কালচার মেশিনকে সাধুবাদ
প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৭, ০৮:৪৫
পিরিয়ড-মাসিক-ঋতুস্রাব নিয়ে কথা বললেই একপক্ষ মনে করেন আহা নিজেকে আধুনিক দেখানোর জন্য এখন গোপন বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করেছে! ছ্যাঃ ছ্যাঃ!
বেশিরভাগ ফেসবুকার বন্ধু বিশেষত যারা নিজেদের রক্ষণশীল দেখিয়ে আনন্দ পান; তারা বলেন, আমাদেরও তো ঘরে মা-বোন ছিল, তাদেরও তো মাসিক হতো, কোনদিন এত আদিখ্যাতা করতে দেখিনি তো! বরং মাসিক হলে তারা একটু চুপচাপ আলাদা হয়ে যেতেন। মাসিক যেন খুব লজ্জার বা গোপন কিছু তাই তা যত লুকিয়ে রাখা যায়, ততই তার সম্ভ্রম রক্ষা পায়! আহা, আর এখনকার নারীদের দেখো, বেশরমের মতো প্যাড কিনছে আবার সবার সামনে বলছে, আমার মাসিক হয়েছে, বিরক্ত কম করো!
অথচ নারী শরীরে ঋতুস্রাব বা ঋতুচক্র না থাকলে মানুষের জন্ম প্রক্রিয়াটাই বন্ধ হয়ে যেতো। এত যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বড়াই তাই থাকতো না- পৃথিবীটা বন্ধ্যা হয়ে যেতো- যদি না নারী ঋতুস্রাবের আশীর্বাদে পূর্ণ হতো। ঋতুস্রাব নারীদেহে স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও - বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে মাসিক শুরুর প্রথম দিনটা ভয়াবহ। অসম্ভব ব্যথা- এর বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। ঋতুস্রাব বা মাসিকের সময় তলপেটে কোনো ব্যথা বা কষ্টদায়ক অনুভূতি হয় না, এমন নারীর সংখ্যা কম। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এ ব্যথার পরিমাণ যখন এমন হয় যে তা দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করে, তখনই কেবল এটাকে অসুস্থতা বা ডিজমেনোরিয়া বলে গণ্য করা হয়।
ডিজমেনোরিয়া দুই ধরনের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি।
প্রাইমারি ডিজমেনোরিয়া:
সাধারণত ১৮ থেকে ২৪ বছরের তরুণীরা এতে বেশি ভোগেন। এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা নেই, তবু কারণ হিসেবে কিছু বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়ে থাকে। যেমন, মাসিকের সময় ব্যথার প্রতি সংবেদনশীলতা বেড়ে যাওয়া, ঘরে-বাইরে অশান্তি, পরীক্ষার চাপ, বেকারত্ব, ভগ্নস্বাস্থ্য ইত্যাদি। এ ছাড়া গবেষণায় কিছু হরমোনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে অন্তত একবার গর্ভধারণ এবং স্বাভাবিক প্রসবের পর এ সমস্যাটি আপনা আপনি সেরে যায়। (সূত্র: হেলথবাংলা.কম)
সেকেন্ডারি ডিজমেনোরিয়া:
অনেক গাইনি রোগের কারণে মাসিকের সময় ব্যথা হতে পারে, যেমন-তলপেটের ইনফেকশন, জরায়ুর টিউমার, পলিপ, জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি। বিবিধ কারণ থাকায় মাসিকের সময় ব্যথার ধরনও ভিন্ন হয়ে থাকে। (সূত্র: হেলথবাংলা.কম)
ঋতুস্রাবে কর্মজীবী নারীদের জন্য প্রথমদিনে ছুটি ঘোষণা:
এখানেই শুরু হয়ে যাবে এক পক্ষের- তোমরা নারী-পুরুষ সমানাধিকার চাও আবার মাসিকের প্রথম দিনে ছুটি চাওয়া কেন ভাই?
সোজা উত্তর দিন, তুমি তাহলে তোমার শরীরে ঋতুস্রাব প্রক্রিয়া ঘটিয়ে ভবিষ্যতে একজন মা হওয়ার দায়িত্ব নাও- এবং ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করার দায়িত্বখানা নাও, আমি আর ছুটি চাইবো না। তুমি যদি ব্যথা নিয়ে কাজে আসতে পারো, তাহলে আমিও পারবো।
এখানে আমার ফেমিনিস্ট পাঠকশ্রেণী আবার প্রশ্ন তুলতে পারেন, পিরিয়ডের যত্নের সংগে 'মা' সম্পর্কটা জড়ানো কি খুব জরুরি? যেসব নারী 'মা' হতে চায় না বা পারবে না তাদের কি যত্নের প্রয়োজন নাই? এসবের সঙ্গে তারা আবার অত্যন্ত সযত্নে পবিত্র গরু জাতীয় শব্দ জুড়ে দিবেন। লক্ষ্য করবেন, ফেমিনিস্ট আপা- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আপনি আপনার মাসিকের ব্যথার কথা আপনার জন্মদাতা পিতা বা ভাইয়ের সণ্ণগেও ভাগ করতে সংকোচবোধ করেন, সেখানে ঋতুস্রাবের জন্য আপনি অফিসে ছুটি নিবেন, আর আপনার তথাকথিত মনমানসিকতার পুরুষ সহকর্মীরা যখন গা টেপ্পনি শুরু করবেন, তখন আপনি তাদের হলিকাউ বানিয়ে দিতে পারবেন না। সমাজে পরিবর্তন আনতে হলে প্রথমে নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয়। প্রথমে ঘর থেকে তার আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-সমাজ-কর্মক্ষেত্র-রাষ্ট্র। যেখানে আমরা নিজের ঘরে বাপ-ভাইকে এখনও এই দিনটির যত্নের বিষয়টি পবিত্র গরুর মতো তুলে ধরতে পারিনি, সেখানে কর্মক্ষেত্র অনেক দূরের বিষয়।
পশ্চিমা বিশ্বে পিরিয়ড হলে নারী ছাত্রীরা শিক্ষককে বলে ছুটি নিয়ে চলে আসতে পারে, কর্মক্ষেত্রে বসকে বলে ছুটি নিতে পারে। কিন্তু ভারতীয় উপামহাদেশে সে বিপ্লব তৈরী করতে আর হলিকাউ লিখতে আরো ১০০ বছরের শিক্ষা ও একটি রেনেসাঁ আন্দোলনের প্রয়োজন। যে দেশে সমকামিতার কথা বললে প্রথম যুক্তি দেয়, তাহলে এরা বাবা-মা হবে কিভাবে বা কোন পদ্ধতিতে? সে দেশে পিরিয়ডের সঙ্গে মাতৃত্ব জড়িয়ে থাকে। এখানে ভাববার মতো বিষয় হলো, এঙ্গেলা মার্কেলের মতো বিশ্বের একজন প্রধান নারী নেতৃত্ব প্রতিনিধি ও ফেমিনিস্ট দাবী করা নেতা, সমকামিতার বিপক্ষে ভোট দেয়- কারণ, তিনি মনে করেন, একজন পুরুষ ও নারীর সহযোগিতায় তাদের স্পার্মের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম, তারাই অফিসিয়ালি স্বামী-স্ত্রী হবার যোগ্যতা রাখে, তখন আমাদের হলিকাউ বনে যেতে হয়।
আপনার ইচ্ছা হলে আপনি মা হবেন বা হবেন না, সেই যুক্তি দিয়ে যদি আপনি হলি কাউয়ের মতো অফিস থেকে ছুটি পেতে পারেন, তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। এখনও ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশে নারীরা মাতৃকালীন ছুটিতে যায় বলে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিশেষ শাখায় নারী সহকর্মী নিতে চায় না, আর নিজের পিরিয়ডের প্রতি যত্নবান হতে ছুটি! সত্যিই হলি কাউ! আমি এই লেখাটা লিখতে লিখতে ভাবছিলাম না জানি নারী সহকর্মী রিক্রুটিং এর পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়! তারপরও আমি হলিকাউ এর মতো আশাবাদী হতে চাই। কারণ একজন নারীর সত্যি এ দিনগুলোতে যত্ন নেওয়া জরুরি। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ সুবিধা শুধু পু্ঁজিবাদী রাষ্ট্র তো নয়ই, সমাজতান্ত্রিক দেশেও নাই।
যেখানে সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মে ঋতুস্রাব হওয়া মানে অচ্ছুত/অচ্ছৎ সেই ভারতে একটি মিডিয়া কোম্পানি তাদের মহিলা কর্মীদের জন্য মাসিক ঋতুস্রাবের প্রথম দিনে সবেতন ছুটি দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেছে। 'কালচার মেশিন' নামে ওই সংস্থাটি বলছে, মাসিকের প্রথম দিনটি যে মেয়েদের জন্য শারীরিকভাবে অস্বস্তিকর এবং কাজের জন্য আদর্শ নয় - এই বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিতেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (সূত্র: বিবিসি)
এমন একটি অসাধারণ সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। আশা করছি, এমন একটি সিদ্ধান্তের অনুকরণ বাংলাদেশেও অচিরেই ঘটবে। নারীদের এই একটি দিন ছুটি দিয়ে তাদের প্রতি দয়া বা করুণা করা হয় না। বরং এই একটি দিন ছুটি পেলে নারীরা পরেরদিন দ্বিগুণ প্রাণশক্তি নিয়ে কাজে নামতে পারবে। তাই আসুন, আমরাও কালচার মেশিনের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই এবং আমাদের নিজ নিজ কর্মসংস্থানে দাবী জানাই- এই একটি দিনের ছুটির জন্য।
লেখক: প্রবাসী ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট