কংগ্রাচুলেশন্স অন ইওর ডিভোর্স
প্রকাশ | ২৫ জুলাই ২০১৭, ০১:১২
সচরাচর কারো বিয়ের খবর পেলে আমি যেমন অভিনন্দন জানাই, বিয়ে বিচ্ছেদের খবর শুনলে আমি কখোনোই কন্ডোলেন্স বলি না, বেশ জোরগলায় কংগ্রাচুলেশন্স-ই বলি। বলি বেশ কিছু কারণে -
প্রথমত, মৃতদেহ কবরে নামানো বা চিতায় দাহ করার মতোই ডিভোর্স বিষয়টা একটা আইনী ও সামাজিক প্রক্রিয়া। বাস্তবে সম্পর্কটা কিন্তু আগেই মরে গেছে, কারোটা বহু আগে, কারোটা সদ্য। কেউ কেউ হয়তো লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। আপ্রাণ সেই চেষ্টাও হয়তো একসময় থমকে গেছে। আত্মা বেরিয়ে যাওয়া দেহ যত বেশিক্ষন ঘরে রাখবেন, ততই তীব্র গন্ধ ছড়াবে, ঠিক ? কাজেই যেই দম্পতি এই মৃত সম্পর্কের আইনী সৎকার সম্পন্ন করেছেন, আমি ধরে নেই, তাঁরা একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন থেকেই অসুন্দর ও নোংরামীকে পেছনে ফেলে এসেছেন। তো আমি দুঃখ প্রকাশ করবো ঠিক কি জন্য? কার জন্য?
দ্বিতীয়ত, সম্পর্ক বিষয়টা তো হ্যান্ডশেকিং এর মতো। জাস্টিন ট্রুডো হাত বাড়ালে যদি ভ্লাদিমির পুতিন হাত পকেটে ঢুকিয়ে রাখেন, বুঝতে হবে চুক্তি সই হচ্ছে না। সম্পর্কে কোনো একপক্ষ যদি নারাজি আবেদন দেয়, সে যে কারণেই হোক, সম্পর্কটা মরে যায়। অন্যপক্ষ হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করে, আকুল শোকে ডুবে যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই মৃত সম্পর্কটা আইনীভাবে শেষ হয়ে যাওয়াটা সেই শোকগ্রস্ত মানুষটির জন্যও কিছুমাত্র কম মঙ্গলের নয়। আমি সেই মঙ্গলালোকের দিকে তাকানো আশাবাদী একজন হিসাবে মৃত সম্পর্কের প্রতি সমবেদনা নয়, বরং সামনের জীবনের জন্য ডিভোর্সী মানুষটিকে সম্ভাষণ জানাতে চাই।
একটা সম্পর্ক সে যেভাবেই শুরু হোক, একটা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত এতো সহজে আসে না, অন্তত আমাদের বাঙালী সমাজে। একটা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তকে জাজ করার অধিকার বা এখতিয়ার আমরা কেউ ই রাখিনা। আমরা কেউ ই জানিনা দিনের পর দিন ঠিক কিভাবে, কি কারণে সম্পর্কটা একটু একটু করে মরে গেছে। আমরা কেউই জানিনা ওই দুজন মানুষের চাওয়া পাওয়া, হিসেব নিকেশের খাতায় যোগ বিয়োগ গুন বা ভাগের ফলাফল কি ছিলো। ওই খাতাগুলো কখনোই ১০০% প্রকাশ হয়না, হওয়া উচিত ও না। সে খাতায় একই গল্প লেখা থাকে দুভাবে। দুজনের চোখ, বিচার, বুদ্ধি ও কল্পনা দিনের পর দিন একটার পর একটা ঘটনার বিপরীত প্রতিবিম্ব এঁকে যায়, বাড়তে থাকে সম্পর্কের কৌণিক দূরত্ব। একসময় অক্সিজেনের অভাবে দ্রুত সম্পর্কটার হার্টবিট ড্রপ করে। চেনা ঘরটা গুমোট হয়ে যায়, আঁটকে আসে নিঃশ্বাস। সেসময় হয়তো একজন বা দুজনের বিচারেই এটা মনে হয় যে বেঁচে থাকতে হলে মুক্তি প্রয়োজন।
প্রথম ধাপ হিসাবে সেপারেশন। অনেকসময় সেপারেশন আত্মউপলব্ধির সুযোগও বটে। অনেক দম্পতি সেপারেশন থেকে রিইউনাইটেড হয়ে যায়। মানুষটা বদলায় না ঠিকই কিন্তু অন্যপক্ষের দেখার চোখ বা ঘটনা হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা হয়তো বদলায়। বেঁচে ওঠে সম্পর্ক।
আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেপারেশন শক্তি সঞ্চয় করার সময়, উড়োজাহাজ উড়ার আগে যেমন ট্যাক্সি করে, ঠিক তেমনি।
শেষতক, বিচ্ছেদ যদি সম্পর্কের নিয়তি হয়, তো এর আগের এবং পরের সোশ্যাল, ইকোনোমিকাল, সাইকোলজিক্যাল ও ইমোশনাল যে প্রেশার, আমি ধারণা করি, যারা এর মধ্যে দিয়ে যাননি, তাদের এটা বোঝার কথা না। তবে সম্পর্কের মৃতদেহের ভারী কফিন খুশি খুশি ভাব ধরে আজীবন বহন করার অভিশাপের চেয়ে এই এককালীন কষ্টের ধাক্কা বোধ করি অনেক ভালো।
আশাবাদী মানুষ হিসাবে আমি তাই সেই মানুষগুলোকে অভিনন্দন জানাই, নিজের মতো করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার জন্য, সমাজের চাপে অভিনয়ের অভিশাপ কাঁধে টেনে না নিয়ে সত্যকে অলিঙ্গল করার জন্য। এই চরম মুহূর্তে মৃত সম্পর্কের প্রতি সমবেদনা চেয়ে আমার কাছে আগামীর জন্য শুভকামনা জানানোটাই সঠিক মনে হয়!
সম্প্রতি এক তারকা দম্পতির বিচ্ছেদের খবরে আরেকবার আমরা প্রমান করে যাচ্ছি জাতি হিসাবে আমরা কতটা সাইকোপ্যাথ! ওই দম্পতির প্রতি অবমাননাকর অসম্মানজনক মন্তব্যের ট্রল দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলছি! আমরা মোটামুটি নিজের পশ্চাৎদেশের মতো দ্বিখণ্ডিত, কে ভালো কে খারাপ, কার দোষ কার গুণ এই নিয়ে!
আমি দোয়া করি, এই প্রত্যেকটা সাইকোপ্যাথ তার উপযুক্ত পাওনা পেয়ে যাক... অচিরেই।
লেখক: প্রকৌশলী ও প্রবাসী বাঙালি