সাইবার হয়রানিকে না বলুন

প্রকাশ | ১০ এপ্রিল ২০১৭, ০১:২৫ | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৭, ২৩:৩৩

(১) তথ্য প্রযুক্তি আইন বাংলাদেশে নতুন। প্রচলিত অন্যান্য ফৌজদারী আইনের চেয়ে অনেক বেশী সংবেদনশীল, গুরুত্বপূর্ণ এবং বিচারিক জটিলতামুক্ত এই আইনে মামলা প্রমাণের জন্য বাদীর তেমন হ্যাপা নেই। রাষ্ট্র পক্ষ বাদীর পক্ষে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব পালন করেন। তাই মামলা রেকর্ড করার আগেই পর্যাপ্ত আলামত ও প্রমাণ সংগ্রহ করা হয় বলে পরবর্তিতে বাদীর পক্ষ থেকে মামলা আপোষ মিমাংসার সুযোগ নেই। এবং ঠিক এই কারনেই পুলিশ এই আইনে মামলা নিতে চান না। তবে আপনি যদি ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে পারেন এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে পুলিশকে কনভিন্স করতে পারেন, তাহলে অপরাধীর খবর হয়ে যায়।

(২) এবার আসি এজাহার প্রসঙ্গে। জেনে রাখা ভালো, এই মামলার এজাহার অন্য যে কোন এজাহারের চাইতে আলাদা। শুধুমাত্র এজাহারের ভিত্তিতে এই মামলার কনভিকশন করা যায়। সুতরাং খুব স্পেসিফিক এভিডেনশিয়াল এজাহার লেখা তথ্যপ্রযুক্তি মামলার প্রথম শর্ত। আমার অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনজীবিই গতানুগতিক আইনিজীবির ভাষায় এই মামলার এজাহার লিখেন যা এখানে কোন কাজে আসে না, বরং মামলা দুর্বল করে দেয়। তাই এই মামলার এজাহার লেখার জন্য একজন সাইবার ক্রাইম স্পেশালিস্ট এর সাহায্য নিলেই খুব সুন্দর স্পেসিফিক এজাহার লেখা যায়। এজাহারের সাথে অবশ্যই প্রমাণ হিসেবে URL এবং IP লিংক সহ স্ক্রীণশট নিতে হবে। মনে রাখবেন, আমরা মোবাইলে যে স্ক্রিনশট নিয়ে রাখি তা এই মামলায় গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ডেক্সটপ বা ল্যাপ্টপ থেকে পুরো স্ক্রিনসহ শট নিতে হবে, যেখানে তথ্যদাতার আইডি বোঝা যাবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, খুব সম্প্রতি তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলার বাদী হিসেবে আমি নিজে একটি এজাহার লিখেছি। জেনেছি, ইতিমধ্যে সেটি পুলিশ বিভাগের একটি প্রশিক্ষণে মডেল এজাহার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমার সামনেই বেশ ক'জন উচ্চ পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, আমার এজাহারটি খুব ভালো হয়েছে এবং এজাহারটির স্পেসিফিকেশনের জন্যই নাকি মামলাটি রেকর্ড না করে উপায় ছিলো না। CRAF-কে এই টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ দিতেই হবে।

(৩) এর পরের সমস্যাটি হলো, এই আইনের প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশিক্ষণের অভাব এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা। এই আইনে ভিক্টিম সুরক্ষার চমৎকার বিধি বিধান থাকলেও মামলা অ-প্রমাণের জন্য কিংবা আসামীকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য যে ধরণের যুক্তি তর্ক প্রমাণ উপস্থাপন করতে হয় সেই এক্সপার্ট আইনজীবিও খুব কম। বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যরা এই আইন ও এর প্রয়োগ সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ পায়নি। তাই মামলা তদন্ত করা এবং আসামী গ্রেফতার করার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ অনেক সময় এমন আচরণ করেন যে, মনে হতে পারে কোন সঙ্গীতশিল্পীকে সয়েল টেস্ট করতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই কেউ বলেন, "আরে, মার্ডার করে কতো লোক পার পেয়ে যায়, আর এ তো সামান্য তথ্য প্রযুক্তি মামলা"... আবার কেউ বলেন, "আসামী ধরতে না পারলে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই মামলা নিষ্পত্তি করে দিতে পারবেন"- তখন হতাশ হবেন না। কারণ, একটু পরেই আপনি বুঝতে পারবেন, উনারা আসলে মাটি গবেষণা করছেন।

(৪) এখানে জেনে রাখা ভালো, মার্ডার কেস এর সাথে এই মামলার মূল পার্থক্য এখানেই যে, মার্ডার কেস এর আসামী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রচুর সময় ও সুযোগ পায়, যা এখানে খুব কম। কারণ এই মামলাটি রেকর্ড হওয়ার আগেই সাইবার সিকিউরিটি বিভাগ এজাহার সংস্লিষ্ট আইডি লিংক ও পোস্ট নিরীক্ষণ-পরীক্ষণ করেই অ্যাপ্রুভাল দেন। যার কারনে এই মামলা নথিভুক্ত করার আগে একটু সময় দরকার হতে পারে। যারা মনে করেন আসামী ধরে তার ডিভাইস জব্দ না করলে মামলা প্রমাণ করা যাবেনা তারাও ঠিক একই রকম ভুল তথ্য দেন। কারণ, আদালত মনে করলে সংশ্লিষ্ট আইডির আইপি লিঙ্ক অন্য অনেক বিকল্প উপায়ে বের করার আদেশ দিতে পারেন।

জনসচেতনতার জন্য এই পোস্ট লেখা। যা লিখেছি, এ পর্যন্ত নিজের অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনা থেকে লিখেছি। কোন তথ্যগত ভুল থাকলে শুধরে দেওয়ার অনুরোধ থাকলো। উদ্দেশ্য একটাই তথ্য প্রযুক্তি আইন নিয়ে সাধারন মানুষের ভীতি দূর করা। মনে রাখবেন, অপরাধ সহ্য করা কিন্তু অপরাধ করার প্রবণতা বাড়ায়। তাই যে কোন ধরনের সাইবার হয়রানির শিকার হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করুন। আশা করি, সাইবার অপরাধ ও হয়রানি বন্ধে এই আইনের প্রয়োগ বাড়বে, পুলিশের দক্ষতা বাড়বে, এবং তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক আইনজীবির সংখ্যা বাড়বে।

দিন শেষে যারা জেনে বা না জেনে, দোষ করে বা না করে এই মামলায় জড়িয়েছেন, তাদের জন্য দুই মিনিটের অগ্রিম সমবেদনা। কারণ, যদি সৌভাগ্যক্রমে আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতেও পারেন, তার আগেই কিন্তু আপনার জীবন 'গেবন' হয়ে যাবে। তাই করজোড়ে অনুরোধ, টাইমলাইন আপনার হলেই তা অন্যকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। প্লিজ।

 

সাদিয়া নাসরিন এর ফেসবুক থেকে