কোন এক গ্রীষ্মে আমরা ঠিক দ্বিগুণ হবো!
প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০১৭, ০১:১০ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৭, ২০:১১
প্রিয় নাম না জানা মেয়েটি,
তোমাকেই বলছি। হয়তো তুমি আমার সমবয়সী। হয়তো বা আমাদের বয়সের ব্যবধান বিস্তর। তোমার আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা হয়তো আলাদা, কিন্তু তুমি যখন রুখে দাড়াও অন্যায়ের প্রতিবাদে, বিনিময়ে তোমায় দেওয়া হয় বেশ্যা উপাধি, তুমি যখন তোমার অধিকার নিয়ে কথা বলো, বিনিময়ে পাও গণধর্ষণের হুমকি; তুমি যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মিছিল করায়, জেল হাজতে তোমার অন্তর্বাস খুলতে বাধ্য করা হয়; কিন্তু এতকিছুর পরও যখন তোমার সাহসকে ভাঙা যায় না, তুমি হাতের মুঠো আরো শক্ত করে শুন্যে তোলো, তখনই মনে হয় আসলে তোমার আমার বেঁচে থাকায় খুব বিশাল কোনো ব্যবধান নেই।
মেয়ে, তুমি হয়তো জানো, নারীজন্মে জীবনের বেশিরভাগ সময় কোনো না কোনো অজুহাতে আঞ্চলিক ভাষায় কত কি গালি শুনতেই হয়, ধর্ষণ, গনধর্ষণের হুমকি পেতেই হয়। এই সমাজ, এই রাষ্ট্র চরমভাবে শিশ্নপ্রধান। আর এই শিশ্নপ্রধান সমাজে ক্ষমতাধর নারীটিও চরম অসহায়। যদি তুমি ওড়না না পরতে চাও, তুমি বেশ্যা। পুরুষদের মতের বিরুদ্ধে বলেছো, তোমার এত সাহস- তুমি বেশ্যা। তোমাকে সকলের সামনে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়া হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছ! সামান্য মেয়েমানুষের এত আস্পর্ধা! তুমি বেশ্যা। পড়াশুনার চাপে বা চাকরি বা ক্যারিয়ারের জন্য হয়তো সন্তান ধারণে অনীহা, তুমি ফিগার ঠিক রাখতে চাওয়া বেশ্যা। নারীজন্মে সারাজীবন ধরে চলে বেশ্যা সমাচার।
আসলে এই সমাজ/রাষ্ট্রে, ধর্ষণ পুরুষের ক্ষমতার বহি:প্রকাশ। ধর্ষণ হলো পৌরুষের একাধিপত্যের নিশান। তারা পুরুষ, তাদের একখানা লিঙ্গ আছে এবং ঠিক সেকারণেই তারা যখন তখন যে কোনো নারীকে ধর্ষণের হুমকি দিতে পারে, গনধর্ষণের হুমকি দিতে পারে, কুকুর দিয়ে ধর্ষণ করানোর হুমকি দিতে পারে, কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার কথা বলতে পারে। তোমাকে অবলীলায় বেশ্যা উপাধিতে ভূষিত করতে পারে, সে ফেসবুক পোস্ট হোক অথবা প্রাত্যহিক জীবনে। তাদের কোনো শাস্তি হয় না, কোনো প্রতিবাদ হয় না, আইন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নাগরিক তাদের দেখে মুচকি হাসে। তাদের দেখে নতুন করে জেগে ওঠে আরো কত পটেনশিয়াল ধর্ষক। তুমি নারী, তুমি একটা মাংস পিণ্ড, এবং যেহেতু তোমার যোনি আছে, তুমি পাঁচ বছর বয়সের হও বা পঞ্চাশ বছরের, তোমায় ধর্ষণ করা, বা ধর্ষণের হুমকি দেওয়া পুরুষ, পুরুষপ্রধান রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার।
মেয়ে, তুমি তো জানোই, মৌলবাদের- সে হিন্দু মৌলবাদ হোক বা মুসলিম মৌলবাদ, কোনো পার্থক্য নেই। এই দুই মৌলবাদেরই প্রধান কাজ নারীদের আটকে রাখা। কারণ, এই দুই মৌলবাদী শক্তিকেই চালায় পুরুষেরা। এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজ্জাধারী পুরুষ পাষণ্ডের কাছে নারী নিছক ‘সেক্স অবজেক্ট' ছাড়া আর কিছু নয়। আর কিছু ভাবতে চায়ও না তারা।
তাই তোমার রাজনৈতিক মতামতের প্রতি, তোমার নিজের অধিকার চাওয়ার প্রতি তারা প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করে। তাদের তথাকথিত মতের বিরুদ্ধে গেলেই অক্টোপাসের মতো হাত-পা ছড়িয়ে তারা তোমায় কুৎসিত আক্রমন করে। তারা খুব বিরক্ত হয় যখন তুমি তাদের কাছে মাথা নত করো না।
তোমার প্রতিবাদ কেন তাদের শান্তি নষ্ট করে তার কারণ আমি জানি। তুমি যখন তাদের সহানুভূতি চাও না, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তাদের কাছে অধিকার ভিক্ষা করতে যাও না; (তারা মহান পুরুষ দেখতে চায়, তুমি নাকিকান্না কেঁদে তাদের কাছে বঞ্চনার প্রতিকার চাইবে) তাদের সে ইচ্ছেয় গুড়েবালি দিয়ে তোমার লড়াই যখন তুমি নিজে করো, তারা ক্ষুব্ধ হয়, রাগ করে। চিৎকার করে তোমায় থামাতে চায়। তারা তোমাকে ভয় পায়। তোমার মাথা না নুয়ানোর সাহসকে ভয় পায়। যুগযুগ ধরে পুরুষতন্ত্র তাদের পইপই করে শিখিয়েছে, নারীর স্থান পুরুষের পায়ের নিচে। তাই আজ যখন তারা দেখে নারী তাদের বাধা-নিষেধকে তোয়াক্কা না করে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। একজন প্রতিবাদী নারীকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে তারা। মেয়ে হয়ে হাজার-কোটি বছরের ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে মাথা তুলে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে, সে পরিবর্তনের কথা বলছে, সমান অধিকারের কথা বলছে, অনেকক্ষেত্রে সে পুরুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে - এসব তারা মেনে নিতে পারে না। তাদের এতদিনের সিংহাসন চলে যাওয়ার ভয় পায় তারা। তাই ঐসব তকমা দিয়ে, গণধর্ষণের হুমকি দিয়ে তারা তোমায় দমন করতে চায়, আটকে রাখতে চায়। একজন নারীর চলার পথকে দুর্গম আর কষ্টময় করতে তার চরিত্রের উপর আঘাত হানা, তাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়াই তাদের শেষ হাতিয়ার।
তুমি তো জানোই মেয়ে, নারীবাদ মানে মস্তিষ্কে চেপে বসা কোনো ভূতুড়ে খামখেয়াল নয়, নারীবাদ মানে পুরুষবিদ্বেষী হয়ে ওঠাও নয়। নারীবাদ একটা নিরন্তর লড়াই, যে লড়াই নারী স্বাধীনতা-প্রত্যাশী। চোখের ছানির মতো পুরুষতান্ত্রিকতাও আসলে একপ্রকার সামাজিক ছানি এবং নারীবাদ তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক ওষুধ।
তাই আজ খুব জরুরি, পুরুষতন্ত্র নামক ছানিটাকে কাটা যা আদপে ধর্ষণ নামক ক্ষমতা প্রদর্শনের শেকড়। পুরুষতন্ত্রের প্রমোটররা আমাদের প্রতিপক্ষ তো বটেই। তাদের সাথে লড়াই আমাদের লিঙ্গের নয়, যোগ্যতার। জন্মসূত্রে পাওয়া এক লিঙ্গের জোরে তারা যতদিন নিজেদের প্রথম আর আমাদের দ্বিতীয় লিঙ্গ ভাবতে থাকবে, আমরা ততদিন ওই লিঙ্গ বিভেদকে চ্যালেঞ্জ করে তাদেরকে মানুষ বানানোর লড়াই করে যাবো। তারা যতদিন পুরুষ হয়ে নারীকে শোষণ করবে, আমরা মানুষ হয়ে তাদের মোকাবেলা করবো। তারা যত নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের, তাদের তত বেশি করে স্বাধীনতা শেখাবো আমরা। যতদিন তারা নারীকে দমন পীড়ন করবে, ততদিন আমরা তাদের মানুষের শক্তি দেখাবো। যতোবার তারা নারীকে দমিয়ে রাখতে ধর্ষণ, গণধর্ষণের হুমকি দেবে, ততোবার আমরা মানুষ হয়ে শাবল চালাবো তাদের বুকে; পুরুষতন্ত্রের বুকে।
তুমি তো জানোই মেয়ে, আমাদের শুরুটা বেশিদিনের নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে আসা সংস্কারকে এক তুড়ি মেরে- তাতে পরিবর্তনের আশা আমরা করি না। দু’চার বছরের ভেতর যে সবকিছু বদলে যাবে এমন আশাও করি না। কারণ পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রসেস। আমরা শতাব্দীর হিসাব করে লিখি বা বলি; রাতারাতি কোনকিছু পরিবর্তনের আশায় নয়। তবুও আমাদের জীবদ্দশায় আমাদের কথা শুনে, লেখা পড়ে যদি একটা মেয়েও ঘুরে দাঁড়ায়, একটা ছেলেও যদি মেয়েটার হাত ধরে পাশে দাঁড়ায়, তবে তো সেটাই আমাদের প্রাপ্তি বলো! সেটাই তো আমাদের বলা হাজারটা কথার, লেখার, স্বপ্নের পূর্ণতা!
তাই যতই বাধা আসুক মেয়ে, যতই পুরুষতান্ত্রিক হায়েনারা আমাদের ছিঁড়ে খেতে আসুক, যত নোংরা মন্তব্য উড়ে আসুক আমাদের দিকে, হার মেনো না কখনো। বরং আরো জোরে চিৎকার করো, সেই চিৎকারে যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা একটা ইট খসে পড়ে। আজকে হয়তো আমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু কোন এক গ্রীষ্মে আমরা ঠিক দ্বিগুণ হবো।
প্রিয় মেয়ে, লড়াইটা ততোদিন চালিয়ে যেতে হবে তো।
সুমনা চৌধুরীর ফেসবুক থেকে