আমাদের গালি দাও। শুধু আমাদের না, আমাদের প্রিয়তম জীবনসঙ্গী, আমাদের বাবা মা, ভাইকেও ছাড়ো না। তোমরা কাউকেই ছাড়ো না। যেমন ছাড়োনি তিন বছরের তানহাকেও। এমনকি ছাড়োনি ছোট ছোট বালককে, কিশোরকেও। তেমনি তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়ো ফেসবুকে বা কোন পোর্টাল/পত্রিকায় আমাদের লেখার উপর। অশ্রাব্য গালির পাহাড় জমাতে থাকো। জমাতে থাকো বিকৃত কাম, জিঘাংসা, হিংস্রতা। দেখে আমি হাসি।
আমাদের ইনবক্সে জমা হতে থাকে তোমাদের ঘৃণাভরা সব স্ক্রীনশট আর অশ্লীল পেইজের লিংক, কোন ডাক্তারের বিকৃত উচ্চারণ বা কোন কবির নোংরা স্যাটায়ার। সতীর্থরা, সহযোদ্ধারা রাগে ফেটে পড়ে। বলে, দেখো কি লিখেছে। তারা ছুটে যায় ঐ পেইজগুলোতে, প্রোফাইলে। যে পারে পাল্টা গালি দিয়ে আসে, যে পারে না সে তার মতো প্রতিবাদ করে। আমি শুধু দেখে যাই। আমার বড্ড হাসি পায় তোমাদের আস্ফালন দেখে। আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। তোমরা জানো না এভাবেই ভেঙ্গে পড়ছে তোমাদের মিথ্যে বালির বাঁধ। নোংরা উগরাতে উগরাতে একদিন তোমরা নিঃস্ব হবে।
তোমরা একা নও, তোমরাই অধিকাংশ। শিক্ষিতের সাথে অশিক্ষিতের, অকর্মণ্যের সাথে এক্টিভিস্টের, বামের সাথে ডানের, প্রগতিশীলের সাথে কূপমন্ডুকের, মানবতাবাদীর সাথে ধর্ষকামীর, ডাক্তারের সাথে রোগীর, কবির সাথে অকবির জট লেগে গেছে তোমাদের। তোমরা জোট তৈরি করেছো, আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের অপরাধ আমাদের লেখা, আমাদের সত্য বলার সাহস। তোমাদের শত নোংরামীর বিরুদ্ধে অবিচল, ঋজু দাঁড়িয়ে থাকার স্পর্ধা।
না, কারো লেখার কোন যৌক্তিক বিরোধিতা তোমরা করো না। তোমরা আমাদের চেহারাকে ব্যঙ্গ করো, আমাদের পোশাককে আক্রমণ করো, আমাদের চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করো। তোমরা ভেবে নিয়েছো আমরা অসুখী। যদিও সুখের সংজ্ঞাটাই শেখোনি ভালো করে।
আমি তোমাদের বোকামী দেখে হাসি। আমাদের নিয়ে যখন নোংরা স্যাটায়ার লিখে কোন কবি পুরুষ, আমার হাসির দমক আরো বাড়ে। আমাদের প্রতিবাদকে যখন ব্যঙ্গ করে মানবতাবাদী এক্টিভিস্টরা, আমার তখন আনন্দের সীমা থাকে না। তোমরা ভাবো খুব নিলাম এক হাত। অথচ দেখতে পাও না সেই এক হাতের বদলে কেমন উদোম হয়ে গেছে তোমার পুরো শরীর। তোমার যে মুখোশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম একদিন, কেমন করে খুলে গেছে সেটা। বৃষ্টি মাথায় করে তখন আমার বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তেপান্তরের মাঠে। শূণ্য মাঠে বসে বাঁশি বাজাতে ইচ্ছা করে। আমি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হই।
আমার সাথে বাঁশি বাজায় ছোট বড় আরো অসংখ্য নারী, পুরুষ, কিশোর, কিশোরী, তরুণ, তরুণী, প্রবীণ প্রবীণা। আলোর মশাল নিয়ে পাশে বসে। তারাও হাতে তুলে নেয় বাঁশি। ধীরে ধীরে বড় হয় বংশীবাদকের দল। হ্যামিলনের ইতিহাসকে নতুন করে তৈরি করি আমরা। টের পাই, আমি একা নই।
আমি তাকিয়ে দেখি আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, তনু, নীতু, পূজা, তানহা, জলিরা। আমার কাঁধে হাত রাখে ভরসার। আমার ফুসফুসে বাড়তি বাতাস যোগায় তারা। আমি আরো জোরে আমার বাঁশিটি বাজাই।
সেই বাঁশির সুরে ক্ষেপে যাও তোমরা যারা ধর্ষক ও ধর্ষকামী সমাজের ধারক বাহক নারী পুরুষ। তোমাদের নিয়ন্ত্রণের জোর কমে আসছে ক্রমশঃ। তোমাদের পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠছে। খসে পড়ছে তিল তিল করে গড়ে তোলা তোমাদের মিথ্যে অনুশাসনের ইট, কাঠ, পলেস্তারা। তোমরা ভয় পেয়েছো।
শোন, ঘৃনার আগুনে পুড়বো জেনেই পথে নেমেছি আমরা। আমাদের কলম আমাদের হৃদয়ের রক্ত দিয়ে গড়া। তোমরা আমাদের চেনো নাই বাহে। আমরা সিমন দ্য বোভেয়ার নই, রোকেয়া সাখাওয়াত নই, তসলিমা নাসরিন নই। আমরা তোমাদের চেনা কারো মতো নই। আমরা আমরাই। প্রত্যেকে স্বতন্ত্র, প্রত্যেকে যার যার মতো নির্ভীক। নিরস্ত্র কিন্তু নির্ভার। তবে একদিন তোমাদের ঘৃণার আগুনে তোমরাই পুড়ে যাবে, দেখে নিও। আমরা শুধুই কাজী নজরুলের সেই বিদ্রোহী রণক্লান্ত হবো। আমাদের ঠেকায় কার সাধ্যি?
আমরাই ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমরা রনদা সর্বনাশী
আমরা জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।
লেখক: তরুণ কবি ও সাহিত্যিক