একলা হাঁটা
প্রকাশ | ২৩ জুন ২০১৭, ২১:৪৭ | আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭, ২২:০১
আমি আয়ার সাথে টুকটাক গল্প করছিলাম। আয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন,
আপনার কি দ্বিতীয় বাচ্চা?
আমি বললাম, না আ!
আয়া আমার চুলে দুই বেনী করতে করতে বললো, বাব্বাহ আপনার তো দারুণ সাহস!
অপারেশন টেবিলে উঠে আমি অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তারকে বললাম,
: ড. আপনার কোন কো-অপারেশন লাগলে আমাকে বলবেন।
ডাক্তার ভদ্রলোক একটু কৌতুকের সুরে বললেন,
: তাই! আপনি আমাকে কো-অপারেট করতে চান? কি কো-অপারেট করবেন বলেন তো?
বলতে বলতে ডাক্তার আমার বাঁকিয়ে রাখা মেরুদণ্ডে ইনজেকশন পুশ করলেন।
আমি চারদিকটা দেখি। মাথার উপর শনি প্ল্যানেট আকৃতির লাইট। চারদিকে এতো এতো আলো, আধুনিক সব যন্ত্রপাতি, আস্থার ডাক্তার- এতো সবের মধ্যে আমার ভয় করবে কেন বুঝলাম না। এসবের মধ্যে আমার মতো একাশি কেজির হাতির মরার তো কোন কারণ নেই। আমার তখন শাহাদুজ্জামানের ছোটগল্প নিজকলমোহনায় ক্লারা লিন্ডেন এর কথা মনে পড়ছিল। ক্লারা লিন্ডেন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়ে। তার গবেষণার বিষয় প্রসব। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রসব সংক্রান্ত ভাবনা, চর্চা এইসব সে সংগ্রহ করছে। দোভাষী মেহজাবীনকে সাথে নিয়ে নিজকলমোহনা গ্রামে আসে। গ্রাম্য ধাত্রী কাশমতি বেওয়ার অভিজ্ঞতা শুনে। কাশমতী বেওয়া চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো কিশোর আব্বাসের জন্মবৃত্তান্ত বলে। কিভাবে, কতরকম দুর্বিপাক পার করে মাছকাটা বটি দিয়ে আব্বাসের নাড়ি কেটেছিল কাশমতী- সেসব শুনতে শুনতে ক্লারা উত্তেজিত হয়ে ভাবে, দারুন এক্সোটিক সব ডাটা পাওয়া গেল। থিসিসটা দুর্দান্ত হবে-
"হায় আব্বাস, গণণা, গীত, বাজনা, আগুন মিলিয়ে তোমার জন্মটা কত কালারফুল অথচ তার পাশে সাদা অ্যাপ্রোন, গ্লাভস, ফোরসেপ, টিভি মনিটর ঘেরা আমাদের জন্মদৃশ্য কতটা ম্লান।"
আর দোভাষী মেহজাবীন ভোগে অস্বস্তিতে। "এসব কি অদ্ভুত কাণ্ড! নিজের দেশের ভেতরেই এ কোন অচেনা সুদূর দেশ!"
তো আমারও ক্লারা লিন্ডেন এর কথা মনে মতো মনে হচ্ছিল, আজকালকার জন্মদৃশ্য সাদাসিধে, উত্তেজনাহীন।
আমি শনি প্লানেট এর মতো লাইটে প্রতিচ্ছবি দেখছিলাম, আমারই কেটে ফেলা পেট, ডাক্তারের গ্লাভস পড়া রক্তমাখা হাত।
ডাক্তার সালিমা মুনা আমার সাথে গল্প করতে করতে পেট কাটছিলেন,
: শোন ইরাবতী, তোমার পেটে কিন্তু প্রচুর চর্বি। চর্বি কমাও। এমনিতে তুমি যে ভয়াবহ রূপসী তা কি তুমি জানো?
আমি হাসি। বুঝতে পারি ডাক্তার আমাকে চিয়ার আপ করার চেষ্টা করছেন। আমার হঠাৎ দু'তিন মাস আগের ঘটনা মনে পড়ল। আমার অ্যাবরশন হয়েছিল। সন্ধ্যা থেকে তলপেটে পেইন। রাত বাড়ার সাথে সাথে ব্যথাও বাড়ে। রাত একটার দিকে আমার স্বামী শুভম কোন দিশাবিশা না পেয়ে আমাকে মিটফোর্ড সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমার ছোট খালু ঐ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক বা ঐ জাতীয় কিছু। হাসপাতালে যাওয়ার পরপরই ব্লিডিং শুরু হলো। ভয়াবহ ব্লিডিং। আমি একসময় খালুকে বললাম, খালু আমি তো ব্লিডিং হতে হতেই মরে যাবো।
খালু ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করে শুয়ে থাক। কথা বলিস না। কাল ডাক্তার এসে ডিএমসি করবে।
ডিএমসি করার জন্য সকাল পর্যন্ত কেন অপেক্ষা করতে হবে বুঝলাম না। নার্সকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, রশীদ স্যারের ভাগনি তো আপনি, ভালো অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তার ছাড়া কেউ হাত দেবে না, রিস্ক নেবে না কেউ।
আমি ভাবলাম, এই অতি সতর্কতার জন্যই আমার জীবনটা না যায়!
তারপর আরও রাত বাড়লে যখন ব্লিডিংও একটু কমে এসেছে আমি ক্লান্ত চোখে সরকারী হাসপাতালের হালহকিকত দেখছি ঠিক তখনই ঘটনাটা। স্ট্রেচারে করে এক নারীর নিথর দেহ আনা হলো। ফর্সা নারীটির নাকে জ্বলজ্বল করছিল বরই এর ফুল আকৃতির সোনার নাকফুল। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ছেলেসন্তান হয়েছে, ছেলে ভালো আছে। প্রসবের পর পেটে বাতাস ঢোকা অবস্থায় তার পেট সেলাই করা হয়েছে। সম্ভবত সেখানেই মারা গেছেন তিনি। আমি অবাক হয়ে নারীটির লাল প্রিন্টের শাড়ি পড়া নিথর শরীর দেখছিলাম। সঙ্গের কাউকে কান্নাকাটি করতে দেখলাম না। একজন নাকের বরই ফুল খুলে নিল। এই দেশে বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে মারা যায় কতশত নারী। কি ভাবতে ভাবতে কিংবা হয়তো ব্লিডিং এর ধাক্কায়ই আমি তখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্বামী তখন কোথায় ছিলেন আমি জানি না। দূর থেকে শুধু ছোটখালার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলাম, "ইরাবতী, বাবা, কি হলো, ও ইরাবতী, মা আমার..."
এই ডেলিভারির দিন কেন যেন সেই নারীর মুখ আমার মনে পড়ছিল। আরও কিছুক্ষণ পর, আমার যখন ঘুম ঘুম ঘোর লাগছে, আমার তলপেট থেকে কিছু টান মেরে বের করার অনুভূতি পেলাম। ডাক্তার আমার মুখের সামনে একটি শিশুকে তুলে ধরলেন। কোন কান্নাকাটির শব্দ আমার মনে পড়ে না শুধু চোখে ভাসে অবাক দুটি চোখ! আমি জড়িয়ে জড়িয়ে ডাক্তারকে বললাম, বাইরে নিয়ে যান, সবাই অপেক্ষা করছে।
আসলেই শিশুটা ছিল যতটা না আমার তার চেয়ে অনেক বেশি সমাজের। বিয়ের দু'বছর পর থেকে "বাচ্চা কেন হচ্ছে না" এই প্রশ্নের ক্রমাগত মুখোমুখি হয়ে সমাজ সংসারকে একটা বাচ্চা দিতে চেয়েছিলাম।
তারপর আমাকে পোস্ট অপারেটিভে দেওয়া হলো। ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে ডাক্তার বলল, এবার কিছুক্ষণ ঘুমাও।
আমার কিন্তু ঘুম এলো না। একটা শিশু ভেতরে ধারণ করার পর থেকে এক নিঃসঙ্গ যাত্রার কথা আমার মনে পড়তে থাকে। আমার স্বামী দায়িত্ববান মানুষ, আমাকে ডাক্তার দেখিয়েছেন, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু আরও অনেক অনেক বেদনার সাথী তিনি হননি। মূলত এইসব বেদনা নারীর একার। খুব সেনসিটিভ মানুষ না হলে নারীর এই একলা যাত্রা কারো পক্ষে স্পর্শ করা সম্ভব নয়।
পোস্ট অপারেটিভ এক ফ্লোরে কেবিন আরেক ফ্লোরে। বাচ্চা তখন কেবিনে, সামাজিক মানুষেরা তাকে ঘিরে আছে। সেখানে উল্লাস চলছে আমি দিব্যচোখে দেখতে পাই।
নার্স যখন বলল আপনাকে কেবিনে দেয়া হবে এখন- আমাকে তখন কি এক অজানা-অচেনা অভিমান যেন ছেয়ে ফেললো। মনে হলো, ঐ আনন্দ-আয়োজনে আমি না থাকলেও কিছু যায় আসে না। আমার কাজ আমি করেছি, আপনাদের মানবসন্তান উপহার দিয়েছি। আমার আর কি কাজ! মাতৃত্ব না কি নারীকে পূর্নতা দেয়, আমার তেমন মহৎ অনুভূতি তো হচ্ছে না!
আমি নার্সকে বললাম, আমার এখন ঘুম পেয়েছে। আমি এখন কোথাও যাবো না।
লেখক: সাংবাদিক