সবুজে ঘেরা চা বাগানে অমানবিক ও বর্বর জীবন
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০১৭, ২১:৫৩ | আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭, ২১:৫৮
'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি' বলতে প্রথমেই আমাদের কল্পরাজ্যের মানসপটে ভেসে আসে সবুজে ঘেরা চা বাগানের উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ চায়ের বাগান। এই চা বাগানেই পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯০ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। চা শ্রমিক নারীদের দিন শুরু হয় সেই কাকা ডাকা ভোরে। প্রায় প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগান পানে। এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় চা শ্রমিকের। প্রতিদিন লাইন চৌকিদার লেবার লাইনের নম্বরে যেয়ে চিৎকার দিয়ে চা শ্রমিকদের নম্বরের ঠিকানা দিয়ে থাকেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজে থাকতে হয় শ্রমিকদের। বৃষ্টি বা ঝড় আসলে সামান্যতম আশ্রয়ের জন্য বাগানগুলোতে নেই কোন শ্রমিক ছাউনি। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসকল নারী শ্রমিকদের ঝোপঝাড়ই ভরসা, নেই কোন স্যানিটারি ল্যাট্রিন এর ব্যবস্থাও। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না। তারা কলম কাটা, প্রোনিং বা চারা গাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কার করার কাজেও নিয়োজিত থাকেন।
এরপর মজুরি ! সেটিও নামমাত্র। শ্রমিকের ভাষায় যা হাজিরা। পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে এত সস্তা শ্রম আছে কিনা আমার জানা নেই ! একজন নারী চা শ্রমিক বা পুরুষ শ্রমিক সে যেই হউক না কেন প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অমানবিক ও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ২৩ কেজি পাতি উত্তোলনের বিপরীতে মাত্র ৮৫ টাকা পেয়ে থাকেন। যারা নিয়মিত নারী শ্রমিক তারা সপ্তাহে জনপ্রতি ৩ কেজি ২৫০ গ্রাম রেশন হিসেবে পেয়ে থাকেন চাল ও ডাল।
খুব বেশি দিন হয়নি চা শ্রমিকের মজুরি ৮৫ টাকা হয়েছে। ২০০৭ সালে এই মজুরি ছিল ৩২ টাকা, ২০০৯ সালে ১৬ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৪৮ টাকা, এবং ২০১৩ সালে করা হয় ৬৯ টাকা। এদিকে দেশের প্রতিটি বাগানের শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন তাদের নূন্যতম মজুরি যেন ২৫০-৩০০ করা হয়। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না মালিকপক্ষ একাধিকবার আশ্বাস প্রদান করা সত্ত্বেও। একদিকে নিম্ন মজুরি অন্যদিকে অভাব-অনটনের সংসার এই দু'য়ের যাতাকলে মাঝপথে পিষ্ট হচ্ছে নারী চা শ্রমিক ও তাদের সন্তানদের জীবনযাত্রাও।
বাগানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত স্কুল অন্যদিকে শ্রমিকদের নেই বাড়তি আয়। তাই অনেক মা বাবা ইচ্ছে করলেই তার সন্তানকে স্কুলে দিতে পারছেন না টাকা পয়সার অভাবে।
ব্রিটিশ আমল থেকে অর্থাৎ প্রায় দু'শ বছর ধরে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি চা শিল্পের শ্রমিকরা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসকল সমস্যা চা বাগানগুলোতে প্রবলতর। এর মধ্যে নারী শ্রমিকরা অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে চেহারা হাড্ডিসার দশা। দুপুরের খাবারে নারী শ্রমিকরা পাতি ছানার (চা পাতার ভর্তা) সাথে পেঁয়াজ ও মরিচ দিয়ে রুটি অথবা ভাত খেয়ে থাকেন। এসব খাবার খেয়েই তাদের জীবন চলে। যার দরুণ অনেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন।
স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও তাদের কাটাতে হয় অমানবিক জীবনযাপন। মর্যাদাপূর্ণ জীবন দূরে থাক ন্যূনতম মৌলিক মানবিক অধিকার থেকেও তারা অনেক বঞ্চিত। বংশ পরম্পরায় যুগের পর যুগ বাগানে অবস্থান করেও নেই তাদের ভূমির অধিকার। এ যেন নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবন পার করছেন চা শ্রমিকরা।
চা বাগানগুলোতেও নারী শ্রমিক বা তাদের পরিবারের জন্য থাকে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধাও। এখানে প্রায় শ্রমিককেই দেখা যায় রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে। সাধারণ রোগে–শোকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা এখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। শিক্ষা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা, বসবাসের জন্য উপযোগী বাসস্থানসহ স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব বাগান কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শ্রম আইনে উল্লেখ করা এসবের কোন কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।
নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েও চলে নয় ছয়। একজন নারী শ্রমিক সন্তান প্রসবকালীন সময় মাত্র ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস ছুটি পেয়ে থাকেন। চা শ্রমিক সন্তান ও চা শ্রমিক নারী অধিকার কর্মী গীতা কানু বলেন, "দেশে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত নারীরা যদি ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকেন তাহলে আমরা কেন পাবো না !" তিনি আরও বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করে আসছি অতি দ্রুত এটি কার্যকর না হলে আমরা আবারো প্রতিটি বাগানে আন্দোলনের ডাক দিব"।
চা বাগানে নারীরা পাতি উত্তোলন, চারা গাছ রোপণ, ছাঁটাই সহ প্রতিটি কাজে যেমন এগিয়ে তেমনি এগিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামেও। অনেকের হয়তো জানা আছে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর-বেগমখান বাগানের ৫১১ দশমিক ৮৩ একর ধান্য জমি রক্ষার জন্য শ্রমিকরা এক দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সরকার এবং প্রশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। সেই আন্দোলনের অগ্নি মশাল ছিল নারী শ্রমিকরা। ভূমি এবং ধান্য জমির রক্ষার উক্ত আন্দোলনটি আজও চলমান। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই দেশের প্রতিটি বাগানে ভূমির দাবিতে শ্রমিকরা সরব হয়। জন্ম হয় অসংখ্য প্রতিবাদী কণ্ঠ- সন্ধ্যা রানী ভৌমিক, খাইরুন আক্তার, কনক লতা রাজবংশী, সুমি।
চান্দপুর–বেগমখান চা বাগানের একজন সংগঠক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল এসব নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের জীবনব্যবস্থা।
চান্দপুর চা বাগানের চা শ্রমিক ও নারী আন্দোলন কর্মী সন্ধ্যা রানী প্রায় সময় আক্ষেপ করে বলতেন, "পড়ালেখায় ভালো ছিলাম কিন্তু অভাব অনটন আর টানাপোড়েন এর সংসারের কারণে বেশি পড়তে পারিনি তাই এখন খুব আফসোস হয়। যদি আজ পড়ালেখা জানা থাকতো তাহলে হয়তো এত অমানবিক ও কষ্টের দিন কাটাতে হতো না। এখন নিজে সন্তানের মা হয়েছি তাই বুঝি পড়ালেখা কত প্রয়োজন। তাই হাজার অভাব অনটন এবং টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও নিজের দুই সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছি। আমি কেন, কোন চা শ্রমিক মা-ই চাইবেন না এত অমানবিক জীবন পার করুক তার সন্তানরা"।
এখানে উল্লেখ্য হবিগঞ্জ জেলার চা বাগানগুলোতে প্রায় লক্ষাধিক নারী শ্রমিক কাজ করেন মোট ২৪ টি চা বাগান মিলে।
নামীদামী ব্র্যান্ডের চা খেয়ে আমরা যারা প্রাত্যহিক আমাদের সকালের যাত্রা শুরু করি এবং সেই সাথে সজীবতার নিঃশ্বাস নেই তারা কয়জনই বা জানি এসকল মানুষদের নিষ্পেষিত জীবনব্যবস্থার কথা! কয়জনই বা জানি এই চা উৎপাদন করতে যেয়ে বেশিরভাগ নারী শ্রমিককেই হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিতে হয়! চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি যেমন বাড়তে দেওয়া হয় না তেমনি বাড়তে দেওয়া হয় না লেবার লাইনে চা শ্রমিক নারী এবং তাদের পরিবার বসবাস করার জন্য বরাদ্দ বাগান কর্তৃপক্ষ থেকে ২২২ বর্গফুটের অর্থাৎ ৮ হাত বাই ১২ হাতের ছাউনিকেও। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়া ঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের। বাগানের সবুজের হাসি আমরা খুব দেখতে পাই কিন্তু দেখতে পাই না কেবল শ্রমিকের কান্না এবং আহাজারি !
মধ্যযুগের ভূমি দাশের মতোই চা মালিকের বাগানের সাথে বাঁধা এই সকল সহজ সরল শ্রমিকের জীবন কাঠামো। শ্রমিকের দুঃখ দুর্দশার অন্তহীন চিত্র সহজেই অনুমান করা যায় তাদের জীবনযাত্রার দিকে তাকালেই। কখনো ভেবেছেন কি কথিত মধ্যম আয়ের দেশে এসকল শ্রমিকরা মাত্র ৮৫ টাকা মজুরী দিয়ে কিভাবে কতটা অসহনীয় ও অমানবিক জীবনপার করছে ! ভাবা যায় সবুজঘেরা বিস্তৃত প্রান্তরে কিভাবে বর্বরোচিত জীবন আজোও পরিচালিত করছে এই শ্রমিকরা বিশেষত নারী শ্রমিকরা !
লেখক: সংগঠক চা শ্রমিক আন্দোলন ও সাবেক ছাত্রনেতা