সাজেকে খাদ্যাভাব: ত্রাণ সমাধান নয়
প্রকাশ | ১১ মে ২০১৭, ১৮:৪৯ | আপডেট: ১১ মে ২০১৭, ১৯:০১
প্রথমে বর্তমান পরিস্থিতি জেনে নেই। গত দুইমাস ধরে খাদ্যাভাবে রাঙামাটির দুর্গম সাজেক ইউনিয়নের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার এখন দুর্ভিক্ষ কবলিত। সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৩০ মেট্রিক টন চাল দেয়া হয়েছে। তবে, প্রথম থেকে বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ হয়ে আসছে। চলছে সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে একাধিক ইভেন্টের মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রম ও উদ্বুদ্ধকরণ লেখালেখি।
এরই ধারাবাহিকতায় একটি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন ’বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ সপ্তাহব্যাপী ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম হাতে নিয়ে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে গেলে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল মান্নান অনুমতি না দিয়ে উল্টো নানান বায়বীয় অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন। বলেছেন, সাজেকের খাদ্যাভাব অবিশ্বাস্য। তাছাড়া ৮ মে, (সোমবার) জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তাই আপাতত ত্রাণ সাহায্য দেয়ার দরকার নেই বলে বক্তব্য শুনিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি হ্লাতুন সেইং এর।
হ্লাতুন অভিযোগ করেছেন, লিখিত আবেদন হাতে নিয়ে সারাদিন ডিসিকে অনুরোধ করেছেন তিনি। কিন্তু অনুমতি দেননি ডিসি।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সপ্তাহব্যাপী ত্রাণ বিতরণ ও চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ত্রাণ নিতে আসা মানুষদেরকে প্রতিদিন একবেলা রান্না করেও খাওয়াবে বলে জানিয়েছিল। হ্লাতুনের অভিযোগ মতে, ডিসি বলেছেন যে, সেখানে রান্না করেতো খাওয়ানোই যাবে না। কারণ খাবার নিয়ে মারামারিও হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন দায় নেবে না।
এ ব্যাপারে জানতে, মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে ডিসি ফাউন্ডেশনের অভিযোগকে অস্বীকার করে বলেন, "একটা খাদ্যাভাব এলাকায় কেউ সাহায্য করতে যাবে, আমি তাদেরকে বাধা দেবো কেন? এটা জেনে তো আমার খুশি হওয়ার কথা"। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেও মন্তব্য করেছেন ডিসি মঞ্জুরুল মান্নান।
তিনি জানান, "শুকনো খাবার বিতরণে প্রশাসনের কোনো বাধা নেই। সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ দেয়া যাবে বলে ফাউন্ডেশনকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ডিসি। তবে, ত্রাণ নিতে আসা লোকজনদের একবেলা রান্না খাবার খাওয়ানোর বিষয়টিকে ’লঙ্গরখানা’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ডিসি জানান, জেলা প্রশাসন এপ্রিল মাস থেকে সাজেকের খাদ্যাভাব নিয়ে দেখভাল করে আসছে। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে ১৮ মেট্রিক টন চাল ও চার লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ত্রাণ দিয়ে আসছে এবং দিচ্ছে। সুতরাং সাজেকে আর কোনো খাদ্যাভাব থাকার কথা না। তারা আরো ত্রাণ দিবেন বলেও আশ্বাস দেন। ডিসি’র প্রদত্ত তথ্যমতে, সাজেক ইউনিয়নে সবাই অভাব কবলিত নয়। অভাব কবলিত পরিবারের সংখ্যা মোট দুই হাজার পরিবার।
উল্লেখ্য যে, গত দুই মাস ধরে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের আড়াই হাজারের অধিক পারিবারের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। ইউএনও বরাবরে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় গত দুই মাস আগে ছয়’শ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও এখনো পর্যাপ্ত সহযোগিতা পায়নি সাজেকবাসী। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে গত ২২ এপ্রিল খাদ্য সংকটের শিকার ১৬ গ্রামের ৪১০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এ সহযোগিতা অত্যন্ত কম মনে করেন উপজেলা চেয়ারম্যান বড়ঋষী চাকমা। পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিতে সকল স্তরের মানুষকে আহবান করেছেন চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশের চলতি সরকারের ঘোষিত অনুযায়ী দেশ এখন নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ। ঘোষণাটি যদি তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িকে বাদ দিয়ে করা হতো তাহলে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারতো না। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলাগুলোও যে বাংলাদেশেরই অংশ, অন্য অনেকের মতো আমারও কিছু প্রশ্ন জাগতেই পারে।
প্রশ্নটা হলো, নিম্ন মধ্য আয়ের দেশের একটি অঞ্চল সাজেকের ৫০টি গ্রামের আদিবাসীদের খাদ্যাভাব কেন? এই খাদ্যাভাব কি এ বছরই প্রথম দেখা দিয়েছে? নাকি আগেও দেখা দিয়েছিল? চলুন, এবার এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজি।
সাজেকে খাদ্যাভাব আজকের নতুন বিষয় নয় বা হঠাৎ করে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে তাও নয়। প্রতি বছর এই মৌসুমে একই সংকট দেখা দিতো সাজেকে। গণমাধ্যমের চোখে না পড়ায় এসব সংকট উপেক্ষিত থেকেছে তাও নয়। এমনকি, ১৯৯৮ সালে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে ২২ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল সেখানে। খাদ্যাভাব মাঝেমাঝে চরম আকার ধারণ করলেও নিরাপদ পানি আর চিকিৎসার সংকট নিত্যনৈমিত্তিক চলছেই। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরও সাজেকে খাদ্য সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমের কল্যাণে এবার বিষয়টি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে মাত্র। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ব্যাপকতা পায়নি দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থাপনা ও স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা।
১৮ বছর আগে থেকে এই সমস্যাসমূহ চিহ্নিত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে টেকসই ও স্থায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টংগ্যা সাজেকের দুর্ভিক্ষের উপর একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করলেও রাষ্ট্রের স্থানীয় দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান স্থায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।
এ ব্যাপারে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা জানান, আপদকালীন মোকাবিলা হিসেবে ইতোমধ্যে জেলা পরিষদ থেকে ১০ মেট্রিক টন চাল পাঠানো হয়েছে এবং জেলা প্রশাসন থেকে ১৫ মেট্রিক টন দেয়া হচ্ছে এ সপ্তাহের মধ্যে।
এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরিষদ থেকে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, "সাজেকের ভৌগলিক সমস্যার কারণে তেমন একটা প্রকল্প হাতে নেয়া কঠিন। সেখানকার ভৌগলিক পরিস্থিতির বিবেচনায় সেখানে একমাত্র ফলজ বাগান সৃজন করা সম্ভব"। তিনি জানান, সাজেকের ২০০ পরিবারের জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলেন গত বছর। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় সুপারিশ না করায় প্রকল্পটি কৃষি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেনি। পার্বত্য মন্ত্রণালয় সুপারিশ করলেই কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়াও সুদমুক্ত ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা আলোচনা করে দেখবেন বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা।
২০০৪ ও ২০১২ সালেও সাজেকের ২২টি গ্রামে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। এ সময় চাউলের কেজি ৮০-১০০টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছিল। (দেখুন, প্রথমআলো, ০১-০৩-২০১২)। ২০১২ সালে সাজেক, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি এবং বান্দরবানের থানচি ও রুমায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। এ সময় ছয় মাসের জন্য সাড়ে ছয় হাজার পরিবারকে একটি প্যাকেজের আওতায় খাদ্য সাহায্য দেয়া হয়। প্রতিমাসে পরিবার প্রতি ৫০ কেজি চাউল, নগদ ১২০০টাকা, তিন লিটার ভোজ্য তেল, অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য ছয় কেজি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য, জুমের বীজ কেনার জন্য পরিবার প্রতি এককালীন দুই হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছিল। (দেখুন, বাংলাট্রিবিউন, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭)।
সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ ধরণের আপদকালীন মোকাবিলায় ত্রাণ বিতরণকে ’এন্টি ড্যানড্রাফ্ট শ্যাম্পু’ ব্যবহার করার মতো বলে মন্তব্য করেছেন, লেখক ও গবেষক অরুনেন্দু ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ’শ্যাম্পু ব্যবহার করে খুশকি দূর হয় না, যতক্ষণ শ্যাম্পু ব্যবহার করা হবে ততক্ষণ খুশকি অনুপস্থিত থাকবে। এ কারণে বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপনে ’রিমোভ ড্যানড্রাফ্ট’ শব্দ ব্যবহার না করে ’এন্টি ড্যানড্রাফ্ট’ শব্দ ব্যবহার করেছে। তেমনি ১০ কেজি চাল ত্রাণ দিলে হয়তো ’এন্টি ক্ষুধা’ করা সম্ভব হবে কিন্তু ’রিমোভ ক্ষুধা’ করা সম্ভব হবে না। আমাদেরকে ক্ষুধা রিমোভ করার কৌশল বের করতে হবে’।
সাজেকে খাদ্যাভাব তখনই দেখা দেয়, যখন প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিতো। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণে জুমের ফসল হানির ঘটনা ঘটতো সাজেকবাসীর খাদ্যাভাব চরম আকারে রূপ নিতো। কিন্তু এবারের খাদ্যাভাব অন্য কারণে হয়েছে বলে জানা গেছে। পছন্দমত পাহাড়ে জুম করতে না পারায় জুমে কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন হয়নি গত মৌসুমে। জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সাজেকে জুমচাষে বাধা দিয়ে আসছে। তাদের নিষেধাজ্ঞা না শুনলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ও জরিমানা করা হতো। তাই বাঁচার তাগিদে সাজেকবাসী এক বছরের পতিত পাহাড়ে জুম চাষ করতে হচ্ছে। এ কারণেই জুমে লক্ষ্যমাত্রা ফসল পাচ্ছে না তারা।
অরুনেন্দু ত্রিপুরা’র মতে, সাজেকের বহুমুখী সমস্যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো, ’মহাজনী কারবার’। এই মহাজনী কারবারের কারণে সেখানকার গরীবরা অতিমাত্রায় শোষিত হচ্ছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, গরীব জুমিয়ারা জুমচাষের জন্য প্রতি বছর গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে সুদের উপর ধান ধার নিয়ে থাকে। জুমচাষের শুরুতে ৪০ আঢ়ী (এক আঢ়ী= ১৬সের/১০ কেজি) ধান নিলে জুমের ফসল উত্তোলনের পর মহাজনকে ৮০ আঢ়ী ধান ফেরত দিতে হয়। দেখা গেল যে, জুম থেকে ধান পাওয়া গেল মোটে ১০০ আঢ়ী, সেখান থেকে মহাজনকে ৮০ আঢ়ী দিলে বাকী ২০ আঢ়ী ধান দিয়ে দুই-তিন মাস চলল। তারপর আবার মহাজনের কাছ থেকে সুদের উপর ধারে ধান নিয়ে বাকী সময়টা পার করাতে হয়। এভাবে দারিদ্র্যের চক্রটা ঘুরতে থাকে এবং এক পর্যায়ে যদি হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যে কোনো কারণে জুমের ফসল নষ্ট হলে ঋণের বোঝাটা ভারি হতে থাকে এবং না খেয়ে থাকতে হয়।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের আপাতত উপায় হিসেবে অরুনেন্দু ত্রিপুরা মনে করেন, জুমিয়াদেরকে সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। কেবল সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে না থেকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এ উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।
ইতিহাস থেকে দেখা যায় এর আগে সাজেকে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে! ১৯৯৮ সালের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে এমন দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটেছিল সেখানে। রাঙামাটিস্থ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা টংগ্যা’র অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯৯৮ সালের ২৭ মে থেকে ২রা জুন পর্যন্ত সাজেকের ছয়টি গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে টংগ্যা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। এ প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী ১৯৯৮ সালে সাজেক ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩৩টি গ্রামে ১,৮২৬ পরিবারে ১২,০৬৬জন ছিল। এখানকার বসবাসরত জনগোষ্ঠী ত্রিপুরা, পাংখো ও চাকমা সম্প্রদায়ের। খাদ্যাভাবে সাজেকের মানুষ কলাগাছ, জঙ্গলী আলু, শাকসবজি খেয়ে জীবন ধারণ করতে গিয়ে এবং নিরাপদ পানির অভাবে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়সহ নানান রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসা না পেয়ে ২২জনের মৃত্যুর কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আলো’র নির্বাহী পরিচালক অরুন কান্তি চাকমা বলেন, সাময়িক কোন রেশনিং দিয়ে এই সমস্যার সমাধান মিলবে না। কারণ বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাসরত প্রান্তিক মানুষদের জীবন-সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল ছাড়া রাতারাতি কোন পরিবর্তন কল্পনা করা যাবে না। এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে এলাকার মানুষদের স্থায়িত্বশীল ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।
এ ব্যাপারে, লেখক, গবেষক ও জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, "সেখানকার আদিবাসী জুমিয়াদের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত না করলে এভাবে আপদকালীন ১০ কেজি চাল দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়"।
প্রথাগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভূমি ব্যবহার ও স্থানীয় বনজ সম্পদ আহরণ করার অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে পারলে সাজেকে এরকম বারবার খাদ্য সংকট থেকে উত্তরণ পেলেও পেতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
১৬৯নং শিয়ালদাই মৌজার হেডম্যান জৌপিথাং ত্রিপুরা জানিয়েছেন, সাজেকের সবচেয়ে ক্ষুধাপীড়িত এলাকা হলো ১৬৯নং শিয়ালদাই মৌজা ও ১৭০নং তুইচুই মৌজার গ্রামগুলো। পর্যটন এলাকা রুইলুই থেকে এসব এলাকায় পায়ে হেঁটে পৌঁছতে সময় লাগে কমপক্ষে তিন-চারদিন।
১৬৯নং শিয়ালদাই মৌজার গ্রামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, তারুমপাড়া(চাকমা), খগ্রাতিচিং পাড়া, শিয়ালদাই, হালাপাড়া, পাড়াকাতাল, লংতেনপাড়া, কমলাপুর, গ-াছড়া। এবং ১৭০নং তুইচুই মৌজার গ্রামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, লুইপাড়া, কাইচাপাড়া, তারুমপাড়া(ত্রিপুরা), থাংনাংপাড়া, নিউ থাংনাংপাড়া, নাবাক (ভলান্টিয়ার বাসা পাড়া), পুরাতন জৌপৈ, নতুন জৌপৈ, উদোলছড়ি, বলপাইয়াপাড়া। এই দুই মৌজায় কমপক্ষে দেড় হাজার পরিবার রয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে এক হাজারের বেশি পরিবার খাদ্যাভাবে ভোগছে।
এছাড়াও আরো রয়েছে, ১নং মুন্দ্রিছড়া, ২নং মুন্দ্রিছড়া, ২নং চাইলাতলী(ত্রিপুরা), ১নং চাইলাতলী(চাকমা), বেতবুনিয়া(ত্রিপুরা), ১নং উজানছড়ি, ২নং কচুতলী, শিলছড়ি(ত্রিপুরা), পূর্ব ভুয়াছড়ি, পশ্চিম ভুয়াছড়ি, মিতেঙ্গাছড়ি, হাজাছড়া, তিতাগুলাছড়া। এসব গ্রামেও চলছে একই সমস্যা।
হেডম্যান যৌপিথাং ত্রিপুরা ও সাজেক ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য দহিন ত্রিপুরার সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলা পরিষদের মাধ্যমে পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে মোট ১৫ মেট্রিক টন চাউল পাঠানো হয়েছে। এ চাউলগুলো সর্বোচ্চ পরিবার প্রতি ১০ কেজি করে বিতরণ করা সম্ভব হবে। এগুলো দিয়ে সমস্যার তেমন একটা সমাধান হবে না বলে মনে করেন হেডম্যান। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকেও খাদ্যশস্য আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। আপদকালীন মোকাবিলা করে সাময়িক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও এটা কোনো সমাধান নয় বলে মনে করেন তারা।
আরো কিছু নেপথ্য কাহিনী:
বাংলাদেশের রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি প্রান্তিক ইউনিয়নের নাম ’সাজেক’। যার আয়তন ৬০৭ বর্গমাইল। রাঙামাটির ছাদ খ্যাত এ ইউনিয়নের পূর্বে ভারতের মিজোরাম ও উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা। সীমানা সংলগ্ন গ্রামগুলো বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে ১৫০-২০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এ ইউনিয়নে বাস করেন, ত্রিপুরা, চাকমা ও পাংখো জনগোষ্ঠী। আর এসব গ্রামের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম পায়েহাঁটা পথ। এসব এলাকায় পৌঁছতে সময় লাগে কমপক্ষে তিনদিন। এই এলাকার একমাত্র জীবিকার মাধ্যম হলো জুমচাষ। বিশেষ করে ত্রিপুরা ও চাকমারা জুমের উপর নির্ভরশীল। জুমে উৎপাদিত ধান, সবজি (কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, মারফা ইত্যাদি) খুব বেশি বাজারে বিক্রি করতেন না সাজেকের আদিবাসীরা। সারা বছরের জন্য সংক্ষরণ করে বাড়তিটুকুই কেবল বাজারে বিক্রি করতেন। জ্বালানী তেল, ভোজ্য তেল, লবণ ব্যতীত বাজার থেকে খুব একটা দ্রব্যও সদাই করতেন না তাঁরা। চাউল আর সবজিতো কিনতেনই না। জুমে ভাল ফসল উৎপাদন হলে খাদ্যের জন্য তেমন চিন্তা করতেন না সাজেকবাসী। যদি ঠিকঠাক জুমচাষ করতে পারতেন তাহলে এখনো সাজেককে পুরোপুরি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। কিন্তু সমস্যা হলো ঠিকঠাক জুমচাষ করতে না পারা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ কয়েক বছর ধরে জুমচাষে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জুমিয়া মন্তব্য করেন, রাজনীতি ফায়দা লোটানোর ক্ষেত্রে নিজেদেরকে জুম্ম জাতি বলে দাবি করে তারা অথচ আমাদের একমাত্র জীবিকার মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রখেছে তারা। এ কারণেইতো সাজেকের আজকের এই অবস্থা।
লেখক: আদিবাসী সংগঠক ও অধিকার কর্মী