হেরে যাইনি, আমাদের সাথে অপরাধ হয়েছে
প্রকাশ | ২৬ মে ২০১৭, ২৩:৫৪ | আপডেট: ২৭ মে ২০১৭, ০১:০৮
(১)
আমাকে ওরা ট্যাগ করেছে একটা পোস্টে, একটা কবিতা সেটা, যার বক্তব্য হচ্ছে আমরা সবাই হেরে গেলাম। বায়ান্ন হেরেছে, একাত্তর হেরেছে, আমরা সবাই হেরে গেছি ইত্যাদি। একজন ইনবক্সে বলেছেন যে খুব হতাশ লাগছে, অসুস্থ বোধ করছি। একজন রূপবতী শিক্ষিকা ম্যাসেজ করেছেন 'ইমতিয়াজ ভাই, মূর্তিটা কি সরিয়েই দিল? সত্যি?' বুঝতেই পারছেন, এইগুলি হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিক্রিয়া। সরকার রোজার মাস শুরু হওয়ার আগের শুক্রবারের সকাল বেলাটা সুপ্রিম কোর্টের সামনের অঙ্গনটা মূর্তিমুক্ত করেছে।
প্রথমেই বলে রাখি, গতরাতে যে সরকার ভাস্কর্যটি সরিয়েছে, সেটা আমার পরাজয় না। এটাকে আমি পরাজয় মনে করিনা। চোর যদি চুরি করে আপনার মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যায় সেটা কি আপনার পরাজয়? ডাকাত যদি বন্দুক নিয়ে আপনার সন্তানকে হত্যা করে সেটা কি আপনার পরাজয়? একজন আইসিসের জেহাদি যদি বোমা মেরে আমার বাড়ি উড়িয়ে দেয় সেটা কি আমার পরাজয়? না। এইগুলি আমাদের পরাজয় না। আমরা হেরে যাইনি। আমাদের সাথে অপরাধ হয়েছে। আমরা আপরাধির শিকার। আমরা প্রতারণার শিকার। আমাদের সম্পদ চুরি হয়েছে।
আফসোসের কথা, আমাদের সাথে এই প্রতারণাটা করেছে যারা ওরা আমাদের অপছন্দের মানুষ না। আমাদের চিহ্নিত শত্রু না। অবশ্য, প্রতারণা জিনিসটাই তো এটা- আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলে আপনাকে বিভ্রান্ত করবে, এরপর আপনার ক্ষতিটা করবে। আমাদের মূল্যবান সম্পদ চুরি করেছে আমাদের বন্ধু। এইটা আফসোসের কথা। কিন্তু বন্ধু যদি তস্করে পরিণত হয় সেটা তো আপনার পরাজয় না।
হেরে যাইনি। আমাদের স্বাধীনতাটা চুরি হয়েছে। এটা পরাজয় না, কেবল একটা কাজ বাড়ল যে আবার স্বাধীনতাটা উদ্ধার করতে হবে।
(২)
শোনেন, এইটা একটা মূর্তি সরানোর বিষয় না। এটা একটা চুরি। কি চুরি হল এখানে? আমার স্বাধীনতা। কিভাবে? বলতেই পারেন যে একটা মূর্তি সরালে আমার স্বাধীনতা কিভাবে চুরি হয়ে গেল? বা জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে কে আমাদের সাথে কি এমন প্রতারণা করল? চুরিটা কি বলি।
এই যে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিয়ে গেল, এটার কারণ কি? হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী নানারকম সংগঠনের দাবী ছিল যে বাংলাদেশে যেহেতু মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, এই দেশে কোন মূর্তি স্থাপন করা যাবেনা। কেন? কারণ ইসলামে নাকি এইরকম মূর্তি স্থাপন অনুমোদিত না। অনেকে এখানে মূর্তি আর ভাস্কর্যের মধ্যে পার্থক্য টানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মোল্লাদের মতে ভাস্কর্য আর মূর্তি এইগুলি সবই এক আর সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। সরকার সেটা মেনে নিয়েছে এবং ফলে ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
দেখেন, একটা ভাস্কর্য বা মূর্তি রাখা বা সরানো নিয়ে কথা না। সুপ্রিম কোর্ট বা সরকার নিজস্ব বিবেচনায় যে কোন স্থাপনা প্রয়োজনে ভাঙতে পারেন বা স্থাপন করতে পারেন। কিন্তু আপনি যখন ওদের দাবীটি মেনে নিচ্ছেন তখন আসলে আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই দেশে সখ্যাগুরুর পছন্দ না এরকম কোন কাজ করা যাবেনা। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ইসলামে অনুমোদন করা হয় না এরকম কোন কাজ বাংলাদেশে করা যাবেনা। এইটাই অন্যায়।
আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছে তার মুল কারণ কি? আমরা বাঙালিরা যখন বুঝতে পারলাম যে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতী গঠিত হতে পারে না, তখনই আমরা পাকিস্তানের সাথে একসাথে থাকতে অস্বীকার করলাম। আমরা বললাম যে এই দেশ হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান সকলের। সবাই যার যার ইচ্ছামতো যে কোন ধর্মীয় বিধান মানতে পারবে কিংবা অস্বীকার করতে পারবে। কেউ কাউকে বাধা দেবেনা। আর রাষ্ট্রের কাজ হবে সকলের এই অধিকারটুকু নিশ্চিত করা।
তাইলে আমার অধিকার আছে আমি ইচ্ছা করলে ইসলামী বিধান মানতেও পারি বা মানতে অস্বীকারও করতে পারি। আমি ইচ্ছা করলে অন্য যে কোন ধর্মীয় বিধান মেনে চলতে পারি বা চাইলে সকল ধর্মকেও ত্যাগ করতে পারি। আমার ইচ্ছা। এখন সরকার যখন স্বীকৃতি দিল যে সংখ্যালঘুর পছন্দের ধর্মীয় বিধানের বিরোধ হয় এরকম কোন কাজ আমি করতে পারব না, তাইলে আমার এই অধিকারটুকু কোথায় গেল? আমার সেই মুক্তিযুদ্ধের অর্জন কোথায় গেল? আমার জাতি গঠনের যে মৌলিক ভিত্তি সেটা কোথায় গেল।
চুরি হয়ে গেল। আমার অধিকার চুরি হয়ে গেল। আমার স্বাধীনতা চুরি হয় গেল আর আমার জাতির সৃষ্টির যে মৌলিক ভিত্তি, সেটিও চুরি হয়ে গেল।
(৩)
আর প্রতারণাটা কি? প্রতারণাটা হচ্ছে যে আমার মুক্তিযুদ্ধের মুল যে ভিত্তি, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতি হবে না, সেই মতটার যে চ্যাম্পিয়ন দল, সেই দল ওদের পুরনো ট্রেড মার্ক ব্যাবহার করে আমাদের কাছ থেকে আমার মুক্তিযুদ্ধের অর্জনটা নিয়ে গেল। এই যে ওরা বাইরে দেখাচ্ছে সেক্যুলার, আর সেক্যুলার পরিচয়ে আমাদের কাছ থেকে ভোট নিল, আর সেই একই কথা বলে আমাদেরকে বারবার বলছে ওদেরকে যেন ক্ষমতায় রাখি ইত্যাদি, ওরা যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার অধিকারটি কেড়ে নিল, সেইটিই প্রতারণা।
এরা বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের পরিচয় বহন করে, বঙ্গবন্ধুর মুল আদর্শটি জলাঞ্জলি দিয়ে দিল। এটি স্পষ্টতই একটি রাজনৈতিক প্রতারণা, রাজনৈতিক চুরি। এই প্রতারণা ও চুরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং দলের নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এরজন্যে সকল দায় দায়িত্ব তাঁর নিজের।
ট্রাজেডি দেখেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যার দিকেই আঙ্গিল তুলে আজকে আমাকে বলতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের অধিকারটি আপনি চুরি করেছেন।