যে দেশের স্কুলে বই নেই, পরীক্ষা নেই
প্রকাশ | ০৮ জুলাই ২০১৭, ০১:০৫
ক্লাসরুমে ঢুকতেই ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা। টেবিলের চারপাশে চারজন আর একজন দাঁড়িয়ে লুডু জাতীয় কিছু একটা খেলা নিয়ে আলোচনা করছে।
ভাবলাম কোথায় এসে পড়লাম! কিছুক্ষণ পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইংরেজিতে বিশ্লেষণ করলেন খেলার মর্মার্থ। সাথে ছিলেন খেলাটির আবিষ্কারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি যিনি আসলে দাঁড়িয়ে থেকে কোমলমতি ছাত্রদের খেলাটি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন। এটা ছিল একটা পরিবেশ বিজ্ঞানের ক্লাস, শিশুদের পরিবেশ সচেতনতার উপর খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আরেকটা শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ভাবলাম কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ক্লাস হবে হয়তো। কিন্তু জানতে পারলাম এটা সিভিক্স এর ক্লাস, কম্পিউটার গেমসের মাধ্যমে ইতিহাস ও সভ্যতা সম্পর্কে তাদের চিন্তা-চেতনা কী তা বের করে আনার চেষ্টা চলছে।
উপরের দুটি দৃশ্য ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত দিক। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ফিনল্যান্ডের বিশ্বসেরা হবার দৌড়ে মূলত কাজ করছে এই ‘গেমিং অ্যাডুকেশন’ বা খেলার মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতি। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি শিশুদের মনোবিকাশে এই গেমিং অ্যাডুকেশন পৃথিবী জুড়েই পরিচিত।
অন্যদিকে নেই কোনো পাঠ্য-পুস্তকের ঝামেলা। নেই কোনো পরীক্ষার বালাই। দিনের শুরুটা হয় বাইরে খেলাধুলা, বনজঙ্গল অথবা দর্শনীয় জায়গা দেখায়। তারপর হাতেকলমে পাঠদান। মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রম ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা। বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা ব্যবস্থা। আর আছে সমসাময়িক সব আয়োজন, সবই বয়স ও মানসিক দিক বিবেচনায়। এর মাঝে খাওয়া-দাওয়া যা অবশ্যই পুষ্টিমান বিবেচনায় সেরাটাই দেয়া হয়। রয়েছে ধর্মীয় আচার মেনে চলার ব্যবস্থাও।
ফিনল্যান্ডের শিশুরা মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথাগত শিক্ষা শুরু করে। হ্যাঁ ঠিক শুনছেন, সাত! শিক্ষার শুরুটা এমনি যেখানে শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষা নেয়। প্রাথমিকের এ পর্যায়ে শিশুরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকে। যখন তারা নবম শ্রেণিতে উঠে, তখন তারা তাদের পছন্দসই বিষয় নিতে পারে। তারপর উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ধাপের জন্য আস্তে আস্তে প্রস্তুত হয়।
ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলো সকাল আটটায় শুরু হয়ে চলে চারটা পর্যন্ত। কিছু কিছু শ্রেণির পাঠ দান দু’টার মধ্যে শেষ হয়। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে বয়ঃসন্ধিকালে সকালের ঘুম খুবই প্রয়োজন বলে এখানকার স্কুলগুলো সকাল নয়টায় শুরু করে দুপুরেই শেষ হয়। এর মধ্যে কয়েকটি বিরতি থাকে।
কারো যদি কোনো ক্লাস ফাঁকা থাকে সে ইচ্ছা করলে ওই সময়টুকু স্কুলে নাও থাকতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা যায় ফিনল্যান্ডে একজন শিক্ষক বছরে ছয়শ’ কর্ম ঘণ্টা পায় যা কিনা দৈনিক ৪ ঘণ্টার মতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকরা দ্বিগুণ অর্থ্যাৎ এক হাজার আশি ঘণ্টা ব্যয় করে। এখানকার শিক্ষক-ছাত্ররা পড়ালেখার নির্দিষ্ট সময়ের পরেও বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনায় বেশি সময় দিয়ে থাকে।
ফিনল্যান্ডে আছে একই শিক্ষকের অধীনে দীর্ঘ শিক্ষা কার্যক্রম। এর ফলে দেখা যায়, একজন ছাত্র বা শিক্ষক একে অপরকে ভালো করে জানতে পারে- কার কী দুর্বলতা, কার কী সমস্যা, কার কোথায় পরিচর্যা বা মনোযোগ বেশি দিতে হবে ইত্যাদি। এতে করে ব্যক্তিগত শিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন ছাত্র এক শিক্ষকের কাছে প্রায় ছয় বছর শিক্ষা লাভ করে। তাই কেউ চাইবে না তার সন্তান অসৎ বা খারাপ চরিত্রের শিক্ষক পাক। তাই ফিনল্যান্ডের শিক্ষক নিয়োগে তার অতীত ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। শুধু তাই নয়, শিশু অপরাধ বা যে কোন অপরাধে জড়িত কেউ শিক্ষক হতে পারেন না। আরও চাই সাধারণ শিক্ষা ডিগ্রির পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতার সনদ।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত হবার পেছনে ক্লাসের ফাঁকে দীর্ঘ অবসর ব্যবস্থাও কার্যকর বলে প্রমাণিত। প্রতিটা ক্লাসের মাঝে ১৫ মিনিটের বিরতি ছাড়াও রয়েছে ৪৫ মিনিটের দুপুরের খাওয়ার বিরতি। এতে করে ছাত্ররা তাদের পরবর্তী ক্লাসের জন্য মনোযোগী হতে পারে। বলে রাখা ভালো এখানে শিক্ষার জন্য খাদ্য নয়, বরং শিক্ষার জন্য সঠিক খাদ্যমান বজায় রাখতে এবং ক্ষুধামুক্ত শিক্ষা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য।
প্রথাগত পরীক্ষার চাইতে বিভিন্ন রকমের ব্যবহারিক ও কারিগরি বিষয়ে নজর দেয়া হয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায়। আমাদের দেশের একজন শিক্ষার্থী যখন গাদাগাদা বই পড়ে পরীক্ষার আগে, এখানকার শিক্ষার্থীরা সেই সময়ে কারিগরি শিক্ষায় নজর দেয়। যেমন- হাতের কাজ, বুনুনের কাজ, সেলাইয়ের কাজ, চারুকলা কম্পিউটার শিক্ষা, গণিতের কঠিন সমস্যা নিয়ে আলোচনা, ভবিষৎ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে চিন্তা-ভাবনা আরো কত কি!
এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো জগাখিচুড়ির মতো বিষয় নির্বাচন না করে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জোর দেয়া। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে ভালো করে জানতে পারে ও কর্মক্ষেত্রে এর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারে।
আমাদের দেশে দেখা যায় বাড়ির কাজের চাপে ছাত্রদের ঘুম হারাম। কিন্তু এখানে শিক্ষাব্যবস্থা এমনি যে বাড়িতে গিয়ে করার কিছুই থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রুপ কাজ থাকে, সুতরাং ক্লাস শেষে সবাই মিলেমিশে তাদের বাড়িরকাজ শেষ করে। এতে করে একে অপরের প্রতি টান ও হৃদ্যতা বাড়ে, খারাপ জিনিসগুলোর প্রভাব কমে যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত অসহনীয় পর্যায়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ১:১০০, ফিনল্যান্ডে মাত্র ১:২০। ফলে ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের সাথে ছাত্রদের বোঝাপড়া ও সমন্বয় বেশি। একে অপরের প্রতি ভাব-বিনিময় বা সমস্যা সমাধানে অধিক সময় দেয়া যায়। এখানকার ছাত্ররা অন্য যে কোনো জায়গার ছাত্রদের চাইতে ভালো ফলাফল করতে পারে।
বাড়ির কাজ আর গ্রুপ কাজ যাই হোক, ফিনল্যান্ডের ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে চমৎকার সমন্বয়, বিশ্বাস ও আস্থার পরিবেশ। যে কোনো সাফল্যের মূলে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থাই চাবিকাঠি, ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় যা নিশ্চিত করা হয় উভয় দিক থেকেই।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কল্পনা করতে গেলে গা শিয়রে উঠে। দেখা যায় প্রায় চার কিলো ভার নিয়ে শিশুদের স্কুল যাত্রা। শিশুদের মস্তিস্ক উন্নতির জন্য চাই অতিরিক্ত পুষ্টি। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য মানসিক চাপ নয়, দরকার পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও হাসি।
বছরখানেক আগে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষামন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান এসেছিলেন এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে, বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে। এর পরে কী অগ্রগতি হলো তা জানা সম্ভব হয়নি। বিশ্বের সেরা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার দেশ হিসেবে পরিচিত ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলো থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে।
লেখক: আইএফজে স্বীকৃত ফিনিশ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান সাংবাদিক নেটওয়ার্কের সদস্য।
প্রথম প্রকাশ: বিডিনিউজ২৪.কম