বলতে মানা-৮ (শেষ পর্ব)
প্রকাশ | ০৭ মে ২০১৭, ০০:৫৯ | আপডেট: ০৭ মে ২০১৭, ০১:০৮
আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য।
আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।
বিঃ দ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান।
সময় ২০১৭
আজ বৃহস্পতিবার, বিকাল পাঁচটা বাজে, সাদিয়া অস্থির হয়ে অফিসের বারান্দা দিয়ে হাঁটতে থাকে। সবাই তো বাসায় ফিরে যাবে, সে কি করবে! একজন নতুন আপা এসেছেন, তার অফিসে ঢুঁ মারে সে। ‘বের হবেন এখন?’ আপা বলেন, ‘এই তো একটু পরেই, বসুন না'। কিছুক্ষণ এলোমেলো কথার পর সাদিয়া বলেন, ‘আপনার এইচএসসি কবে?’ নতুন আপা অবাক হয়ে বলেন, ‘জ্বী?’ বুঝে উঠে না পিএইচডি করে আসার পরে কেউ তার এইচএসসি নিয়ে প্রশ্ন করবে কেন? সাদিয়া একটু দমেও যায়। তবু কথা চালিয়ে যায়। ‘আমার ৯৬ সাল এ’। এবার নতুন আপা বুঝতে পারেন সাদিয়া বোঝার চেষ্টা করছেন তার বয়স কত। হেসে বলেন, ‘আমার ৯৮ সাল এ’। সাদিয়ার সহজ প্রশ্ন, ‘আপনার ছেলেমেয়ে আছে?’ নতুন আপা হেসে বলেন, ‘না, আমি সিংগেল’।
‘বিয়ে করেন নি কেন?’
‘করেছিলাম, ডিভোর্স হয়ে গেছে, হি ওয়াস এবিউসিভ’।
সাদিয়া চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ।
‘আমার এটা দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম স্বামী বিয়ের চৌদ্দ বছর পরে অন্য মেয়েকে ভালবেসে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছেন। আমার এক ছেলে এক মেয়ে, ডিভোর্সের সময় আমার মেয়ের বয়স তের আর ছেলের বয়স সাত বছর ছিল'।
‘আপনার তাহলে অনেক অল্প বয়েসে বিয়ে হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, কলেজে পড়ার সময় বিয়ে হল। বিয়ের পরেই মেডিকেলে পড়লাম, ছেলেমেয়ে হল, তাদের নিয়েই সব ডিগ্রি কমপ্লিট করলাম'।
‘ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই আপনার সাথেই থাকে’
প্রশ্নটা করে একটু বিব্রত হলেন নতুন আপা, এত ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি। ‘আমি সরি, এ প্রশ্ন করা ঠিক হয় নাই'।
সাদিয়ার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে শুরু করল। নতুন আপা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বিব্রত মুখে বসে রইলেন।
‘আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না’।
সাদিয়া নিজের মনেই বলে চললেন, ‘আমার ছেলে মেয়েকে আমি দেখি না পাঁচ বছর হয়ে গেছে। দাদী আর বাবা তাদের বলেছে মা খারাপ, মা চলে গেছে। আমি প্রায় ফোন করি, এই আশায় যদি কোনদিন মেয়ে বা ছেলে ধরে একটু হয়তো কথা বলতে পারব। কোনদিন ছেলে মেয়েরা ফোন ধরে না। আমার প্রাক্তন স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর তার মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন ছেলেমেয়েদের দেখতে চাইলে ফিরে যেতে পারি, তারা আমাকে মেনে নিবেন, আমার স্বামী আমাকে আবার বিয়ে করবেন। নাজমুলকে আমি বিয়ে করেছি তখন এক বছর হয়েছে। তার মা আমাকে বললেন, ছেলে মেয়েকে যদি ভালবেসে থাকি নাজমুলকে ছেড়ে চলে যাওয়া কঠিন কেন হবে? নাজমুল আমাকে মৃতাবস্থা থেকে প্রাণ দিয়েছে। আমি আমার ছেলেমেয়ে হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। রাস্তায় চলে যেতাম ঘুমানোর জামা পড়ে। সিএনজি ডেকে মেডিকেল কলেজে চলে যেতাম, ক্লাসে গিয়ে বসতাম, ভুলে যেতাম আমি পাস করে গেছি অনেক আগেই। বাসার দারোয়ান আমাকে বাসায় ফিরিয়ে আনতো। এগুলো লোকের মুখে শোনা, আমি সজ্ঞানে কিছু করি নাই, আমার এসব মনে নাই। নাজমুল আমাকে সেই পাগল অবস্থা থেকে যত্ন করে সুস্থ করেছে, আমি আবার পড়ালেখা শুরু করেছি, মাস্টার্স করেছি, চাকরি করছি'।
‘আপনি মামলা করেননি কেন? আপনার ছেলে মেয়ে আপানাকে দেখতে দিবে না এ তো অন্যায়’।
‘আমি মামলা করব ঠিক করেছি, কিন্তু ছেলেমেয়েরা তো আমাকে ভালবাসে না। তাদেরকে বলা হয়েছে মা নাজমুল মামাকে ছেড়ে ফিরে আসেনি। আমি ওদের সাথে দেখা করতে চাই, সত্যি জানাতে চাই। মামলা তো আমাকে ছেলেমেয়ের ভালবাসা এনে দিতে পারবে না’।
সাদিয়া চুপচাপ কেঁদেই চললেন।
লেখক: গবেষক