তবু ভাল যে আমরা নড়েচড়ে বসেছি
প্রকাশ | ১৫ জুলাই ২০১৭, ০৮:৩১
চার বছর আগে স্কুলে চাকুরী করার সময় শিশুর সুরক্ষা বিষয়ক একটা ট্রেনিং এ জেনেছিলাম শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েশিশুরা, কাদের হাতে সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তালিকাটা ছিল এরকম:
১। নিজ বাবা
২। নিজ ভাই
৩। সৎ বাবা
৪। সৎ ভাই।
যখনই বাংলাদেশী কারো কাছে একথা বলেছি, তারা প্রতিবাদ করেছেন। 'এমনটা হতেই পারে না, হলেও তা নির্লজ্জ অসামাজিক সাদাদের জগতে হতে পারে। আমাদের দেশে, যেখানে ধর্মচর্চা আছে, এসব কিছুতেই ঘটতে পারে না।'
আরে ভাই, এই অসামাজিক অধার্মিক সাদাদের দেশে তো তবু এসব নিয়ে গবেষণা হয়, সমীক্ষা হয়, আলোচনা হয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশে এ নিয়ে আলোচনা হয় না বলেই অমন সহজে ধোয়া তুলসী পাতা ভাব ধরতে পারেন। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকবেন আর কতদিন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে অথবা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপ্তির কারণে আজকাল কিছু ঘটনা সামনে এসে আমাদেরকে বিস্মিত, বিহ্বল করে দিচ্ছে। আমরা চমকে উঠছি কিন্তু তারপরও আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন? মেয়েটা এতোদিন কেন মুখ বন্ধ করে ছিল, এই প্রশ্নও উঠছে। আমি কেন ডিভোর্স নিতে আঠারো বছর সময় নিলাম, সে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকেও বহুবার।
জন্ম থেকেই 'লজ্জা নারীর ভূষণ' কথাটা মেয়েদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদেরকে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে চিরতরে নীরব করে দেয়া হয়। সমাজের সমস্ত অব্যবস্থা, অসুস্থতা, অপরাধ- সবকিছুর লজ্জার দায় কাঁধে নিয়ে একটা মেয়ে চুপ করে বছরের পর বছর ধর্ষিত হয়ে যাবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
আমার বন্ধু জিনাত হাসিবা স্বর্ণা তার একটা স্ট্যাটাসে একটা সুন্দর কথা বলেছে 'আমি নড়ে চড়ে বসি যখন মেয়েটা বলে দেয়। নিজের কাছে বলে দেয়। সবার কাছে বলে দেয়। মুহূর্তে বলে দেয়, মিনিটে বা ঘন্টায় বা দিনে বা মাসে বা বছরে- এক, দুই, তিন...৮,...১৫....২০ যতো বছর পরেই হোক। একবার দুইবার হয়রানি, তারপর নির্যাতন, তারপর মেনে নেওয়া, তারপর অভ্যস্ততা, এমনকি কোনো এক পর্যায়ে ভালো লাগাও যদি হয়- মেয়েটা যখনই বলে দেয় অন্যায় হয়েছে, অন্যায় হয়েছিলো, কিংবা শুধু বলে দেয় 'এরকম টা হয়েছিলো', তখনই আমি নড়ে চড়ে বসি। শুনতে চাই। বলতে দিতে চাই। ও বলুক, অন্যরা জানুক, ভবিষ্যতের মানুষগুলি নতুন করে গড়ে উঠুক।'
একটা মেয়ে যখন আটবছর ধরে নির্যাতিত হবার পর মুখ খোলার সাহস পায়, তখন তার দিকে কান পেতে দিতে হয়। দীর্ঘ নির্যাতনের দীর্ঘ বেদনা আর গভীর ক্ষত নিয়ে যখন সে শেষপর্যন্ত মুখ খোলার সাহস অর্জন করতে পারে, তার তখন অনেক কথা বলবার থাকে। সেই কথাগুলো কান পেতে শুনতে হবে।
দীর্ঘ অথবা অন্তহীন নীরবতা, অন্তত একটা বাংলাদেশী মেয়ের ক্ষেত্রে আমাকে মোটেই অবাক করে না। আমি ব্যক্তিগত জীবনে এমন মায়েদের চিনি যারা লোকলজ্জার ভয়ে নিজের মেয়ের নির্যাতকের পরিচয়ই শুধু গোপন রাখেন না তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্কও বজায় রাখেন। অনেক সমাজসেবককে দেখেছি যারা নিজের ঘরের মেয়েদের প্রতি আত্মীয় পুরুষের অসামাজিক আচরণকে বেমালুম চেপে যান।
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে নিজের বাবার হাতে মেয়ের ধর্ষিত হবার বহু খবর পত্রিকায় দেখেছি, কিন্তু এ নিয়ে তেমন তোলপাড় হতে দেখিনি। এবার আসামী একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের প্রকৌশলী তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলেই কি এতো আলোচনা হচ্ছে? আগুনের আঁচ এবার আমাদের নিজেদের গায়ে খানিকটা লাগছে বলেই কি সবাই নড়েচড়ে বসেছি? এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক কাভারেজ হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। তবু ভাল যে হচ্ছে, তবু ভাল যে আমরা নড়েচড়ে বসেছি।
এক্ষেত্রে নির্যাতনকারী শুধু একজন সৎ বাবাই নন, বরং মেয়ের নিজের মা-ও। বহুদিন ধরে এই বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছি, গালিচার নিচে ঠেসে দেয়া এই সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি। সবচেয়ে নির্ভরতার স্থানটিতেই যে শিশুরা সবচেয়ে বেশি অসহায় এবং নির্যাতনের শিকার- এই সত্যটা মাথায় রাখলে হয়তো আমরা আমাদের শিশুদেরকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারব।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক