আমরা কী লজ্জাহীন পুরুষে উপনীত হচ্ছি?
প্রকাশ | ২১ জুলাই ২০১৭, ১৮:২৭ | আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭, ১৮:৩৮
অফিসে বের হবো। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সারছিলাম। এর ফাঁকে চোখ আটকে যায় টিভির স্ক্রিনে। সামিয়া জামানের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় প্রচারিত ‘যে গল্প নিষিদ্ধ’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটি প্রচার হচ্ছিল নিউজ টুয়েন্টিফোরে। সম্ভবত অনুষ্ঠানটি পুন:প্রচার। তবে সে নিয়ে ভাবনা ছিল না। কৌতুহল ছিল নামটি নিয়ে। অনুষ্ঠানটির এমন নামকরণ কেনো!
নাস্তা শেষ করে চায়ের মগ হাতে টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে পড়ি আগ্রহ নিয়ে। অনুষ্ঠানটির সেট সাজানো হয়েছে একটি খোলা জায়গায়। আট থেকে দশ জন তরুণী। গণপরিবহনে কতটা হয়রানির শিকার হতে হয় মেয়েদের (!) সে বর্ণনা তুলে ধরছিলেন বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। মেয়েদের বর্ণনাগুলো হৃদয়বিদারক। একটি গণপরিবহণে একজন নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে কীভাবে পুরুষ হাতগুলো স্পর্শ করে, কতটা ভয়ানক সে ব্যাপারগুলো, তা ভুক্তভোগি নারী ব্যতিত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না বলেই মনে হয়।
একটি মেয়ে বলছিল, সে প্রথমে হিজাব পরেই ভর্সিটিতে আসা-যাওয়া করত। পোষাক ছিল মার্জিত। তারপরও সে রক্ষে পায়নি পুরুষের অসভ্যতা থেকে। সে এখন হিজাব পরে না। তার কথা হচ্ছে, ‘যে হিজাব আমায় রক্ষা করতে পারে না, তা পরার কোনো মানে নেই।’ মেয়েটি এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে। কেউ অসভ্যতা করলে তার গালে কষে চড় বসাতে দু’বার ভাবে না। তার সাথে গলা মিলিয়ে আর কেউ প্রতিবাদ করবে কী করবে না, সে জন্য অপেক্ষাও করে না। সে এখন নিজেই পারে অসভ্য, ইতরশ্রেণির অসভ্যতামির যুতসই জবাব দিতে।
শুধু ওই মেয়েটিই নয়; তার মতো এমন আরও অসংখ্য মেয়েকে প্রতিদিন এমন অসভ্য, ইতরশ্রেণির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যা সত্যিই পুরুষ হিসেবে আমাদের ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয়। কেননা, এ ঘটনাগুলো আমার মতো আকৃতির পুরুষশ্রেণিই ঘটিয়ে থাকে। তবে, ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, যে পুরুষগুলো গণপরিবহনে অসভ্যতা করে, তাদের অধিকাংশই পিতৃতুল্য, বয়ঃবৃদ্ধ!
গণপরিবহনে নারীদের ভোগান্তি কতটা (?) তার সাক্ষী আমিও। প্রতিদিন কাছ থেকে দেখেছি। আক্ষেপ করেছি। কখনো কখনো এ নিয়ে ঝগড়াও করেছি। মেয়েদের পক্ষ নেয়ায় রোষানলেও পড়েছি। গণপরিবহনে একজন নারী কতোটা হয়রানির শিকার হয় (?) তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারো কারো কাছে এসব ঘটনাগুলো স্বাভাবিক। তাই প্রতিবাদও করে না। একাই নারীকে লড়তে হয়। হয়রানির শিকার মেয়েটি অন্য যাত্রীদের দিকে অসহায়ের মত তাকায়, যদি কেউ গলা মিলিয়ে এই অসভ্যতার প্রতিবাদ করে, তাহলে একটু জোর পাওয়া যাবে।
অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবাদকারীর সাথে কেউ গলা মেলায় না। উল্টো কেউ বলে উঠে, ‘গাড়ির মধ্যে এমন এক আধটু হয়, বেশি সমস্যা হলে পাবলিক বাসে উঠেন কেনো! প্রাইভেট কার কিনে নেন, যত্তসব’। এমন ঘটনা নিত্য দেখেছি। নারীদের সাথে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদও করেছি। কিন্তু পেরে উঠা যায় না। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কখনো কখনো হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। বেশ ক’বার ক’টি চশমা ভেঙ্গেছে আমার। শার্টের বোতামও ছিড়েছে। তবুও প্রতিবাদ করি। করার চেষ্টা করি। কেননা, লিঙ্গগতভাবে আমিও যে পুরুষ। এ লজ্জার অংশিদার তো আমিও।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, আমার ওপর এ দায় কেনো পড়বে, ‘আমি তো এমন অসভ্যতা করি না। যারা করে তারা অসভ্য ইতরশ্রেণি।’ হ্যাঁ তারা অসভ্য। ইতরশ্রেণি। তারা কিন্তু পুরুষশ্রেণিও। এক পুরুষের অপকর্ম অন্যের ওপর কিছুটা হলেও পড়ে। যার কারণে পুরুষের দিকে বরাবরই সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নারী। এ কি খুব ভালো বিষয়? নাকি আমরা নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম করছি! তবে কী আমরা দিন দিন লজ্জাহীন পুরুষে উপনিত হচ্ছি?
আমাদের দেশের সব মানুষ অর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। অনেকেরই নেই ব্যক্তিগত গাড়ি। যার কারণে অসংখ্য নারী স্কুল, কলেজ, কর্মস্থলে যেতে গণপরিবহনের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু এই গণপরিবহনে নারী সমাজকে কতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়, সে একমাত্র ভুক্তভোগি নারীই ভালো জানে। এ যন্ত্রণা কতটা অস্বস্তিকর, তা ভুক্তভোগি নারীর থেকে ভালো আর কে জানে? রীতি মতো এই অভিজ্ঞতাগুলো ভয়াবহ। গা শিউড়ে উঠার মতো। আর আমাদের পুরুষের জন্য চরম লজ্জার। কোনো ভাবে কী এই লজ্জা থেকে আমরা দায় এড়াতে পারি?
আমরা দেখি, প্রতি মুহূর্তে গণপরিবহনগুলোতে নারীকে কতটা যুদ্ধ করে উঠতে হয়। পুরুষদের পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠা, দাঁড়িয়ে বা বাসের পা-দানিতে ঝুঁকি নিয়ে ঝুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে নারীদের। আর এ সুযযোগটাকেই কাজে লাগায় একশ্রেণির নপংশকের দল। যৌন হয়রানিসহ নানারকম পরিস্থিতির মুখোমুকি হতে হচ্ছে নারীকে। বাসে ওঠা-নামার সময় নারী শরীরে উপর কিছু পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করেই পড়ে যান কিংবা অপ্রয়োজনে গায়ে হাতও দেন। বাসের অন্যত্র ফাঁকা থাকলেও নারী আসনগুলোর পাশে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি অনেক পুরুষকে। যা একেবারেই ইচ্ছেকৃত।
কিছু বিকৃতরুচি সম্পন্ন পুরুষের জন্য গোটা পুরুষ সমাজ হেয় হচ্ছে। লজ্জিত হচ্ছে। তারপরও পুরুষ সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ এসব দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকেন। প্রতিবাদটুকুও করেন না! যারা প্রতিবাদ করে, উল্টো তাদেরকেই শুনিয়ে দেন দু’কথা। বলে উঠেন, গাড়িতে এক আধটু এমন ঘটনা হতেই পারে। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই! না, আমরা বিচলিত হব না। এসব ঘটনায় উচ্ছ্বসিত হব। বোগল বাজাবো। দাঁত কেলিয়ে হাসবো। একবারও কি মনে হয়ে না, এমন কর্মকা-ের জন্য পুরুষ জাতি কতটা হেয় হচ্ছে?
একজন নারী ভিড় ঠেলে গাড়িতে উঠেছে। এই ভিড়ে তার উঠার কথা না। তারপরও বাধ্য হয়ে উঠেছে। হয় তো সে বাড়ি ফিরবে। নয় তো কর্মস্থল কিংবা স্কুল, কলেজে যাবে। এ সুযোগে কেউ কেউ তাদের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিচ্ছি! আচ্ছা, একজন অপরিচিত নারীর বক্ষ, কটি, নিতম্ব, চিবুক, পিঠ বা যে কোনো স্থানে হাত দিয়ে কী সুখ পায় আমাদের পুরুষশ্রেণি? একবারও কি মনে হয় না; এ কর্মটি বিকৃত মনসিকতার বহি:প্রকাশ? আজ ভিড়ের মধ্যে নারীর গায়ে আমি হাত দিচ্ছি, আমার মা, বোন, স্ত্রী, কন্যাও তো এমন ভিড় ঠেল আসা-যাওয়া করে! এই বোধটুকু কী তাদের ভেতর আসে না? নাকি তাদের কাছে ঘরের নারীরাও নিরাপদ নয়?
একজন নারী কখনোই চায় না, পুরুষ তাকে কেবলমাত্র নারী ভেবে বেশি সম্মান করুক। সে চায়, মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্যটুকু। তার স্বাধীনতা কেউ খর্ব না করুক। প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, পরিপূরক হোক পুরুষ। নারীর চলার পথে যেন বাধার প্রাচীর না হয় পুরুষ। সে চায়, স্কুল, কলেজ, কর্মস্থলে নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া করতে। প্রতিটি নারী এটুকুই আশা করে। এ কী খুব বেশি? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এমনকি জাতীয় সংসদের স্পিকারও একজন নারী। অথচ সে দেশের কর্মজীবী, শিক্ষার্থী নারী সমাজ প্রতিমুহূর্তে যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছে! একি তবে হতাশাজনক নয়?
গণপরিবহনগুলোতে নারীদের নিরাপত্তায় আমাদের সবারই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরী। পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুরুষ যাত্রীদেরও গণপরিবহনে চলাচল করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি রোধে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। গাড়িতে গাড়িতে নিয়মিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সিভিল টীম উঠিয়ে দিতে হবে। দু’চারজন অসভ্য, ইতরকে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। একই সাথে, দণ্ডিত হওয়ার পর অসভ্য পুরুষটির ছবি ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে করে অন্য অসভ্যগুলোর ভেতরে ভীতি সঞ্চার হবে। গাড়িতে অসভ্যতামি করার সাহস আর পাবে না। নিজেদেরকে তারা শুধরেও নিবে।
লেখক: লেখক: ব্লগার ও কলামিস্ট