অভিন্ন মায়ের মন
প্রকাশ | ১৪ মে ২০১৭, ১৪:০৭ | আপডেট: ১৪ মে ২০১৭, ১৪:৪৯
স্বপ্না বলেন, “আমি মা হতে পারিনি এই দুঃখের চেয়েও বড় দুঃখ হলো, আমার স্বামী আবির কখনও চিকিৎসকের কাছে যেতে চায়নি। বছরের পর বছর আমি একা এক নারী এখানে-সেখানে ছুটেছি। আবির কখনও মানতেই চায়নি যে, তারও সমস্যা থাকতে পারে। সবদিক হারিয়ে আমি যখন এই বাচ্চাটি দত্তক নিই, তখনও সে আমার পাশে থাকেনি। সব সংগ্রাম আমি একাই করেছি মাতৃত্বের হাহাকার পূরণের জন্য। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, সমাজ থেকে আমার বন্ধ্যত্ব উপাধি ঘোচানোর জন্য। কেননা আমার দোষ থাকুক বা নাই থাকুক, সমাজের চোখে ‘বন্ধ্যা’ আমিই ছিলাম। আমি কখনোই মনে করি না ‘কাজল’ আমার দত্তক সন্তান। মনে হয় কাজল আমার আপন রক্তের চেয়েও মূল্যবান কিছু, আমার অন্তরের অক্সিজেন, আমার সত্তা।”
কন্যা-জায়া-জননী- এই তিন রূপে সার্থক হয়ে ওঠেন নারী। তবুও কখনও কখনও সৃষ্টিকর্তার খেয়ালে কোনো কোনো নারী জননী হয়ে উঠতে পারেন না। মা হতে না পারার দায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর ওপর বর্তিত হয়। অনেক পুরুষই এ ক্ষেত্রে নিজেদের দায় স্বীকার করেন না, চিকিৎসাও করেন না পাছে সমাজে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। সন্তান না হওয়ার কারণে পুরুষ একাধিক বিয়েও করেন কিন্তু খুব কম নারীই আছেন যারা শুধু এ কারণে স্বামীকে তালাক দিচ্ছেন বা অন্যত্র বিয়ে করছেন। যেসব সংসারে পুরুষের কারণে নারী মা হতে পারেন না, নারী সেখানেও আজীবন কষ্টটাকে সমানে সমানে ভাগ করে নিয়ে ওই সংসারেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। নিজেদের সন্তান না হলে অন্যের সন্তান দত্তক দিয়ে আপন সন্তানের মতোই মায়া-মমতা-ভালোবাসা দিয়ে বড় করে তোলেন অনেকে। সেই ইচ্ছাটাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর থাকে।
‘এটা ভাবতে গিয়ে কোনো কূল খুঁজে পাইনি আমি, যখন মেয়ের পাশে থাকতে পারব না তখন তার কী হবে! মেয়ের জন্য আমি আমার নিজের ভবিষ্যৎ, আমেরিকা গিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন ত্যাগ করেছি।’ বিয়ের ১০ বছর পর একটি কন্যাশিশু দত্তক নেন মহুয়া-পলব দম্পতি।
মহুয়া বলেন, ‘জন্মের ৫ ঘণ্টা পর মেয়েটিকে আমি কোলে নিই। ওকে পেয়ে মনে হয়েছে আমার জীবনের যত অপূর্ণতা ছিল, অন্তরে যে হাহাকার ছিল, সব যেন নিমিষেই মিটে গেল। আমি যেন আমার আপন সন্তান বুকে চেপে ধরেছিলাম। আমার কলিজাটা ভিজে যাচ্ছিল। মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমি কখনও ভাবতে পারি না মেয়েটি আমার নয়। কেউ যদি কখনও এই প্রসঙ্গে কিছু বলে, আমার কাছে কিছু জানতে চায় মনে হয় কেউ আমার কলিজাটা ছিঁড়তে চাচ্ছে। আমি সেখান থেকে উঠে যাই। আর মেয়েটাও আমাকে এত ভালোবাসে জানি না জগতে আপন সন্তান এবং মায়ের মধ্যে এমন ভালোবাসা আছে কি-না।’
বলতে বলতে চোখ ছলছল আর কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে মহুয়ার- “আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ের মুখের তিনটি কথা শুনলে জগতে আর অন্যকিছু ভাবতে পারি না আমি। মেয়ে যখন বলে, ‘মা তুমি আমেরিকা যাবে না, তুমি মরবে না, তুমি অসুস্থ হবে না।’ আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে রেখে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যাব না। আমি যেমন থাকি, যেভাবেই থাকি, এখানেই থাকব, আমার বুকের নিধিকে বুকে জড়িয়ে পড়ে থাকব। পাঁচ বছর কেন, ৫ ঘণ্টার জন্যও মেয়েকে আলাদা রাখতে পারব না আমি।”
সূত্র: সমকাল