ধর্ষণ: ইজ্জতের ইকোনমিক ট্রাঞ্জেকশন !
প্রকাশ | ১২ মে ২০১৭, ২০:১২ | আপডেট: ১২ মে ২০১৭, ২১:২৩
ধর্ষণ বিষয়ে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্যে বাংলা সিনেমার দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। এখনকার কথা বলতে পারবো না, কিন্তু দশকের পর দশক বাংলা সিনেমায় ধর্ষণের ঘটনাকে 'ইজ্জত নষ্ট' অথবা 'ইজ্জত লুট' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্ষণ যে একটা শারীরিক হামলা বা সহিংসতা, এই ধরণের শব্দ থেকে তা বোঝা যাচ্ছে না। নষ্ট করা অথবা লুটের ধারণা সম্পদের সাথে যুক্ত। সহিংসতা এক ধরণের অপরাধ, প্রোপার্টি ড্যামেজ বা লুট আরেক ধরণের। অর্থাৎ আমাদের সমাজে ধর্ষণ সহিংসতার অপরাধ না, প্রোপার্টি ড্যামেজ বা লুট হওয়ার অপরাধ। আর এই ড্যামেজ বা লুট হওয়া জিনিসটি হলো - ইজ্জত।
ইজ্জত কি জিনিস? সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে বোঝা দরকার কার ইজ্জত? ভিক্টিমের? তা মনে হয় না। কারন ধর্ষণকে ইজ্জত নষ্ট বা লুট হওয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য, পুরুষের আবিষ্কার। নারীকে এখানে দেখা হচ্ছে পিতা, ভ্রাতা অথবা স্বামীর সম্পদ হিসাবে। ফলে সেই সম্পদ নষ্ট বা লুট হওয়ার ধারণা চলে আসছে। আর ইজ্জত বা সম্মানের ধারণা যে একটা অর্থনৈতিক ধারণা তা আজকাল নৃতাত্ত্বিকরা দাবি করে থাকেন। অর্থ বা টাকার ধারণার উৎসও পাওয়া যায় সম্মানের ধারণার মধ্যে। ইজ্জত বা সম্মান সংক্রান্ত আলোচনা তাই মূলত ইকোনোমিক ট্রাঞ্জেকশন সংক্রান্ত আলোচনা। আমাদের সমাজে এটা খুব ভালোভাবে দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে ধর্ষিতার পরিবারকে টাকা দিয়ে মিমাংসা করার ঐতিহ্যের মধ্যে।
ধর্ষিতার বিষয়ে পুরুষদের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টা আরো ভালোভাবে বোঝা যায়। বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনার পর আমরা অনেক পুরুষদের মধ্যে যে ভিকটিম ব্লেমিং-এর প্রবণতা ও যে ভাষায় তারা প্রতিক্রিয়া জানায় তা খেয়াল করলে দেখা যায় যে ভিকটিম একজন সম্মানিত নারী কি না সেইদিকে জোর দেয়া হচ্ছে। পতিতা, মিডিয়া কর্মী, সিনেমার নায়িকা, পার্টি গার্ল এমন নানান পরিচয়ের নারীদের সম্মানিত নারী বলে মনে করা হচ্ছে না। রাত নয়টার পরে বার্থডে পার্টিতে থাকা পার্টি গার্লদের সম্মান আমাদের আদর্শ মা, বোন, স্ত্রীদের সমান নয় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। আর যার সম্মান বা ইজ্জত কম অথবা একেবারেই নাই, তার সম্মান বা ইজ্জত লুট হওয়াটা গুরুতর অপরাধ বলে মনে করা হচ্ছে না। অথবা তাদেরকে পাবলিক প্রোপার্টি বিবেচনা করে প্রোপার্টি ড্যামেজ বা লুট হয় নাই বলে মনে করা হচ্ছে।
একজন প্রগতিশীল পুরুষ যদি নারীদের পোশাক ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক করতে যায়, তখন সাধারণত তাকে এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় যে সে তার মা, বোন, স্ত্রীকে তেমন পোশাক পরতে দেবেন কি না, অথবা রাত নয়টার পর পার্টিতে যেতে দেবেন কি না। আর কোন প্রগতিশীল নারী একইরকম তর্ক করতে গেলে সরাসরি ধর্ষণযোগ্য ট্যাগও খেয়ে যেতে পারেন। অবশ্য আজকাল ধর্ষণের বিরুদ্ধে ফেসবুকে যারা প্রতিবাদ করছেন, সেই পুরুষদের একটা বড় অংশও ধর্ষণকে ইজ্জত বা সম্মানের ধারণার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারেন বলে মনে হয় না। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ও ধরণের মধ্য দিয়ে তা বোঝা যায়। ধর্ষণ বড় অপরাধ, তবে হত্যাকাণ্ডের চাইতে বড় নয়। তনু হত্যাকাণ্ডের পর দেখলাম মানুষের মধ্যে তার হত্যার চেয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধেই আউটরেজটা বেশি। আমার মনে হয় এই ধরণের আউটরেজ আমাদের সমাজের কালেক্টিভ পুরুষালি ইজ্জতের সাথে যুক্ত।
আধুনিক দুনিয়া চলে মর্যাদা তথা মানবিক মর্যাদার ধারণার উপর ভিত্তি করে। ইংলিশে যাকে বলে - হিউম্যান ডিগনিটি। তবে ধারণাটি অনেক পুরাতন। খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম এই ধারণাটির বিকাশে ভুমিকা রেখেছে। ইসলামে মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত, সকল প্রাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাণ। কোরান শরিফে আছে আল্লাহ আদম সন্তানকে সকল প্রাণের উপর মর্যাদা দান করেছেন। মর্যাদার ধারণা মানুষ হওয়ার সাথে যুক্ত, নারী অথবা পুরুষ হওয়ার সাথে না। বাইবেল, কোরান থেকে যে মর্যাদার ধারণার সূত্রপাত; ফরাসি বিপ্লব এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশনের পথ ধরে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও দেশের সকল মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ধারণাটি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনো বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নূন্যতম মানবিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই। কিন্তু আমাদের সমাজে সম্মানের ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী। জগতের সবচাইতে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, দরিদ্র এবং মানবিক মর্যাদা বিবর্জিত একটি জাতির সম্মানের ধারণা এতো টনটনে কিভাবে হয়?
কারণ ধারণাটা ক্ষমতাবানদের। নৃতাত্ত্বিক ডেভিড গ্র্যাবার যথার্থই বলেছেন যে- সম্মান হল উদ্বৃত্ত মর্যাদা (surplus dignity)। অর্থাৎ অপরের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে যারা ক্ষমতাবান হয়, সম্মান জিনিসটা তাদের। বাংলাদেশে ক্ষমতাবান মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না। কিন্তু এই দেশের সকল পুরুষই নারীর মর্যাদা কেড়ে নিয়ে নিজেদেরকে সম্মানিত করে রেখেছে। হতে পারে সারা দুনিয়ায় বাঙালি পুরুষের মর্যাদা তেমন নেই, কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে নারীর মর্যাদার বিনিময়ে যে উদ্বৃত্ত মর্যাদা বা সম্মান সে লাভ করেছে, তা ছাড়তে তো সে চায় না। ফলে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আমাদের পুরুষেরা অথবা পুরুষালি সমাজ যাই বলুক না কেন, দিনশেষে তা সাধারণত সম্মান বা ইজ্জতের ইকোনোমিক ট্রাঞ্জেকশনের আলাপের মধ্যে আটকে থাকে।
পারভেজ আলম এর ফেসবুক থেকে