সমানাধিকারে কি শুধুই নারীর সুফল?
প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০১৭, ১৯:৪২
নারী স্বাধীনতা বলতে আমরা কি বুঝি, তার ব্যাখ্যার পুর্বে আমাদের ধারণা থাকতে হবে যে, আমরা স্বাধীনতা বলতে কি বুঝি? সাধারণ ভাবে বলতে গেলে,স্বাধীনতা হলো অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভোগ করা।
আবার এভাবেও বলতে পারি যে, স্বাধীনতা হলো এমন একটি সামাজিক অবস্থা বা পরিবেশ যেখানে ব্যাক্তি সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব এবং যেখানে ব্যাক্তি প্রয়োজনীয় অধিকার ভোগ করতে পারে।
আলোচনার সুবিধার্থে এই স্বাধীনতাকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগও করতে। পারি। যেমন, (১) ব্যক্তি স্বাধীনতা, (২) সামাজিক স্বাধীনতা, (৩) রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং (৪) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা।
এবার যদি এই সকল অধিকার কে বিশ্লেষন করি, তাহলে, প্রথমেই আসবে,
(১) ব্যক্তি স্বাধীনতা: ব্যক্তি স্বাধীনতা হচ্ছে এমন কিছু কাজকর্ম যার প্রভাব কোন ভাবেই অন্যের উপর পড়ে না। যেমন: ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা, পারিবারিক তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা।
(২) সামাজিক স্বাধীনতা যেমন, জীবন রক্ষার অধিকার, ধনসম্পত্তির অধিকার, চলাফেরার অধিকার।
(৩) রাজনৈতিক স্বাধীনতা: যেমন, ভোট দানের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
(৪) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: জীবন ধারণের জন্য যোগ্যতা অনু্যায়ী প্রয়োজনীয় আর্থিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারকে আমরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে পারি। যেমন কাজ করা, ন্যায্য মজুরী পাওয়া, বেকার না থাকা, ইত্যাদি।
একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই সমান অধিকার ভোগ করার কথা। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক পরিবেশে এই অধিকার সমূহ সমানভাবে ভোগ করার সু্যোগ আছে কি?
পরিবার কেন্দ্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় আমাদের নারীরা আজও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বিবেচ্য। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীগণ পুরুষের সাথে সমান পদমর্যাদায় কাজ করছেন এবং সমান মজুরীও ভোগ করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে উন্নিত হওয়ার জন্য একজন নারীকে ঘরে বাহিরে যে পরিমান মানসিক ও শারিরীক পরিশ্রম করতে হয়, তা কিন্তু আমাদের পুরুষ নাগরিককে করতে হয় না।
পরিবারের প্রয়োজনেই নারী পুরুষ দুজনেই কর্মজীবী হন। কিন্তু, পুরুষেরা অর্থনৈতিক উপার্জন ছাড়া পরিবারের অন্যান্য কর্ম সম্পাদনে আগ্রহী হন না। বাধ্য হয়েই নারীকে পরিবারের সকল দায় মাথায় তুলে নিতে হয়। সন্তান লালন পালন, পরিবারের গুরুজনের যত্ন নেওয়া, আত্মীয় স্বজনের সাথে পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করা, সব কিছু একজন নারীকেই সামলে অতঃপর অফিসেও দক্ষতা বজায় রেখেই কাজ করতে হয়। এবং আমাদের করিৎকর্মা মা, বোনেরা এই জীবনযুদ্ধটা মেনে নিয়েই স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণ ধরার জন্য মরন পণ লড়াই চালিয়েই যান। সব পাওয়ার শেষ পাওয়া, মাস শেষের মজুরিটা কি সকলে নিজের ইচ্ছে মত খরচ করতে পারেন?
আমার মনে হয় না, এক বাক্যে সকলে একমত হতে পারবেন । এখানেও স্বামী, বাবা বা অন্য কেউ, যিনি পদাধিকার বলে পরিবার প্রধান তার মতামতের উপর বা নমনীয়তার উপরেই নির্ভর করে আমাদের কর্মজীবী নারীগণের অর্জিত অর্থের ব্যবহার।
তাহলে, আমাদের শিক্ষিত সমাজ যে বড়মুখ করে বলেন, নারী শিক্ষিত হলে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নারীরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবেন তা কি ধোপে টিকছে, টিকছে না তো!
আমাদের নারীরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছেন না এবং তার ফলশ্রুতিতে শুধু নারী নন গোটা সমাজটাই সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।
নারীকে ছোট করতে গিয়ে আমাদের পুরুষেরা একটা সহযোগী হাত হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। মেয়েদের শিক্ষিত করে তুললে, স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ পেলে চিন্তা চেতনায় উন্নতি হলে, সম্পদের সুষম বন্টন হলে প্রকারান্তরে আমাদের পুরুষেরাই বিপদে ভরসা পাওয়ার মতো শক্ত হাত পেতেন। রাষ্ট্র পেতো নিবেদিত প্রাণ বিশাল কর্মীবাহিনী।
এবার আসি গৃহ অন্তরালে অবগুণ্ঠিত নারী। যিনি স্বামী সন্তানের সেবাই শুধুমাত্র করেন না, পরন্তু স্বামীর সাথে সমানভাবে সংসারের সকল কাজে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু অধিকার চর্চার বেলায়? এখানেই সীমাহীন অবদমন পরিলক্ষিত হয়। কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময়ই নারী মতপ্রকাশ করতে পারেন না। স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এমন কি পরিবারের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী যা উৎপাদনে নারীও সমান শারীরিক শ্রম দিয়েছিলেন তার উপরে তার কোন অধিকার গ্রাহ্য হয় না।
পরিশেষে বলতে চাই, শুধুমাত্র নারীর জন্য নয়, নিজেদের জন্য আর্থসামাজিক অবক্ষয় রোধ করে সুস্থ জীবন বোধ জাগ্রত করতে হলে অবশ্যই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমানাধিকার এই ধারণার বাস্তবায়ন খুব জরুরী।
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী