দাঙ্গা যাদের ধর্ম, তারা আমার পড়শী নয়
প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৭, ০১:৫২
কদিন ধরেই খবরে দেখছি পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার কথা! ধূলাগড়, বাদুরিয়া, বসিরহাট ইত্যাদি নানা অঞ্চলে জ্বলছে দাঙ্গার আগুন। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতবর্ষ জুড়েই চলছে দাঙ্গার আবহ। কোথাও ছোটো আকারে, কোথাও বড় আকারে। কোথাও গরু নিয়ে, কোথাও নবী বা কাবা শরীফ নিয়ে। চারদিকে ফিসফাস, অবিশ্বাসের চাপা আগুন, ঘৃণা। এ কদিন চুপচাপ ঘর আর অফিস করে গেছি। আর ভেবেছি। ভেবেছি আমরা ভেতরে ভেতরে ঠিক কতটা সাম্প্রদায়িকতা, অবিশ্বাস আর ঘৃণা পোষণ করি! যে প্রতিবেশীর সাথে এই সেদিনও ঘুরেছি, আড্ডা দিয়েছি, বাজার গেছি, তাকেই এক লহমায় খুন করার কথা চিন্তা করতে পারি, তার ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে তাকে ভিটেছাড়া করতে পারি!! আমি জানি না এই মুহুর্তে কাকে ঠিক বিশ্বাস করবো!! আমার প্রতিবেশী, আমার বন্ধু, আমার অফিসের কলিগ, আমার পরিচিত মহলের মানুষের মাঝেও যে এই হিংসা, অবিশ্বাস, ঘৃণা লুকিয়ে নেই তা কি করে বুঝবো আমি!! কাল তাদের হিংসার বলি আমি হবো না তো? আমার পরিবার হবে না তো?
সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশে নতুন নয়। এই দেশের মানুষের রক্তে রক্তে সাম্প্রদায়িকতা। আমাদের ইতিহাস এর সাক্ষী। ইংরেজরা আমাদের দেশের বুকে ‘সাম্প্রদায়িকতার’ বীজ পুঁতে গেছে - এটা একদমই ভুল ধারণা! আসলে দু’শ বছর দেশ শাসন করে ইংরেজরা জেনে গেছিলো, আমাদের দেশের মানুষের দুর্বল স্থান কোথায়! উপযুক্ত স্পর্শকাতর জায়গাটুকু চিহ্নিত করে ব্যবহার করেছে মাত্র। ইংরেজ সৈন্যরা যতো না ভারতীয়দের মেরেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দেশভাগের সময় দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলো। ইংরেজরা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেনি এই দেশের মানুষদের, বরং আমাদের দেশের মানুষ প্রথম থেকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েই ছিল। ইংরেজরা মুসলিম লীগও বানায়নি আর হিন্দু মহাসভাও বানায়নি! ইংরেজরা আর এস এস, বজরং দল, হিন্দু সংহতি ইত্যাদি দলগুলো বানিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়েও দেয়নি! আর ইংরেজরা জামাত, সিমি, ইত্যাদি দলগুলোও বানায়নি।
এদেশের প্রচুর সংখ্যক মানুষ ভিতরে ভিতরে তীব্র সাম্প্রদায়িক। তারা অনেকেই অগোচরে হিন্দুদের ‘মালাউন’ বলে সম্বোধন করে, মুসলমানদের 'যবন', 'নুনুকাটা', 'বাঙ্গাল' বলে সম্বোধন করে! হিন্দুরা মুসলমানের ছোঁয়া অব্দি খায় না অনেক ক্ষেত্রে!! সোস্যাল মিডিয়ায় একদল ছবি বিকৃত করে, আর সাথে সাথে বাকি সবাই লাঠি, রামদা নিয়ে দাঙ্গা করতে বেরিয়ে পড়ে। সামান্য ছবি বিকৃত করলে বা ধর্ম, নবী, দেবতা সম্পর্কে কেউ কিছু বললেই, তাদের দেবতা, নবী, ঈশ্বর, আল্লা'র অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। তাই তারা লাঠি, রামদা, ত্রিশুল, চাপাতি হাতে ধর্ম রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার নবীকে নিয়ে বলেছিস, তোর ঘর জ্বালাবো শালা! আমার ঠাকুর নিয়ে বলেছিস, তোকে ত্রিশুল দিয়ে খুঁচিয়ে মারবো শালা! তুই মুসলমান, মানে তুই গরুখোর। তোকে ট্রেনে, বাসে, ঘরে, বাইরে কুপিয়ে মারবো শালা! - এইগুলো বর্তমানে আমাদের দেশের ট্রেন্ড।
শুধু কি ধর্ম? উঁচু জাত, নীচু জাত, মেথর, হরিজন, মুচি থেকে শুরু করে গায়ের কালো রঙ, হিজড়া, সমকামী নিয়েও আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে সাম্প্রদায়িকতা বা রেসিজম কাজ করে!
তো বর্তমান ভারতবর্ষের এই মুখে উদার সাজা, ভেতরে প্রচন্ড রকমের সাম্প্রদায়িকতা পোষণ করা মানুষের ভিড়ে, আমরা যারা কোনো ধর্মেরই পতাকা বহন করি না, কোনো ধর্মের মানুষকেই জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, ঘরছাড়া, দেশছাড়া করার ভাবনা মনে মনে পোষণ করি না, হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান পরিচয়গুলোকে স্রেফ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবেই ভাবি, এর জন্য আলাদা করে কোনও গর্ব বা ঘেন্না অনুভব করি না, যারা গরুকে মা মনে করেন এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রোজেক্ট করার নিরন্তর চেষ্টা করেন, আর যারা শুওরের মাংসকে 'হারাম' বলে মনে করেন আর ইসলাম বাদে বাকি ধর্মকে মনে প্রাণে ঘৃণা করেন, অস্বীকার করতে চান – দুই দলকেই সমান ভাবে অপছন্দ করি, সেই আমরাই এই দেশে হয়ে পড়েছি সংখ্যালঘু। আমরা যারা ঈদের দিনে সেমাই খাই, নতুন কাপড় নেই, রোজা রাখি, নামাজ পড়ি, আবার মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পূজার মণ্ডপে, রথের মেলায়, কীর্তনের আসরে উৎসাহ নিয়ে অংশ নেই, কিংবা যারা হিন্দু হয়ে পূজা করা সত্ত্বেও মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার খাই, ঈদে মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে সেমাই খাই, গলায় গলা মিলিয়ে চলি, সেই আমরাই এই ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু। আমরা যারা সাম্প্রদায়িকতার তিলমাত্রও মনে লালন-পালন করি না সেই আমরাই সংখ্যালঘু। আমরা যারা রমেশ আর রহিমকে একই রকম মানুষ মনে করি সেই আমরাই সংখ্যালঘু।
আমরা সংখ্যালঘু, কারণ আমরা নিজেদের হিন্দু বা মুসলমান না ভেবে মানুষ ভাবি। আমরা সংখ্যালঘু, কারণ আমরা আমাদের দেশে আর কোনো ধর্মীয় উগ্রতা দেখতে চাই না, আমরা আমাদের দেশে একটিবারের জন্যও আর কোনো দাঙ্গা দেখতে চাই না। আমরা সংখ্যালঘু, কারণ আমরা আমাদের দেশকে হিন্দু বা মুসলমানের বাপের সম্পত্তি বলে ভাবি না। আমরা সংখ্যালঘু, কারণ আমরা প্রতিবেশী বা বন্ধুর সাথে ঝগড়া হলে তাকে পাকিস্তান চলে যেতে বলি না। বরং আমরা বিশ্বাস করি দেশটা হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খ্রীষ্টান-ধনী-গরীব-পুরুষ-নারী-হিজরা-সমকামী সবার। যেদিন আমাদের মতো মানুষেরা এই দেশে সংখ্যাগুরু হয়ে উঠবে, হয়তো সেদিন আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠবে। জানি না সেদিন কখনো দেখে যেতে পারবো কি না!! সত্যি বলতে কি ইদানীং ভয় গ্রাস করছে আমাকে। এই দাঙ্গাবাজ মানুষের ভীড়ে বড় ভয়ে ভয়ে বেঁচে আছি!!
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট