বাসের 'মহিলা সিট' ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা
প্রকাশ | ০৬ এপ্রিল ২০১৭, ০১:২১ | আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:০৬
বাংলাদেশে আইন করে বলা হয়েছে, বাসে মহিলা যাত্রীদের আসনে পুরুষ বসলে জেল জরিমানা হবে। খবরটা দেখে প্রাথমিকভাবে বেশ ভালো লেগেছে, মনে হয়েছে এটাতো বিরাট অগ্রগতি আর বলে বেড়ানোর বিষয়। আইনটি যারা করেছেন তারাও নিশ্চয় আত্মতৃপ্তিতে ভাবছেন, বাংলার অবলা নারীদের জন্য একটা ভালো কাজ করা গেছে।
আমার কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তায় আসলো, সারা বিশ্বময় পাবলিক বাসে বা ট্রেনে কেবল বয়স্ক মানুষ, প্রতিবন্ধী আর অসুস্থ মানুষের জন্য আলাদা বসার জায়গা থাকে চিহ্নিত করা, এবং এইরকম কেউ বাসে দেখলেই অন্যরা যদি সেই সিটে বসা থাকেন তবে উঠে জায়গা করে দেন।
এটা না করলে কেউ কি শাস্তির সম্মুখীন হবেন ?
উত্তরটি আমার জানা নেই, কারণ এইরকম পরিস্তিতির মোকাবেলা করা বা দেখার সুযোগ হয়নি আমার কখনো।
একজন নারীতো কেবল নারীত্বের জন্য প্রতিবন্ধী বা অসুস্থ নন। তাছাড়া বাংলাদেশে বাসে বা ট্রেনের কামরায় একজন দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে পুরুষরা তো উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জায়গাতে বসতে বলতো একসময়। তাহলে নারীর জন্য বাসে বা ট্রেনে আলাদা বসার জায়গা আর সেখানে পুরুষ বসলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে আইন করার প্রয়োজন পড়লো কেন?
প্রশ্নটি এখানে রেখেই কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি;
আশির দশকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে বানদুং যাচ্ছিলাম, পথে রাস্তা হারিয়ে আমার ট্যাক্সিচালক রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজন কৃষিজীবী মহিলাকে 'বাহাসা ইন্দোনেশী'তে 'সালামত দেটাং' বলে কিছু একটা কথাবার্তা বলে সঠিক রাস্তা জেনে নিল। আমি আশ্চর্য হয়ে একটা শব্দ খেয়াল করলাম যে, আমার চালক ওই মহিলাকে বেশ কয়েকবার 'বু' বলে সম্মোধন করছে! আমি পরে ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞেস করলাম, 'বু' শব্দের অর্থ কি বোন? আর সেটা যদি ঠিক হয় তবে মহিলা কি তোমার বোন?
ট্যাক্সিচালক হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়ে আমাকে বললো, মহিলা ওর বোন না, সে উনাকে চেনেও না তবে এটা তার দেশের সংস্কৃতি। একজন অপরিচিত মহিলা পুরুষের কাছে সবসময়ই বোনের মর্যাদার দাবিদার।
আমি খুব খুশি হয়ে ট্যাক্সিচালককে বলেছিলাম, তোমাদের সংস্কৃতির সাথে আমাদের বাংলাদেশের দারুণ মিল আছে! আমাদের কাছেও একজন অপরিচিত মহিলা বোনের মর্যাদা পায়। যেমন আমার দেশে আমিও সালাম করে এই যে বোন, এদিকে একটু শুনেন বলে কিছু জিজ্ঞেস করতাম।
২০১৭ সালের বাংলাদেশে এই আইন, ইন্দোনেশিয়াতে আমার অভিজ্ঞতা আর আমাদের সংস্কৃতির নারী পুরুষের স্বাভাবিক মর্যাদার সম্পর্কের প্রাসঙ্গিকতা নিজে বুঝতে আর বুঝিয়ে লিখতে আমারই বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সম্ভবতঃ বাসে বা ট্রেনে উঠে পড়া একজন নারী আর আমার বোনের মর্যাদা পায় না এখন। উনার জন্য আমার নিজের আসন ছেড়ে দেই না আমরা। মহিলার জন্য নির্দিষ্ট আসনেও আমরা বসে পড়ি আর সুযোগ পেলেই বোনের গায়েও হাত দেই। তাই হয়তোবা প্রয়োজন পড়েছে এই আইন প্রণয়নের।
আরেকটি অপ্রাসঙ্গিক কথা না বললেই নয়;
দেশের বাড়ি সিলেট গেলে আমি প্রায়ই মেঘালয়ের রাজধানী শিলং যাই। একসময়ের আমাদের আসামের রাজধানী, পূর্বপুরুষের এই নিবিড় সম্পর্কের শহর, শিলংয়ে আমার খাসিয়া আত্মীয়-স্বজন, আমার বন্ধুবান্ধব আর আমার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির সিলেট শহরের প্রতিচ্ছবি দেখতেই শিলংয়ের প্রতি আমার এই আকর্ষণ। শিলংয়ে রিজার্ভ না করে ট্যাক্সিতে উঠলেই রাস্তায় বিভিন্ন লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন বয়েসের মেয়েছেলেরা উঠে বসে। এমনকি সেটা রাত দশটার পরও। মেয়েমানুষ দেখে আমি একটু কাচুমাচু করে সরে বসলে ওরা মনে করে তাহলে তো আরেক জনের জায়গা হবে! তখন ছোট ট্যাক্সির পেছনের তিন সিটের জায়গাতে চার বা পাঁচজন অপরিচিত লোকের গাদাগাদি করে বসা!
এটা কেবল সংখ্যাদিখ্যে খাসিয়া মেয়েরাই করে না, শিলংয়ের বাসিন্দা বাঙালি হিন্দু, বাঙালি বা অন্য জাতের মুসলিম সহ সকল মেয়ে-মহিলারাই করেন।
আমি একবার আমার খাসিয়া আত্মীয়দের জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাত বিরেতে মহিলাদের এভাবে অবাধ চলাফেরা নিয়ে তোমাদের কোন সামাজিক সমস্যা কি নেই? বিশ্বাস করেন, ওরা আমার দিকে এমন করে তাকিয়েছিলো যে আমার মনে হচ্ছিলো, ওরা অন্য কোন গ্রহের লোক দেখছে! আমি তো অন্য কোন গ্রহের লোক না! শিলং থেকে মাত্র ৮৫ কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশের সিলেটের লোক। আমার খাসিয়া আত্মীয়দের কয়েকজন জার্মানিতে আমার আমন্ত্রণে এসে ঘুরে গেছে। ওদের আর আমার বন্ধুদের আমি প্রায়ই বলি, আগামী বার আমি বাংলাদেশে আসলে তোমরা সিলেট বেড়াতে আসো। ওরা আনন্দিত হয়ে হেসে বলে, অবশ্যই আসবো, সিলেটতো আর দূর না মাত্র ৮৫ কিলোমিটার, চেরাপুঞ্জি থেকে নিচের দিকে তাকালেইতো সিলেট আর তোমাদের বাংলাদেশ। আমি উত্তরে মৌনতা অবলম্বন করে কেবল মনেমনেই বলি, সিলেট আর বাংলাদেশ মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের আমার আত্মীয়দের থেকে কাছে নয়, যোজন যোজন দূরে। তবে এটা ঠিক, তোমাদের থেকে নিচের দিকে তাকালেই সিলেট আর আমার বাংলাদেশ।
আইন করে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এতোসব নেতিবাচক অপ্রাসঙ্গিক কথার পর আসুন আমার খাসিয়া আত্মীয়দের নিয়ে এক মজার কথা বলি।
খাসিয়া ছেলেরা বিয়ের পর কান্নাকাটি করে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বউয়ের ঘর করতে যায়।
সাকি চৌধুরী'র ফেসবুক থেকে