বলতে মানা -১
প্রকাশ | ০৫ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৪২
আমার পরিবার এবং বন্ধুদের জীবনের ঘটে যাওয়া টুকরো ঘটনা নিয়েই এই লেখা। এ লেখার পেছনের কারণ অনেক গভীর। আমি বাঙালি ‘ভাল মেয়ে’ বিশেষণের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি বহু বছর আগে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জীবনের ছোট ছোট ঘটনা যা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং বারবার ভেবেছি তার কিছু অংশ এই লেখার ছোট ছোট টুকরো। কারো জীবন নয় এই সমাজ এর অনমনীয়তা তুলে ধরাই আমার লেখার উদ্দেশ্য।
আশা করি না এই লেখা পড়ে রাতারাতি সভ্য জাতিতে পরিণত হবো আমরা। তবু একজন নারীর জীবনভাবনাও যদি এই লেখার কারণে পরিবর্তন হয় তাতেও তো এ সমাজ একজন সুখি নারী পাবে। এই গল্পের সব চরিত্র এখনো বেঁচে আছেন এবং আমার বেড়ে ওঠার সময়ে এদের সান্নিধ্যে আসার কারণেই আমার জীবনধারা ব্যতিক্রম হয়েছে। যে জীবন আমার নিঃশ্বাস আটকে রাখে সে জীবন থেকে আমি নিজেকে মুক্ত করে নেই, ক্ষতি নেই যদি তা হয় স্রোতের বিপরীত।
বিঃদ্রঃ এই গল্পের চরিত্র যদি আপনার চেনা মানুষও হন আমি অনুরোধ করবো চরিত্রকে সমালোচনার বাইরে রাখুন, তার অভিজ্ঞতা এবং এর সমাধান এর ব্যাপারে অভিমত জানান।
সময় ১৯৮০
দুপুরের কাঠফাটা রোদে পাহাড়ি পথে হাঁটতে নাসির সাহেবের একটু কষ্টই হয়ে যাচ্ছে। তার পেছনে কালো বোরখা আর নেকাব পরা মহিলার না জানি আরো কত কষ্ট হচ্ছে। এমন ভর দুপুরে অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে একা তো বের হবার কথা নয়, নাসির সাহেব একটু চিন্তিত হলেন। যদিও তার মাথায় অন্য এক দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আয়েশাকে ভাইসাহেব বিয়ে দিবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও নাসির সাহেব ঠিক ভরসা করতে পারছেন না। সিলেট থেকে পড়িমরি করে চট্টগ্রাম এসেছেন আয়েশার চিঠি পেয়ে। এই বছর ম্যাট্রিক পাশ করল মেয়েটা, প্রথম হয়েছে বরাবরই। ডাক্তার হবার ইচ্ছা তার। সম্পর্কে খালু হলেও নাসির সাহেবকে বাবার মত মানে আয়েশা। কথা নেই বার্তা নেই এক মাঝবয়সি লোককে বাসায় নিয়ে এসেছেন বাবা, এই লোকের সাথে আয়েশার বিয়ে দিবেন তিনি! অনেক কান্না করেও যখন বাবাকে মানানো গেল না, সে খালুকে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি লেখে, খালু পড়ালেখা জানা মানুষ, বাবা তার কথা ফেলবেন না।
আয়েশার মায়ের বিয়ে হয়েছে ষোল বছর বয়সে, বারো বছর বয়সে নানা মায়ের পড়ালেখা বন্ধ করে দেন। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন মা, পরম সুন্দরী বলে নানা মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখলেন, পর্দা রক্ষা হবে। নানা গোড়া মুসলমান, জমিদার বাড়ির মেয়ে, তার পর্দা রক্ষা শিক্ষার চেয়ে জরুরি। নানা নিজে বিদ্বান মানুষ, শেক্সপিয়র পড়েছেন কিন্তু ধর্ম আর পর্দা তার কাছে অনেক মুল্যবান। মায়ের বিয়ে হয়ে গেল, বছর গড়াতেই আয়েশা এলো। পরের বছর খাদিজা, পরের বছর আহমদ, পরের বছর মোহাম্মদ, এই করে করে সতের বছরে পাঁচ মেয়ে তিন ছেলে। আয়েশার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় হলো কনিষ্ঠ পুত্র খায়রুল্লাহ। পড়ালেখা করতে না পারার শোক মা কোনদিন ভুলতে পারেননি।
বাবাও নানার মত ধার্মিক মানুষ, প্রচলিত রীতি মেনেই সংসার করেছেন। রাত বিরেতে মেহমান নিয়ে আসা তার অভ্যাস। মাঝরাতে শেয়ালের ডাকে মা চমকে উঠতেন রান্নাঘরে। ভয়, ক্লান্তি, সংসারের চাপ সামলাতে গিয়ে অনেকবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন তিনি, এর মাঝেই সন্তান আসছে। মা যখন পুরোপুরি পাগল হয়ে যান তখন নানা আর বাবা ভয়ে পালিয়ে থাকেন। মায়ের সামনে পড়লে মা বলেন, শেয়াল এসেছে আমার সব মুরগি খেয়ে ফেলবে, আর দা হাতে দৌড়ান। আয়েশা আর খাদিজা সংসার, ছোট ভাইবোন, সব দেখাশোনা করে। তার মাঝেই পড়ালেখা করে দুই বোন, তারাও মায়ের মত পরমা সুন্দরী, পর্দা তাদের জন্য জরুরি। বাবা যখন বিয়ে ঠিক করে বসে আছেন আয়েশা চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করল। সতের বছর পরে এসে মায়ের জীবনের মতই নির্ধারিত হচ্ছে তার জীবন!
নাসির সাহেব বাসে উঠে পড়েছেন এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সেই কালো বোরখা পড়া মহিলা তার পাশের সিটে বসে পড়েছেন। এই গ্রামের কোন মহিলা দূর পাল্লার বাসে অপরিচিত পুরুষের পাশে বসেন না! নাসির সাহেব জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, “আপনার সাথে কে আছেন? কোথায় যাবেন? আমার পাশে কেন বসলেন?” সেই কাল বোরখা অঝরে কাঁদতে শুরু করলেন, “খালু আপনার পায়ে ধরি, আমাকে সিলেট নিয়ে যান। বাবা আমাকে এইবার বিয়ে না দিলেও সামনের বার ঠিকই জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি আপনাকে আর চিঠি লিখার সুযোগ পাব না। আপনি আমার জীবন বাঁচান”। নাসির সাহেব ভড়কে গেলেন! আয়েশা করেছে কি! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে! তিনি যতই বোঝান আয়েশা কিছুতেই কান্না থামায় না। সে বাড়ি ফিরবে না, সিলেট যাবে, কলেজে পড়বে। উপায় না দেখে নাসির সাহেব নিয়ে গেলেন তাকে সিলেট। ভাইসাহেবকে বিষদ লিখে চিঠি পাঠালেন, আয়েশাকে কলেজে পড়াবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুমাস পরে তার বাবা মেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন।
না, এই গল্পের শেষে সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করে না। আয়েশার মা অনেক বছর মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। আয়েশার বাবা তাকে কলেজে পড়াননি, বাড়ি এনেই এক মাঝবয়েসি এতিম ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন এবং খাদিজা যে কিনা ক্লাস নাইনে পড়ে তাকেও বিয়ে দিয়েছেন। দুইবোনের কারোই পড়ালেখা করা হয়নি। আয়েশা দুই সন্তানকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন কিন্তু খাদিজা খুব দরিদ্রাবস্থা এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে মায়ের দেখাশোনা করেছে। তার প্রথম স্বামীর হাতে নিয়মিত প্রহার জুটতো বলে মামারা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল এবং বাবা তাকে এরপর আরো বয়স্ক একজন লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে কন্যা দায়মুক্ত হয়েছেন।
নিজের জীবনে মায়ের মত দুর্ভাগ্য জুটলেও আয়েশা এবং খাদিজা তাদের ছোট তিনবোনের পড়ালেখা শেষ করতে সাহায্য করেছেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন তারা সবাই তবে দুর্ভাগ্য তারা স্বামী সেবা এবং সন্তান পালনের গতানুগতিক ধারা থেকে বের হতে পারেননি। হয়তো পড়ালেখা শেষ করতে পারাটাই তাদের সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন!
(চলবে...)
লেখক: গবেষক